ভাষা আন্দোলনে নেত্রকোনা
মুসলিম লীগের একাংশ আন্দোলনে যুক্ত
ময়মনসিংহ জেলার আরেকটি মহকুমা নেত্রকোনা। রাজনৈতিক বিচারে অগ্রসর বলা চলে। আগেই বলা হয়েছে, এ মহকুমায় অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনের কথা। পাকিস্তান আমলে এ মহকুমার কৃতী সন্তান বিচারপতি মাহাবুদ্দীন আহমদ (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি), রাজনীতিক আবদুল মমিন, ভাষাসংগ্রামী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ফুলে হুসেন প্রমুখ।
এ মহকুমা শহরে তখনাে কোনাে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবু এখানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে। এবং স্কুলছাত্র ও স্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ আন্দোলন সংঘটিত হতে সাহায্য করে। বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক ফুলে হুসেনের বিবরণে প্রকাশ, এখানে ছিল তিনটি ছেলেদের হাইস্কুল, একটি মেয়েদের … ছাত্র ফেডারেশন ছাড়া আর কোনাে ছাত্রসংগঠনও ছিল না।
তাঁর মতে, ‘হাইস্কুলের নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফলে ১১ মার্চ নেত্রকোনা শহরে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়, সমস্ত দোকানপাট, বাজার ছিল বন্ধ। শহরের চারটি হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। তাদের সঙ্গে যােগ দেয়… পাঠশালার ছেলেমেয়েরা।’
অর্থাৎ একটি সর্বাত্মক ছাত্রছাত্রী আন্দোলন, তা-ও সেই ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে, যখন পূর্ববঙ্গের বেশ কিছুসংখ্যক শহরে আন্দোলন দেখা যায়নি, শুরু হয়েছে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে। একটি বিষয় মনে রাখার মতো জেলা শহর ময়মনসিংহ বা মহকুমা শহর টাঙ্গাইল ঢাকার নিকটবর্তী হলেও বাকি মহকুমা শহর ছিল বেশ দূরে। তাই সংবাদ আদান-প্রদানগত যােগাযােগব্যবস্থা খুব একটা ত্বরিত ছিল না।
সম্ভবত এ কারণে এমন সব শহরে বা দূর এলাকায় ভাষা আন্দোলন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা শহরের সঙ্গে সব সময় তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। নেত্রকোনায় ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কুন্তল বিশ্বাস লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণার পরপরই নেত্রকোনায় প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে আলােড়ন ওঠে। ভাষার প্রশ্নটি রাজনৈতিক মহলে আলােচিত হতে থাকে।
ভাষা আন্দোলনের এ-জাতীয় বৈশিষ্ট্য প্রদেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা গেছে। যেমন দেখা গেছে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি। এগুলাে ছিল আন্দোলনের সর্বজনীন চরিত্র।
বলতে হয় নেত্রকোনায় ভাষা আন্দোলন জোরেশােরে শুরু হয় ১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারির ধারাবাহিকতায়। সাংবাদিক কুন্তল বিশ্বাসের মতে, নেত্রকোনায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারির পর। এর আহ্বায়ক অধ্যাপক আমিরুল্লাহ চৌধুরী এবং যুগ্ম আহ্বায়ক আছিম উদ্দিন আহমদ। কিন্তু এর আগেই ‘একুশে’ শুরু হয়ে যায় ছাত্রছাত্রীদের তুমুল প্রতিবাদী আচরণে।
নেত্রকোনার আরেক কৃতী সন্তান সাহিত্যিক যতীন সরকার তাঁর স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, গগনবিদারী স্লোগান দিতে দিতে স্যারকে ক্লাসে রেখেই আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আঞ্জুমান ও দত্ত হাইস্কুলের ছাত্ররা বেরিয়ে এসেছে। বিশাল ছাত্র মিছিল নেত্রকোনা শহরের রাস্তা কাঁপিয়ে তুলল।… মিছিল শেষে সভা। তখন নেত্রকোনায় কলেজ ছিল না। ইস্কুলের ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্ররাই নেতা। সব নেতাই বক্তৃতা দিলেন। সকলের বক্তৃতাতেই আগুন ঝরল। কিছু খবরও বেরিয়ে এল তাদের বক্তৃতা থেকে। জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে বলেছেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” (কুন্তল বিশ্বাস)।
এ বিবরণের লেখক আমাদের একান্তজন যতীন সরকার তখন স্থানীয় চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ১৯৫২ সালে তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র, গায়ের স্কুলের। দেখেছেন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। তাদের মিছিল পরিক্রমা। এটাই একুশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
সংগ্রাম কমিটি গঠিত না হােক, একুশের পূর্বঘােষিত কর্মসূচি পালনে ভাষাসচেতন ছাত্ররা পিছিয়ে থাকবে কেন? একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) থেকেই ‘নেত্রকোনার সচেতন ছাত্রসমাজ ও জনসাধারণ তাহাদের ন্যায্য দাবী “বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার” সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়ে।… দুই হাজার লােকের এক বিরাট শােভাযাত্রা “নুরুল আমীন গদী ছাড়”, “খুনিদের শাস্তি চাই”, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” প্রভৃতি ধ্বনিসহকারে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। সারা শহরে দেয়ালপত্রিকা (পােস্টার) লাগানাে হয়। শহরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে ও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। বিকাল চারটায় জনাব ফজলুল কাদেরের সভাপতিত্বে জনসভা হয়।
২২ তারিখে ছাত্ররা শহরময় প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ বিভিন্ন ধ্বনিসহকারে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং এক ছাত্রসভার অনুষ্ঠান হয়।
‘২৩ তারিখে পুনরায় সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল) হয়। সমস্ত দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। ঐদিন গ্রামের দিক হইতে অনেক জনতা আসিয়া আন্দোলনে যােগ দেয়। ভাষা আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য ঐ দিন সকালে সর্বদলীয়ভাবে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। (সৈনিক, ৯ মার্চ ১৯৫২)।
এঁদের মতে মুসলিম লীগের একাংশ আন্দোলনে যােগ দেয়।
বিশদ বিবরণে না গিয়েও দেখা যায়, ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনে যে জ্বালানি যুক্ত হয় প্রদেশজুড়ে, নেত্রকোনাও তার অংশ। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে এই যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু, তার ধারাবাহিকতায় ২৫ ফেব্রুয়ারিতেও নেত্রকোনা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। দিনভর মিছিল, স্লোগান, সভা-সমাবেশে শহর স্পন্দিত।
এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন ওয়াজেদ আলী। বক্তব্য রাখেন কে এম ফজলুল কাদের, সত্য কিরণ আদিত্য ও আবদুল কুদুস।’ (কুন্তল বিশ্বাস)। নিষ্ক্রিয় থাকেনি প্রশাসন। বিপুল প্রতিবাদী সমারােহ সত্ত্বেও যথারীতি গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি, গ্রেপ্তার, মিছিলে লাঠিচার্জ সবই চলেছে। তাদের সহযােগী মুসলিম লীগ নেতারা। নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন, অন্যরা হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগােপনে থেকে আন্দোলন পরিচালনায় সহায়তা করেন।
‘তখন নেত্রকোনায় রাজনৈতিক দল বলতে ছিল মাত্র দুটি। মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি। আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি তখনাে নেত্রকোনায় গঠিত হয়নি। ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) ও ছাত্র ফেডারেশন। কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’ (কুন্তল বিশ্বাস)।
‘ভাষা আন্দোলনে নেত্রকোনাতে যারা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন তারা হলেন আছিম উদ্দিন আহমদ, আবদুল খালেক, ফজলুর রহমান খান, আবদুল কুদুস, আবদুল হাকিম, নুরুল হুদা, শামসুল হক, গাজী গােলাম মােস্তফা, বীরেন্দ্র, আবদুস শহীদ প্রমুখ।’ (কুন্তল বিশ্বাস)। আমাদের জানামতে, এঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফুলে হুসেন, তাহের উদ্দিন, আবদুল আলী প্রমুখ। পূর্বোক্ত বিবরণে জানা যায়, কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য ও গােপন নেতারা আন্দোলনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন এবং তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক