You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে নােয়াখালী ও মাইজদী
সন্নিহিত এলাকার সহযােগে আন্দোলনে গতি সঞ্চার

সাগরপারের জেলা নােয়াখালীর সদর এলাকা ভাঙতে ভাঙতে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে থাকে। ফলে নামে নােয়াখালী সদরের সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকাংশে সন্নিহিত মাইজদী শহরভিত্তিক হয়ে পড়ে। এর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকল্প হয়ে ওঠে যেমন নিকটবর্তী মাইজদী, তেমনি কিছুটা দূরবর্তী চৌমুহনীর মতাে শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যসমৃদ্ধ শহর এবং ওই শহরের রাজনীতি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও এ মূল্যায়ন।
নােয়াখালী সদরের প্রশাসনিক অস্তিত্ব ঠিক রেখেই রাজনৈতিক শিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রের পক্ষে পূর্বোক্ত উক্তিটি প্রযােজ্য। তাই নােয়াখালীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনায় একাধিক লেখক মাইজদী, চৌমুহনী এলাকার
পৃষ্ঠাঃ ৯৩ আন্দোলনের বিবরণ উল্লেখ করেছেন। নােয়াখালী এলাকার ভাষা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একুশের আন্দোলন। এ পর্বেই আন্দোলন সংগঠিতরূপে প্রকাশ পেয়েছে। দৈনিক আজাদ- এর ভাষা আন্দোলনবিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদনেও নােয়াখালী প্রসঙ্গে মাইজদী অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তাতে দেখা যায় :
‘২১-এ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে (মাইজদী) শহরে স্কুলের ছাত্রগণ হরতাল পালন করে। পাঁচ শতাধিক ছাত্র শােভাযাত্রা সহকারে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে এবং মাস্টার আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে কেরানী ব্যারাকের সম্মুখে এক বিরাট সভায় সমবেত হয়। সভায় সালাম কিবরিয়া ও এ কে এম শামসুদ্দিন বক্তৃতা প্রদান করেন। (আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। ২৩ ফেব্রুয়ারি মাইজদী হাইস্কুলে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়।
বলা বাহুল্য, মাইজদী শহরে এ আন্দোলন অব্যাহত ধারায় চলতে থাকে। ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এখানে ‘২৪শে ফেব্রুয়ারী হরতাল পালন করা হয় এবং জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র হত্যার নিন্দা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানাইয়া সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়। (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
মাইজদীর ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকায় ছিলেন সহিদ উদ্দিন, কামাল উদ্দিন আহমেদ, মৃত্যুঞ্জয় সরকার, আহসান উল্লাহ মােক্তার, মুন্সী জালাল আহমেদ, তারকনাথ প্রমুখ। উল্লেখ্য, হাতিয়ার মােস্তাকুর রহমান ও কামাল উদ্দিন আহমেদ গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন কারাভােগ করেন।… মার্চ মাসের গােড়ার দিকে শহরে প্রতীকী শহীদ মিনার নির্মাণ করে তাতে পুষ্পমাল্য প্রদান করা হয়।’ (মাহবুব হাসান, ভােরের কাগজ)।
নােয়াখালী সদরে সংঘটিত আন্দোলনের প্রভাবে ‘২৭শে ফেব্রুয়ারী নােয়াখালী বার এসােসিয়েশনের এক সভায় ঢাকায় ছাত্র-জনতার উপর গুলী বর্ষণের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।’ (আজাদ, ২ মার্চ ১৯৫২)। পরদিন স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল মাঠে মুসলিম লীগও এক পা পিছু হটে গুলিবর্ষণে সংশ্লিষ্ট ‘অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে’।
ভাষা আন্দোলনে চৌমুহনী গুরুত্ব অর্জন করে মূলত স্থানীয় কলেজছাত্রদের তৎপরতার কারণে। তারা ৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) চৌমুহনী বিদ্যামন্দিরসহ অন্যান্য স্কুলের ছাত্রদের সংগঠিত করে ধর্মঘট পালন করে। সেই সঙ্গে বিদ্যামন্দির ময়দানে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান ভূমিকা ছিল নােয়াখালী যুবলীগের আহ্বায়ক ফজলুল করিম (ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত), রইসউদ্দিন, ফজলুর রহমান প্রমুখের। সভাপতি স্থানীয় কলেজছাত্র আবদুল লতিফ। ছাত্রসভা একপর্যায়ে জনসভায় পরিণত হয়।
চৌমহনীতে একুশের ভাষা আন্দোলন জোরালাে হয়ে ওঠে ঢাকায় ছাত্র- জনতা হত্যার খবর পৌছানাের পর। শুরু হয়ে যায় ছাত্রধর্মঘট, মিছিল, শ্লোগান, সভা-সমাবেশ। এবার ছাত্রদের পাশাপাশি শহরের ভাষাসচেতন ব্যক্তিরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এবং চৌমুহনীর ব্যবসায়ীরা এ আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সমর্থন জানানাের অপরাধে তাদের পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়।
নােয়াখালীতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলন শুধু এর মহকুমা শহর বা প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রিক শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সােনাইমুড়ী, খিলপাড়া, পরত্রাম প্রভৃতি এলাকায় এবং এ আন্দোলনের সূচনা ঘটায় স্থানীয় স্কুলের ছাত্ররা। তাদের তৎপরতায় যুক্ত হয় স্থানীয় সমর্থন। সােনাইমুড়ীর ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারিতেই ক্লাস বর্জন করে মিছিলের আয়ােজন করার পর তাদের সমর্থনে হরতাল পালিত হয়, দোকানপাট বন্ধ থাকে। বিকেলে হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনসভা। সভাপতি মােহাম্মদ গােলাম কিবরিয়া ( আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
দৈনিক আজাদ- এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, খিলপাড়া, পরশুরাম প্রভৃতি স্থানেও ছাত্রদের উদ্যোগে যথাক্রমে ২২ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী মিছিল, সেই সঙ্গে জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। পরশুরামে বিরাট ছাত্র-জনতার মিছিল এবং সাধারণ হরতাল পালিত হয়। (আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ ১৯৫২)।
নােয়াখালীর ভাষা আন্দোলনে মেয়েরাও পিছিয়ে থাকেনি। তাদের অংশগ্রহণ যেমন ধর্মঘটে, ক্লাস বর্জনে, তেমনি মিছিলেও। এখানকার আন্দোলনে সর্বাত্মক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ফজলুল করিমের সঙ্গে পূর্বোক্ত তার দুই সহকর্মী, যারা প্রগতিবাদী রাজনীতির নেতৃস্থানীয় যুবকর্মী।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!