ভাষা আন্দোলনে গােপালগঞ্জ
একুশে উপলক্ষে উত্তপ্ত জনপদ
ফরিদপুর জেলার মহকুমা শহর গােপালগঞ্জেরও রয়েছে রাজনৈতিক ঐতিহ্য। এবং তা বিভাগ-পূর্বকাল তথা মুসলিম লীগ রাজনীতির আমল থেকে। তবু রাজধানী ঢাকা থেকে যােগাযােগ ও যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় গােপালগঞ্জ কিছুটা দূর এলাকা হিসেবে বিবেচিত হতাে।
স্বভাবতই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন গােপালগঞ্জে সংগঠিত রূপে দেখা না দিলেও বিচ্ছিন্নভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা-সমাবেশ অনষ্ঠিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বিশেষ সূত্রমতে ‘মূল ভূমিকা পালন করতেন ডা, ফরিদ আহম্মেদ, শেখ আবদুল লতিফ, আমজেদ মিয়া, সেলিম মিয়া প্রমুখ’ (মাহবুব হােসেন, ভােরের কাগজ)।
গােপালগঞ্জের ভাষাবিষয়ক তৎপরতার মূল গায়েন যথারীতি স্থানীয় স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরা। পূর্বোক্ত সূত্রমতে এদের সমর্থন-সহযােগিতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ‘সহিদ আলী খান, রহমত জাহান সরদার, মােশাররফ হােসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার মােল্লা, ফজলুর রহমান, পরেশচন্দ্র বিশ্বাস, কমরেড ওলিউর রহমান, মাহবুব মিরাজ খান প্রমুখ।’
একুশে ফেব্রুয়ারির (১৯৫২) ভাষা আন্দোলন অবশ্য গোপালগঞ্জে বেশ সংগঠিতভাবেই শুরু হয়। সূচনা ঢাকায় ছাত্রহত্যার সংবাদে। গঠন করা হয় সংগ্রাম কমিটি। এর আহ্বায়ক গােপালগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাঈদ (মতান্তরে সহিদ) আলী খান, যুগ্ম আহ্বায়ক হেলেনা খান। এঁদের সঙ্গে ছিলেন আবদুল লতিফ, মুখলেসুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, জহুরুল হক, ইমান উদ্দিন, ফজলুর রহমান, আবুল হােসেন প্রমুখ।
কর্মসূচিতে ছিল যথারীতি ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা ইত্যাদি। মিছিলে যােগ দিয়েছেন শহরের ভাষা সমর্থক সুধী সমাজ এবং সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ। সক্রিয় সমর্থন ছিল শিক্ষকশ্রেণির একাংশের। অন্যান্য শহরের মতাে এখানেও পুলিশের হামলা চলে মিছিলে, গ্রেপ্তারও করা হয় একাধিক ভাষাসংগ্রামীকে।
আন্দোলন গােপালগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এর একটি সংবাদ প্রতিবেদন উল্লেখ করার মতাে। আন্দোলন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর বিস্তার ঘটে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। এবং ছড়িয়ে পড়ে শহরের বাইরের থানা এলাকায়ও। আজাদ- এর এক সংবাদে লেখা হয়েছে :
‘মকসুদপুর (গােপালগঞ্জ), ২৮শে ফেব্রুয়ারী- ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী স্থানীয় হাইস্কলের ছাত্রগণ শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন করে। প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর এক বিরাট শোক মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে করিতে বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। অতঃপর বেলা ৪ ঘটিকায় স্থানীয় স্কুল মাঠে এক বিরাট ছাত্র সভা হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ ও গুলী বর্ষণ সম্পর্কে বিশেষ তদন্ত দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (আজাদ, ৫ মার্চ ১৯৫২)।
আমরা আগেই বলেছি, গােপালগঞ্জে ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে ছিল শহরের শিক্ষিত শ্রেণির, পেশাজীবী শ্রেণিরও সমর্থন, অবশ্য সরকার সমর্থকেরা বাদে। দৈনিক আজাদ-এর একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গােপালগঞ্জের “উকিল বারের এক সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রতি সমর্থন, ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ ও তদন্ত কমিশন গঠন ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
গােপালগঞ্জে প্রথম অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫৪ সালে। স্বাধীনতার পর স্থায়ী শহীদ মিনার (আবু মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন)। ভিন্নমতে, ১৯৫৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম পাকা শহীদ মিনার তৈরি হয়। পরেশচন্দ্র বিশ্বাস, অ্যাডভােকেট নওশের আহমেদ, অ্যাডভােকেট সুনীলকুমার দাসের উদ্যোগে ও ব্যক্তিগত ব্যয়ে। এই লেখকের মতে, শহীদ মিনার নির্মাণের কারণে শিক্ষক পরেশচন্দ্রকে চাকরি খােয়াতে এবং কারাবরণ করতে হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির ধারাবাহিকতায় গােপালগঞ্জেও এই দিনটি ১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। দিনটির কর্মসূচিতে থেকেছে প্রতিবাদী সভা, সমাবেশ, বক্তৃতা ও মিছিল।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক