ভাষা আন্দোলনে জামালপুর
ভাষা আন্দোলনে বাম রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ
পূর্ববঙ্গের তৎকালীন সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের মহকমাগুলোও ছিল বড়সড় আয়তনের এবং রাজনীতি সচেতন, কোনাে কোনােটি সাহিত্য- সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রসর। অন্যদিকে মহকুমাসহ ময়মনসিংহ জেলা কষি উৎপাদনের উর্বর ভূমি। তাই কৃষক আন্দোলন, কৃষক সংগঠন যথেষ্ট শক্তিশালী বিশেষ করে অঞ্চলটির জমিদারপ্রধান সামন্তচরিত্রের কারণে। জমিদারদের অধিকাংশই হিন্দু এবং বলা বাহুল্য কৃষকদের প্রায় সবাই মুসলমান হওয়ার কারণে সম্প্রদায়বাদী চেতনার প্রাধান্য। এবং তা মুসলিম লীগ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রায় সর্বত্র। তা ছাড়া জমিদার-কৃষক দ্বন্দ্বের কারণে এ জেলায় কমিউনিস্ট পরিচালিত কৃষক সমিতি ও কৃষক সংগঠনও ছিল যথেষ্ট শক্তিমান। এ জেলার একাধিক স্থানে কৃষক সমিতির সম্মেলনও হয়েছে মহাসমারােহে। যেমন জামালপুর মহকুমার নালিতাবাড়ী (১৯৪৩) এবং নেত্রকোনায় (১৯৪৫)।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগ-পূর্বকালে জামালপুরের রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা ছিল মুসলিম লীগ, জাতীয় কংগ্রেস ও তাদের কৃষক সংগঠনসহ কমিউনিস্ট পার্টির। হক সাহেবের কৃষক প্রজাপার্টির সাংগঠনিক তৎপরতা তার আদর্শিক ভুলভ্রান্তির কারণে তখন প্রায় নিঃশেষিত। বিভাগােত্তর পর্বে দেশত্যাগের কারণে কংগ্রেস রাজনীতি দুর্বল। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি তখনো সজীব। পাশাপশি সম্প্রদায়বাদী পাকিস্তানি ধারার সাহিত্যচর্চাও শক্তিমান।
১৯৪৮ সময়পর্বে পূৰ্ববঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের আমলে খাদ্যাভাব, চিনি, লবণ, কেরােসিন-সংকট দেখা দিলে ময়মনসিংহ, জামালপুর প্রভৃতি অঞ্চলে খাদ্য আন্দোলন ও প্রতিবাদী ভুখা মিছিল দেখা যায় সর্বাধিক মাত্রায়। সে সূত্রে জামালপুরে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ছিল একটি বিশেষ ভূমিকা। নেপথ্যে আত্মগােপনে বা প্রকাশ্যে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের সতর্ক তৎপরতা।
এসবের প্রভাব পড়ে ছাত্রদের মধ্যে ও ছাত্ররাজনীতিতে ও সংস্কৃতিচর্চায়। এদিক থেকে মহকুমা শহর জামালপুর একটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অবস্থান অর্জন করে। সংবাদ প্রতিবেদক শফিক জামান (ভােরের কাগজ, ১৯৯৩) লিখেছেন : ‘প্রগতিশীল বাম ধারার আন্দোলন তখন জোরদার ছিল জামালপুরে।’
এ পর্বে প্রগতিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য শেরপুরের রবি নিয়ােগী, জিতেন সােম, জামালপুরের মন্মথ দে, আশু দত্ত, মনা দাস; কংগ্রেস নেতা নাসিরউদ্দিন সরকার, হায়দার আলী মল্লিক, তৈয়ব আলী আহমদ প্রমুখ। এঁদের প্রভাবে ভাষার পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রাধান্য ছিল অধিকতর। এদিক থেকে রাজনীতিসচেতন শেরপুর থানা ছিল অনেকখানি এগিয়ে।
জামালপুরে ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলন ছিল প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৪৮-এ শেরপুর থানায় আনিছুর রহমানকে আহ্বায়ক করে একটি ভাষা কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির উদ্যোগে মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে আলােচনা ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক আলােচনা। যেমন ১৯৪৮-এর আগস্টে ‘ঝুটা আজাদী’ নিয়ে আলােচনা ও প্রবন্ধ পাঠ। পরিণামে ছাত্রনেতা সৈয়দ আবদুস সাত্তারসহ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জামালপুর সাবজেলে পাঠিয়ে দেয়।
ভাষা ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ১৯৫০-এর কিছু তৎপরতার পর ১৯৫১-তে ‘প্রবাহ সাহিত্য মজলিশ’ নামে একটি প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন গঠিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ আবদুস সাত্তার, সৈয়দ ইমামুর রশীদ, সৈয়দ আবদুস সােবহান, ক্ষিতীশ তালুকদার, অরুণ তালুকদার প্রমুখ সাহিত্য ও রাজনৈতিক কর্মী। এঁরাই রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক অধিকারের চেতনা ধরে রাখেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ভাষিক চেতনার এই ধারা অক্ষুন্ন রাখতে ১৯৫১-এর ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সভাপতি আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা তৈয়ব আলী আহমদ, সম্পাদক স্থানীয় আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক দুই ছাত্রনেতা আক্তারুজ্জামান মতি ও সৈয়দ আবদুস সােবাহান। এঁদের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা দিদারুল আলম খুররম।
এদের সবাইকে প্রাক-একুশে পর্বে ভাষাবিষয়ক কর্মকাণ্ডের দায়ে বার কয়েক গ্রেপ্তার করে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে মাওলানা ভাসানীর সফর এদের মনােবল বাড়িয়ে তােলে। ইতিমধ্যে এসে পড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত প্রতিবাদী কর্মসূচি নিয়ে। এ প্রসঙ্গে দিদারুল আলম জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি থেকেই জামালপুর রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। দিনভর ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিল শহরের রাস্তাগুলাে স্লোগানে মুখর করে তােলে। বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও মিছিল করে পথে নামে। এসব প্রতিবাদ মিছিল ছিল পুরােপুরি স্বতঃস্ফূর্ত।
স্বভাবতই ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে যথারীতি পালিত হয়। অর্থাৎ ছাত্রধর্মঘট, মিছিল, প্রতিবাদ সভা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে ডাক দেওয়া হয় হরতালের। সাড়া মেলে সে ডাকে। বন্ধ হয় দোকানপাট। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বাজারহাটের একই অবস্থা। পুলিশ একপর্যায়ে নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
আন্দোলন তাতে বন্ধ হয় না। বন্ধ হয় না মিছিল, স্লোগান এবং সভা-সমাবেশ। এ আন্দোলন যথারীতি ছড়িয়ে পড়ে মহকুমা শহর থেকে থানা এবং অধিকতর দুর এলাকায়। উল্লেখযােগ্য এলাকাগুলাে হচ্ছে ইসলামপুর, শেরপর, সরিষাবাড়ী, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, মেলান্দহ, নকলা প্রভৃতি। এসব থানার প্রতিটি স্কুলে পালিত হয় ধর্মঘট। সেই সঙ্গে চলে প্রতিবাদী মিছিল, স্লোগান ও জমায়েত। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আরও ব্যাপকভাবে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে আন্দোলন বন্ধ করতে, মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে। মিছিলে লাঠিচার্জ, সেই সঙ্গে গ্রেপ্তার- দুই-ই চলে। এবার গ্রেপ্তার হন আক্তারুজ্জামান মতি, আলী আসাদ, ফজলুল হকসহ আটজন নেতা। তাদের এক সপ্তাহ জামালপুর জেলে রেখে পরে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য যাতে নেতারা স্থানীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে না পারেন। এদিনের মিছিলে নতুন স্লোগান উচ্চারিত হয়, যেমন দেখা গেছে শােনা গেছে ঢাকার মিছিলে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’, ‘নুরুল আমিনের কল্লা চাই’ ইত্যাদি।
আবারও বলতে হয়, জামালপুর এদিন ঢাকার মতােই মিছিলের শহর। ব্যতিক্রমী ধারায় চলেছে রাস্তার মােড়ে মােড়ে পথসভা। ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন আরও বেগবান করে তুলতে নতুন করে ভিন্ন একটি ছাত্রনেতা প্রধান সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আন্দোলনে সত্যি গতি সঞ্চারিত হয়। প্রতিবাদ আরও ব্যাপকভাবে মহকুমার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিটি থানায় হরতাল, প্রতিবাদ সভা ও মিছিল। স্বভাবতই প্রশাসন বিচলিত। যেকোনােভাবে আন্দোলন দমন করতে পুলিশ কঠোর অবস্থানে। তা সত্ত্বেও আন্দোলন অব্যাহত থাকে মার্চের প্রথম সপ্তাহের পরও। অর্থাৎ ৫ মার্চের ঘােষিত সফল হরতালের পরও।
দৈনিক আজাদ-এর কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদনে আন্দোলনের চিত্র, পরিচয় মেলে। দু-একটি উদাহরণ :
‘গত ২২শে ফেব্রুয়ারী গ্রামাঞ্চল হইতে দলে দলে ছাত্র ও জনসাধারণকে কাল ফিতা পরিধান করিয়া শহরে আসিতে দেখা যায়। বেলা ১১টায় বিরাট মিছিল “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”, “অপরাধীদের বিচার চাই” ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে।… অপরাহ্নে রেলস্টেশন ময়দানে প্রায় ২০ হাজার লােকের এক সভা হয়।… প্রস্তাবে বর্তমান লীগ মন্ত্রীসভার পদত্যাগ ছাত্রবন্দীদের মুক্তি দাবী এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীর ভাষা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বিবৃতির তীব্র নিন্দা করা হয়।’
উল্লেখ্য যে যত দূর জানা যায়, প্রদেশের অন্য কোথাও শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রাথমিক বাংলা রাষ্ট্র ভাষাবিরােধী বিবৃতিটি নিয়ে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি। অবশ্য আজাদ ফলাও করে বিবৃতিটি ছেপে আওয়ামী নেতাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে জামালপুরে প্রতিবাদ সংঘটিত হয়।
একই পত্রিকায় (৯ মার্চ ১৯৫২) অন্য একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ২৭শে ফেব্রুয়ারী জামালপুর কলেজ টিচার্স কাউন্সিলের এক সভা হয়।… একটি প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘােষণা করার জন্য পাক গণপরিষদের নিকট দাবী জানানাে হয়। অন্য প্রস্তাবে বাংলাকে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানাে হয়।’
সন্দেহ নেই, শেষ প্রস্তাবটি জামালপুর কলেজশিক্ষকদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী ভাষাপ্রেমী ঘটনা। কারণ, ঢাকার মিছিল ও পােস্টারগুলাে ছাড়া অন্যত্র কম শহরেই এই দাবি, এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, যা জাতীয় জীবনের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে গুরুত্ব এখনাে অব্যাহত। কারণ এখনাে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় ও উচ্চ আদালতে বাংলার বদলে রাজভাষা ইংরেজিই সচল। ভাষা আন্দোলনের এই বিশেষ দাবিটি এখনাে অনর্জিত রয়ে গেছে।
সাপ্তাহিক সৈনিক-এর একটি সংবাদে প্রকাশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে স্কুল কলেজের ছাত্র এবং রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫-এ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করে জিন্নাহ ক্লাব প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় এ এম কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম। এ সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় (সৈনিক, ৯ মার্চ ১৯৫২)।
উল্লেখ্য, জামালপুর মহকুমার থানা ও ইউনিয়নগুলােতে অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলেও ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আশ্চর্য যে এখানে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয় ১৯৬৩-৬৪ সালে। পরে একাধিক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে প্রথমে ১৯৭২ সালে, পরে ১৯৭৭ সালে পৌরসভার উদ্যোগে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়। তবে ১৯৫৩ সাল থেকে ছাত্ররা নিয়মিত শহীদ দিবস পালন করেছে যথানিয়মে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক