You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ
প্রচণ্ড বিরােধিতার মুখেও সফল আন্দোলন

সিরাজগঞ্জ পাবনা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা হিসেবে পরিচিত ছিল। বিভাগ-পূর্ব ইংরেজ শাসনামলেও এ অঞ্চলের খ্যাতি কৃষক আন্দোলনের কারণে, সেই সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায়ও। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর খ্যাতি অব্যাহত। জড়িত মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নামের সঙ্গেও। সিরাজগঞ্জের রাজনৈতিক চরিত্রটি নানা মাত্রায় চিহ্নিত। যেমন শ্রমিক আন্দোলনে।
স্বভাবতই ভাষা আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ পূর্বাপর জড়িত, এর জেলা শহর পাবনার মতােই। এখানে আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৮ থেকেই এবং তা যথারীতি ছাত্রদের উদ্যোগে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। আহ্বায়ক ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলাম।
সাংবাদিক মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিবেদন মতে, এ কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য মীর আবুল হােসেন ও নজরুল ইসলাম। এখানকার আন্দোলন ছাত্র নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এতে নানা খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলাের সংশ্লিষ্টতা। এ ঘটনা অবশ্য পরবর্তী পর্বের।
পূর্ব নিবন্ধকার এবং আরও দু-একটি সূত্রমতে ১৯৪৭-৪৮-এ সিরাজগঞ্জে মুসলিম লীগ দল ও তাদের সরকারি শাসনের প্রবল দাপট, যেমনটি আমরা দেখেছি দেশের অন্যত্র। তাদের মতে, তখন সিরাজগঞ্জের মুসলিম মানসে পাকিস্তানি মৌতাতের প্রভাব এতটাই যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে তাদের বড় একটা মাথাব্যথা নেই। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের ভাষার লড়াইয়ে শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থন ব্যাপক নয়। কাজেই যত্রতত্র সভা-সমাবেশ করার সুযােগ সীমিত।
এমন এক পরিস্থিতিতে এসে গেল উল্লিখিত ১৯৪৮-এর ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের ঘােষণা। আন্দোলনও শুরু ঢাকা, সিলেট, যশাের, রাজশাহী, পাবনাসহ একাধিক জেলা শহরে। সিরাজগঞ্জের ছাত্রনেতৃত্বও উত্তেজিত আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য। কিন্তু শহরের পরিস্থিতি প্রতিকূল।
তা সত্ত্বেও ছাত্রনেতৃত্বের চেষ্টা চলেছে ধর্মঘট, সভা-মিছিল ইত্যাদির পক্ষে প্রচারণা। তখন মাইক ছিল না, টিনের চোঙা ফুকিয়ে প্রচারণা চালাতে হলাে। কিন্তু ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল না। প্রশাসনিক হুমকি মুসলিম লীগের। ভাষাবিষয়ক অপপ্রচারের কারণে আন্দোলনে সুফল মেলেনি। তদুপরি ছিল সরকারি দমননীতি।
তবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২-এর মধ্যবর্তী সময়ে সাইফুল ইসলাম প্রমুখ ছাত্রের নিরলস চেষ্টায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সচেতনতা বাড়তে থাকে। ছাত্রনেতত্বে নতুন মুখ দেখা দিতে থাকে। যেমন তমিজুল ইসলাম, মুরাদুজ্জামান, নূরে এলাহী, সুবােধ চন্দ্র রায় প্রমুখ। তাদের সহযােগী ডা. জিতেন্দ্রনাথ নিয়ােগী।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু হয় ১৯৫২ সালে পৌছে। তখনাে ঢাকা- সিরাজগঞ্জ যােগাযােগ ও যাতায়াতব্যবস্থা খুব একটা ভালাে নয়। তুলনায় কলকাতাত সঙ্গে যােগাযােগ কম সময়ের, বিশেষ করে দৈনিক সংবাদপত্র আসার ক্ষেত্রে। ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি সংক্রান্ত ঘটনাবলির খবর পরদিনই সিরাজগঞ্জে পৌছে যায়।
শিক্ষায়তনগুলােতে ছাত্রদের মধ্যে দেখা দেয় উত্তেজনা, বিশেষ করে ছাত্র হত্যার কারণে। ২২ ফেব্রুয়ারি শহরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের শুরু। স্থানীয় বিএল হাইস্কুলসহ জুনিয়র স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সরকারবিরােধী স্লোগান দিতে থাকে। ভােরের কাগজ-এর (১৯৯৩) সংবাদদাতা হেলাল উদ্দিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ছাত্রদের মুখে মুখে একটি স্লোগান বেশি শােনা যেতাে : “নুইরা-নাজিম দুই ভাই/ এক দড়িতে ফাসী চাই।” প্রতিবেদকের মতে এদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে বেশি। তা ছাড়া ছিল গতানুগতিক স্লোগান : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সংবাদটি উল্লেখযােগ্য (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। তাতে বলা হয়েছে :
সিরাজগঞ্জে প্রতিবাদ দিবস পালনকল্পে শহরের সমস্ত স্কুল-কলেজ, দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। আইন ব্যবসায়ীগণও হরতাল পালন করেন। বেলা ১২টার সময় বিএল স্কুল প্রাঙ্গণ হইতে ছাত্রদের এক শােভা যাত্রা বাহির হইয়া বিভিন্ন ধ্বনিসহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে। বৈকাল ৪ ঘটিকায় জনাব সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক বিরাট সভা হয়। সভায় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টায় সরকারি অর্থ অপচয়ের তীব্র নিন্দা এবং করাচীর ন্যায় ঢাকায়ও গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনুরূপ সংবাদ বিবরণ প্রকাশিত হয় ১৬ মার্চের সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকাতেও।
এ সম্পর্কে পূর্বোক্ত দুই প্রতিবেদকের বিবরণে প্রকাশ ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ইলিয়ট ব্রিজের পশ্চিম পাশে এক প্রতিবাদ সভা হয়। এখানে শহরের দুই শতাধিক ছাত্র জমায়েত হয়। এ ছাত্রসভায় ক্রমে সাধারণ মানুষও যােগ দেন। বড়সড় এ সভায় ক্রমাগত সরকারবিরােধী স্লোগান উঠতে থাকে। এতে প্রধান বক্তা ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলাম।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, যানবাহন যথারীতি বন্ধ থাকে। ব্যবসায়ীরাও তাদের কাজকর্ম বন্ধ রাখেন। দুপুরে বিএল স্কুলের ছাত্রদের এক মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান সড়কগুলাে প্রদক্ষিণ করে। এ মিছিলেও বরাবরের উচ্চারিত স্লোগান, বিশেষ করে আরবি হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে।
বিকেলে সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে ছাত্র-জনতার বিশাল এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ আন্দোলনে ও সভায় স্থানীয় ছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখযােগ্য। বুঝতে পারা যায়, ১৯৪৮-এর সিরাজগঞ্জ কতটা বদলে গেছে ১৯৫২ সালে এসে একুশের জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। ছাত্রীদের নেতৃত্বে উল্লেখযােগ্য ‘বিজলী, মেহের নিগার, নূর এলাহী প্রমুখ’ (সিরাজগঞ্জে ভাষা আন্দোলন, এম আবদুল আলীম, ২০১৩)।
সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলনে স্থানীয় ‘রেনেসাঁ’ ক্লাবের প্রধানদের ছিল উল্লেখযােগ্য ভূমিকা। এর প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল ইসলাম, নুরুন্নবী খান (ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ভাষাসংগ্রামী মহিউদ্দিন খানের অনুজ) রামকৃষ্ণ সাহা প্রমুখ। স্বভাবতই ক্ষিপ্ত স্থানীয় প্রশাসন একপর্যায়ে এ ক্লাবের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি তথ্য যা দূর শহরে প্রায়ই দেখা গেছে, ছাত্রনেতারা অর্থাভাবে পােস্টার লেখার কাজে খবরের কাগজ ব্যবহার করেছে। পূর্বোক্ত দুই প্রতিবেদক হেলাল উদ্দিন এবং জিন্নাহ আরও একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন এই বলে যে এ পর্বে জনসভাগুলাে অনুষ্ঠিত হতাে আইআই কলেজের মাঠে। প্রতিদিন বিকেলে এখানে মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
এ আন্দোলন অব্যাহত থেকেছে ২৬ ফেব্রুয়ারির হরতাল ও জনসভার পরও। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এ সময় নিয়মিত চলেছে ছাত্রসভা, জনসভা, মিছিল ও পােস্টারিংয়ের মতাে কাজ। তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক’ ব্যাজ ছাপিয়ে বিক্রি করেছেন ছাত্রীরা। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ইরা, হেনা, মনিকা, বিজলি প্রমুখ। এ পর্যায়ে প্রতিবেদকের মতে, গ্রাম ছাড়াও সাহায্য সংগ্রহে ভূমিকা পালন করেছেন শহরের কয়েকজন বয়স্ক অভিভাবক।
সিরাজগঞ্জের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য সাইফুল ইসলাম, আজিজ মেহের টুতেকু, মােহাতার হােসেন, তমিজুল ইসলাম, সৈয়দ কায়ছার আলী, মুরাদুজ্জামান প্রমুখ। একই সঙ্গে উল্লেখ্য, খুরশীদ আলম, মির্জা আজাদ, মফিজুদ্দিন তালুকদার, মােশাররফ হােসেন চৌধুরী, আবদুল মােতালেব খান, হাবিবুল আলম, আবুল কালাম আজাদ, নূরুন্নবী খান প্রমুখ।
সিরাজগঞ্জের আন্দোলনের প্রধান নেতাদের অনেকে শহরের বাইরে আন্দোলন সংঘটনে সহযােগিতা করেন। উল্লেখ্য, শাহজাদপুরের স্থানীয় স্কুলগুলােতে ছাত্রধর্মঘট, মিছিল এবং সভা-সমাবেশ শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পুলিশেত হামলা তাদের আন্দোলন বন্ধ করতে পারেনি। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় গ্রামপর্যায়ে।
সাপ্তাহিক সৈনিক- এর বিবরণ মতে, ফুলবাড়ী গ্রামে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের এক মহতী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অনন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের লােকও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও মহকুমার একাধিক এলাকায় একুশের আন্দোলন আপন গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- সােহাগপুর, এনায়েতপুর, আহছন নগর, আজুগড়, খামার গ্রাম, দৌলতপুর, প্রভৃতি গ্রামের সিংহভাগ মানুষ ও তাঁত শ্রমিকেরা এ সময় অর্থ সাহায্য দিয়ে আন্দোলনে সহযােগিতা করেন। তবে ছােট পরিসরে হলেও কিছু বিরােধিতা ছিল শহরের বিত্তবান শ্রেণির মধ্যে।
প্রতিক্রিয়াশীল বিত্তবানদের বিরােধিতার কারণে ১৯৫২ সালে সিরাজগঞ্জে ছাত্রনেতাদের শহীদ মিনার তৈরির চেষ্টা সফল হয়নি। তবু রাতের অন্ধকারে চেষ্টা চলেছে, বিশেষভাবে শ্রমিকদের সহায়তায়। পরে ১৯৭৪ সালে শহীদ মিনারের ভিত্তিস্থাপন এবং ১৯৮৮ সালে পৌরসভার উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস-এর সিরাজগঞ্জ বিষয়ক নিবন্ধটিতেও মেডিকেল ছাত্র আমার বন্ধু আলী আজমল (আজমল হােসেন নয়) সম্পর্কে কিছু ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। যেমন ৪ ফেব্রুয়ারি বেলতলায় বক্তৃতা। বরং উল্লেখ করা হয়নি ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভাঙার সময় প্রথম সারিতে থেকে তার গ্রেপ্তার ও দীর্ঘ সময় পর মুক্তি পাওয়ার ঘটনা।
একুশের প্রদেশব্যাপী সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ ও সন্নিহিত এলাকার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর অন্যতম প্রধান ব্যক্তিটি ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলাম।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!