You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লা - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লা
আন্দোলনের নেপথ্যশক্তি ঐতিহ্যবাহী রাজনীতি

অবিভক্ত বঙ্গদেশের ত্রিপুরা জেলার সদর মহকুমা কুমিল্লা, বিভাগােত্তরকালে জলা শহরে উন্নীত। অন্য মহকুমা শহরগুলাে যথারীতি চাঁদপুর, বাগবাড়িয়া এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য কুমিল্লা রাজনীতিসচেতন শহর হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে খ্যাত। এখানে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি জাতীয়তাবাদী চেতনার কংগ্রেস। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি, ফরােয়ার্ড ব্লকসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এবং প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ। এখানে রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল এবং স্বনামখ্যাত ভিক্টোরিয়া কলেজ।
এমন একটি শহরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু থেকে তীব্র আবেগে দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি এখানেও ছিল বিহার অঞ্চল থেকে আসা অবাঙালি শরণার্থী তথা বিহারিরা। এমন একটি ভুল ধারণা আমাদের জনসমাজের একাংশে রয়েছে যে বাংলাদেশে আসা মােহাজেরদের শুধু রাজধানী ঢাকাতেই শহরতলি তৈরি করে মিরপুর, মােহাম্মদপুরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। বাস্তব সত্যটি ভিন্ন।
কেবল ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন পূর্ব পাকিস্তানি শহরগুলােতেই নয়, প্রদেশের অধিকাংশ শহরে অবাঙালি মােহাজেররা আশ্রয় নেয়, বসবাস শুরু করে বেশ দাপটের সঙ্গে। এরা একাধিক শ্রেণির। বিত্তবান, মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবর্গীয় এবং কারিগর ও শ্রমজীবী শ্রেণির। পাকিস্তান তাদের অর্জিত দেশ, হােক তা বঙ্গভূমি বা করাচি- এমন এক মনােভাব নিয়ে উর্দুভাষী মােহাজেরদের বসবাস বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে।
কুমিল্লা শহরে খ্যাতনামা আইনজীবী রাজনীতিবিদদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য কামিনীকুমার দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ এবং তাদের সহযাত্রী আইনজীবী-রাজনীতিক সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ। বিপ্লবী শান্তি সুনীতির স্মৃতিধন্য কুমিল্লা ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী যাত্রা শুরু করে প্রায় ঢাকার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের প্রথম দিক থেকে। কুমিল্লা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা মামুন সিদ্দিকী অবশ্য জানাচ্ছেন যে ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে ব্যবহারিক ভাষা গ্রহণের পক্ষে কুমিল্লার সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে কুমিল্লায়। তার ভাষায়: ‘ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে এক প্রতিবাদ সভা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে বক্তৃতা করেন দলিলুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ। সভার আয়ােজক কমিউনিষ্ট পার্টি। ছাত্র ফেডারেশন, ফরােয়ার্ড ব্লক ও মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের কিছু কর্মী ও সমর্থক।
এখানেই শেষ নয়। মার্চ মাসের শুরুতে বড়সড় ধরনের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় প্রধানত শহরের ছাত্র-যুবাদের উদ্যোগে টাউন হল মাঠে। সংগঠনগতভাবে এর পেছনে ছিল পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসােসিয়েশন। এ সমাবেশে বক্তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য অবিনাশ সাহা, জিয়াউল হক, রুহুল আমিন কায়সার, এ বি এম মূসা, শাহ আবদুল ওদুদ ও আমিনুল ইসলাম মজুমদার।
এরপর ঢাকা থেকে ঘােষিত ১১ মার্চের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার ছাত্র-যুবসমাজও আন্দোলনে মেতে ওঠে। এ উপলক্ষে টাউন হল মাঠে বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। এ সভায় সর্ব স্তরের নেতা-কর্মীদের তৎপরতা। তৎপরতা শুরু বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের। উল্লেখযােগ্য বামপন্থী ছাত্র-যুবনেতাদের মধ্যে ছিলেন চিত্ত বােস, সুখেন্দু চক্রবর্তী, ফয়েজ উল্লাহ প্রমুখ।
এ ধারা অব্যাহত থেকেছে ১৯৪৯-৫০ সালে উর্দু হরফে বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। ১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলনীতি কমিটির খসড়া প্রস্তাবে উর্দুকে পাকিস্তানের একক রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপারিশের বিরুদ্ধে ঢাকার রাজনৈতিক নেতারা রাজপথে নামেন মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ, গণআজাদী লীগ এবং ফজলুল হক সাহেবের মতাে নেতাদের উদ্যোগে। অবশ্য এ আন্দোলনে ছাত্র-যুবারাও অংশ নেয়।
কুমিল্লা একই ধারায় বিক্ষোভে তৎপর হয়ে ওঠে একাধিক রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে। তবে এ সময় সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কুমিষ্টা। সফরের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতাদের বিশেষভাবে তৎপর হতে দেখা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত নবীনগর থানার জহিরুল হক নীল মিয়া (যুক্তফ্রন্ট আমলের মন্ত্রী) এবং আবদুর রহমান খান।
এরপর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ১৯৫০-৫১ সময় পর্বের ধীরস্থির তৎপরতার মধ্য দিয়ে একুশের (১৯৫২) ডাকে বিস্ফোরণমুখী চরিত্র অর্জন করে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে একুশের আন্দোলন সফল করতে শহরের পথে ও মাঠে নামে। এ ডাকের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যায় কৃষকদের মধ্যেও। শহরের আশপাশের এলাকায়।
আর মূল শহরে ছাত্র-যুবাদের সমর্থনে এবার রাজনৈতিক শক্তিগুলো অনেক বেশি নির্ভয়, অনেকটাই তৎপর। আটচল্লিশি শাসকশ্রেণির পায়ের নিচের মাটি অনেকটা ক্ষয়ে গেছে গত চার বছরে তাদের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে। সরকারবিরােধী রাজনীতি অনেকখানেই শক্তি সঞ্চয় করেছে তুলনামূলক বিচারে। এ পরিস্থিতি প্রদেশজুড়ে। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণ ও পূর্বে তার বিস্তার-নেপথ্যে বাংলা ভাষার দাবি। ব্যতিক্রম নয় কুমিল্লা।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২. একটি বিস্ফোরক দিন- শহর ঢাকা থেকে দূর উত্তরে রাজশাহী, রংপুর, অন্যদিকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট হয়ে ময়মনসিংহ-বাদ নেই মধ্য অঞ্চলের শহরগুলাে, যেমন যশাের থেকে কুমিল্লা। লক্ষ্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার অর্জন।
পূর্বঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শহর কুমিল্লাতেও ছাত্র-যুবাদের আন্দোলন তৎপরতায় চঞ্চল। হরতাল, সভা-সমাবেশ, মিছিল স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এসব কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের। একদিকে শান্তিপূর্ণ হরতাল, অন্যদিকে মিছিলের শহর কুমিল্লা পােস্টার, ফেস্টুনে সজ্জিত। শহরের প্রতিটি সড়ক মিছিলের পদচারণে স্পন্দিত, স্লোগানে মুখর। জ্যেষ্ঠ থেকে কনিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী এখন মিছিলে, স্কুল থেকে কলেজের।
মুসলিম লীগ পত্রিকা দৈনিক আজাদ কৌশলগত কারণে এসব ঘটনার সংবাদ পরিবেশনে পিছিয়ে নেই, মূলত ঢাকার, অংশত প্রদেশের একাধিক শহরের। কুমিল্লার একুশে সম্পর্কে ২২ ফেব্রুয়ারি আজাদ-এর সংবাদ নিম্নরূপ :
‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতিদানের দাবীতে এখানে (কুমিল্লায়) শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়। এই উপলক্ষে সমস্ত স্কুলকলেজ বন্ধ থাকে। ছাত্রছাত্রীগণ শােভাযাত্রা করিয়া শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করে। শােভাযাত্রা মােহাজের কলােনীর পার্শ্ব দিয়া অগ্রসর হইবার কালে কলােনীর একদল উর্দুভাষী লােক লাঠি-ছােরা দ্বারা শােভাযাত্রীদিগকে আক্রমণ করে। ফলে পনেরাে জন ছাত্র আহত হয়।’
এমনই ছিল ঢাকার বাইরে একাধিক শহরে উর্দুভাষী মােহাজের তথা বিহারিদের স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য। বাংলার মাটিতে শরণার্থী হয়ে এসে বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণ। বলা বাহুল্য, এর পেছনে বরাবর দেখা গেছে সরকারি প্রশাসনের উসকানি। স্মরণযােগ্য যে এ সময় পূর্ববঙ্গীয় প্রশাসনেও উচ্চস্তরে উর্দুভাষী অবাঙালিদের প্রাধান্য।
মিছিলে হামলার খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিনা প্ররােচনায় হামলায় সবাই অবাক। প্রতিবাদে টাউন হল মাঠে লােক জমায়েত হতে থাকে। শহরে বিরাজম প্রবল উত্তাপ ও উত্তেজনায় জ্বালানি যােগ করে ঢাকা থেকে আসা তারবার্তা ছাত্র- জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হতাহতদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিয়ে। এ খবরে জনমনে নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ পড়ে।
এদিনই টাউন হল মাঠে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্বোক্ত আইনজীবী, রাজনীতিক জহিরুল হক। সভার বিবরণ দিয়ে দৈনিক আজাদ লেখে (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২):
‘সভায় পুলিশের বর্বরােচিত আচরণের তীব্র সমালােচনা করা হয়। সভায় নুরুল আমীন মন্ত্রীসভার পদত্যাগ, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, মােহাজেরদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হয়। মােহাজেরদের সামাজিক বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।’
এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উত্তপ্ত ২২ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল ঘটনাবহু সকাল থেকেই শহরবাসী মানুষ ঘরের বাইরে। সবার লক্ষ্য টাউন হল মাঠ। এখানে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার প্রতিবেদন পড়ে সবাইকে শােনানাে হয়। জনতা উত্তেজিত। বিকেলে জহিরুল হকের সভাপতিত্বে প্রতিবাদী জনসভা। সিদ্ধান্ত হয় শহরে লাগাতার হরতালের।
পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি যথারীতি কুমিল্লা শহরে সর্বাত্মক হরতাল। শিক্ষায়তনসহ যানবাহন, দোকানপাট, মায় সিনেমা হল পর্যন্ত বন্ধ ঘন অনেকটা শহর ঢাকার মতােই। টাউন হল প্রাঙ্গণে কয়েক হাজার মানুষের সমাবেশে সভাপতি যথারীতি জহিরুল হক। এখানকারও বিশদ সংবাদ পরিবেশন করে দৈনিক আজাদ(২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২):
‘কুমিল্লার ইতিহাসে এই ধরনের ধর্মঘট ও হরতালের কোন নজীর নাই। সকালে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ এক শােভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও জনপদ প্রদক্ষিণ করে। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান কলেজ শিক্ষক সমিতি সম্পাদক প্রফেসর আবুল খায়ের শহীদদের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
অধ্যাপক খায়ের শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস দেন। সভায় অধ্যাপক শওকত আলী, জনাব হাসান ইমাম, জনাব আবদুল গনি, আবুল হােসেন প্রমুখ তাদের বক্তব্যে ভাষার অধিকারসহ পুলিশি জুলুমের তীব্র নিন্দা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে মন্ত্রিসভার সদস্য তােফাজ্জল আলীর পদত্যাগ এবং চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ ও ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশির অপসারণের দাবি করা হয়।
কুমিল্লা শহরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মূলে ছিলেন রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ নেতৃত্ব। আগেই বলা হয়েছে এখানে কর্মতৎপর রাজনৈতিক দলগুলাের কথা। এরা সবাই নানাভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনাদৃষ্টে বলতে হয় এ আন্দোলনের সূচনা স্থানীয় ছাত্র-যুবাদের মাধ্যমে। রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের তৎপরতা ছিল আন্দোলনের প্রধান শক্তি। তাদের প্রতি সক্রিয় সমর্থন ছিল শিক্ষকসমাজের। বিশেষ করে উল্লেখযােগ্য ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক আবুল খায়ের ও আসহাব উদ্দিনের সক্রিয় ভূমিকা। শেষােক্তজনের বাসভবন হয়ে ওঠে আন্দোলন পরিচালনার অন্যতম প্রধান কার্যালয়।
শহরের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযােগ্য। এদের মধ্যে জেলা স্কুল ও ইউসুফ হাইস্কুলের ছিল অগ্রণী ভূমিকা (ভোরের কাগজ)। ছাত্র-যুবনেতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জিয়াউল হক, আলী আক্কাছ, এ কে এম জালাল উদ্দীন, আনােয়ার উল্লাহ, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম শহীদ, মােহাম্মদ শাজাহান, আমিরুল ইসলাম মজুমদার, বদরুল হুদা চৌধুরী, ওয়াজিউল্লাহ, আবদুল হক প্রমুখ। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতে হয় ইউসুফ হাইস্কুলের ছাত্রনেতা এ টি এম মেহেদীর বিশেষ ভূমিকার কথা।
ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। ছাত্র আন্দোলনে জনসমর্থন যুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলাের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ পর্যায়ে আরএসপির অফিসটিকে আন্দোলন পরিচালনায় ব্যবহার করা হতে থাকে পুলিশি হামলার আগ পর্যন্ত। এ সময় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন মােহাম্মদ আলাউদ্দিন, চিত্ত বসু, ফয়েজ উল্লাহ প্রমুখ নেতা।
কুমিল্লায় একুশের আন্দোলনে ব্যাপক জনসমর্থন সত্ত্বেও কিছু বিপরীতধর্মী অবাঞ্ছিত ঘটনাও ছিল বাস্তব সত্য। স্বনামখ্যাত প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে আন্দোলনে সাহায্যপ্রার্থী ছাত্র-যুবনেতারা নাকি তিরস্কৃত হয়েছিলেন। অথচ বিভাগ-পূর্বকালে উগ্রপন্থী এই নেতা ছিলেন ফরােয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠাতা সুভাষচন্দ্র বসুর সক্রিয় ডান হাত।
এ প্রসঙ্গে সংবাদপত্র প্রতিবেদক আরও লেখেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথম দিকে আন্দোলন সংগঠনে পুরােপুরি সক্রিয় ছিল না।
কমিউনিস্ট পার্টি, আরএসপিসহ বাম দলগুলাে যুবলীগ ব্যানারে অথবা বেনামে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। তার মতে, আন্দোলনের অন্যতম নেতা তৎকালীন আরএসপি ও পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কুমিল্লা জেলা সম্পাদক আমিরুল ইসলাম মজুমদারের মন্তব্য, ‘ভাষা আন্দোলন মূলত ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেই প্রথম গড়ে ওঠে। পরে ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে এবং আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চারিত হয়।’ এ মূল্যায়নে ভুল নেই। তার মতে, ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও আমাদের প্রধান অনুপ্রেরণা আর এ অনুপ্রেরণার গতিপথেই পরবর্তী সমাজ প্রগতির পথে এগোতে হবে।’
যেমন ঢাকায় কিংবা উত্তরবঙ্গের একাধিক শহরে বা অন্যত্র একুশের ভাষা আন্দোলনে ছাত্র-যুবাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ মানুষ, তেমনি একই ঘটনা কুমিল্লার ভাষা আন্দোলনেও ঘটে। হরতালের টানে অচল শহর, সব মানুষ টাউন হল প্রাঙ্গণে, নেতাদের কাছ থেকে কর্মসূচি শুনতে চায়, অন্যদিকে শহরের রাস্তাগুলাে জনশূন্য, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!
পিছিয়ে থাকেনি শহর-সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকসমাজ ও শ্রমজীবী শ্রেণি। তাই হরতাল সফল করতে তাদের ভূমিকা বয়ানে সংবাদ প্রতিবেদনের দীর্ঘ শিরােনাম, একুশের পর কুমিল্লার কৃষকেরা শহরের বাজারে চাল ডাল বেচা বন্ধ করে দেয়। শিশুখাদ্য হিসেবে শুধ দুধের সরবরাহ অব্যাহত ছিল। অন্যদিকে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কারও মনে পড়তে পারে ঢাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারির পর লাগাতার হরতাল স্থগিত করা হয় বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে দুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে।
হরতালের দিনগুলােতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সাধারণ মানুষ বা কৃষক ও শ্রমজীবীরা বাজারহাট বন্ধ করতে শুধু যে চাল-ডাল, সবজি, তরকারি বেচা বন্ধ করে দেয় নিজেদের আর্থিক অসুবিধা সত্তেও, তা-ই নয়, তারা আন্দোলন। চাল রাখতে অর্থ সাহায্যও করেছে ছাত্রদের কাঠ বা টিনের সিলকরা বারে টাকাপয়সা দিয়ে এবং তা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে। সরকারি কর্মচারীদের অনেকে গােপনে অর্থ সাহায্য করেছেন। মাতৃভাষা বাংলার জাতীয় পর্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় হওয়ার কারণে আন্দোলন সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করে প্রদেশের সর্বত্র।
একই কারণে কুমিল্লার ভাষা আন্দোলন শহরের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ ছিল। না। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের থানা ও ইউনিয়ন হয়ে গ্রামের স্কুলগুলোতে। আমরা জানি, এ আন্দোলন মূলত শিক্ষায়তনভিত্তিক ছাত্র আন্দোলন, পরে এর জনসংশ্লিষ্টতা।
তাই ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে কুমিল্লা শহরের আন্দোলনের প্রকাশ দেখা যায় দাউদকান্দি, কসবা, নবীনগর, রামচন্দ্রপুর প্রভৃতি থানার স্কুলগুলােতে। তাতে শক্ষার্থীদের পাশাপাশি জনসাধারণের সংশ্লিষ্টতাও ছিল। আজাদ পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদনে (২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) দেখা যায়, একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দাউদকান্দি হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট করে।
ছাত্র-জনতার এক মাইল দীর্ঘ বিরাট মিছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান তালে এলাকা মুখর করে জনগণের মধ্যে মাতৃভাষা চেতনার উদ্ভাস ঘটায়। মিছিল শেষে বিকেলে যথারীতি জনসভা। সেখানে বক্তৃতা রাষ্ট্রভাষা বাংলার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। একই ঘটনা বুড়িচং, বাঙ্গরা, মুরাদনগর, রামকৃষ্ণপুর প্রভৃতি থানা বা ইউনিয়ন বা গ্রামের স্কুলছাত্রদের উদ্যোগে একুশের প্রতিবাদ মিছিল ও জনসভা (মামুন সিদ্দিকী)।
কুমিল্লার তরুণ ছাত্রনেতা সৈয়দ আমিরুল ইসলাম শহীদ (বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি) কিছুকাল আগে আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁদের আন্দোলন কুমিল্লা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নিজেও যুবলীগের স্থানীয় নেতা হিসেবে নবীনগর থানা এবং আশপাশের কয়েকটি গ্রামে আন্দোলনের প্রসার ঘটাতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে বক্তৃতা করেছেন। উল্লেখ্য যে তার নানার বাড়ি নবীনগর থানার অধীন শ্যামগ্রাম ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামে।
ইতিপূর্বে আমরা প্রসঙ্গক্রমে প্রত্যন্ত এলাকা শ্যামগ্রাম হাইস্কুল ছাত্রদের একুশের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছি, যে আন্দোলন চলেছে শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে ১৯৫৩-৫৬ পর্যন্ত স্থানীয় ছাত্রদের উদ্যোগে। প্রসঙ্গত, শহীদ উল্লেখ করেছেন কুমিল্লার ভাষা আন্দোলনে যুবলীগের নেতা-কর্মীদের বিশেষ ভূমিকার কথা।
কুমিল্লায় আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে আবদুর রহমান খাঁ, আবদুল আজীজ, জিয়াউল হক, শাহ আলম, শামসুল আলম প্রমুখ এবং আইনজীবী সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ (পূর্বোক্ত ছাত্রনেতা শহীদের পিতা), আবদুল গণি, আশুতােষ সিংহ, অমূল্য কাঞ্চন দেব প্রমুখ ১৮ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
এমন এক দমননীতির মুখেও আন্দোলন চলে মার্চের প্রথমার্ধ অবধি।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক