ভাষা আন্দোলনে কুষ্টিয়া
বায়ান্নই আন্দোলনের প্রেরণা
কুষ্টিয়া বিভাগ-পূর্ব বঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা। দেশবিভাগের সূত্রে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কুষ্টিয়া স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহকুমা। যে কারণে হােক ১৯৪৮-এর মার্চের (১১) ভাষা আন্দোলন কুষ্টিয়ায় তেমন কোনাে আলােড়ন তােলেনি। ১৯৫১ সালের শেষ দিকে এ সম্বন্ধে সচেতনতার প্রকাশ ঘটে স্থানীয় জনাকয় রাজনৈতিক নেতা ও পেশাজীবী এবং নেতৃস্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের আলাপ-আলােচনা ও মতবিনিময়ে। সঙ্গে ছিলেন তমদুল মজলিস নেতারা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য অ্যাডভােকেট আবদুল হক, সৈয়দ আলতাফ আলী, ডা. আবুল কাশেম এবং স্থানীয় স্কুলের ছাত্রী শাহিদা খাতুন।
প্রকৃতপক্ষে কুষ্টিয়ায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি থেকে। পরিণামে ১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভাষাসচেতন ব্যক্তিদের উদ্যোগে কুষ্টিয়ায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির উদ্যোগে ভাষা আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সব শিক্ষায়তনে ধর্মঘট পালিত হয়। এদিনের অন্যতম কর্মতৎপরত ছাত্রছাত্রী ও বিশিষ্ট শহরবাসীর ভাষা-মিছিল এবং জনসভা।
ঢাকায় ছাত্র-জনতার হত্যার খবরে শহরের সর্বত্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণায় প্রতিটি শিক্ষায়তনে ধর্মঘট পালিত হয়। শহরের পথে পথে বিক্ষোভ মিছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শহরে সর্বাত্মক হরতাল, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব বন্ধ। স্কুলছাত্রী শাহিদা খাতুনের সভানেতৃত্বে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারি দমননীতির তীব্র সমালােচনা এবং শহীদদের শােকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
একই দিন হাইস্কুল মাঠে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কয়েক হাজার মানুষের সমাবেশ। সভাপতিত্ব করেন ডা. মােহাম্মদ কাশেম আলী। এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদন (১ মার্চ ১৯৫২) নিম্নরূপ :
‘২৩ ফেব্রুয়ারী- অদ্য স্থানীয় মােহাজেরীন এবং হিন্দু-মুসলমান প্রায় ২৫ হাজার লােকের সমবায়ে এক বিরাট সভা হয়। সভায় ডা. মােহাম্মদ কাছেম আলী সভাপতিত্ব করেন।… সভায় পুলিশী জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ এবং এই জুলুম সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ী কর্মচারীদের আদালতে প্রকাশ্য বিচার দাবী করা হয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান এবং শহীদানের আত্মীয়বর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিবার দাবি করিয়া আরও একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অপর একটি প্রস্তাবে বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করা হয়।’
এদিন কুষ্টিয়া বার অ্যাসােসিয়েশনের উদ্যোগে একটি জরুরি সভা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার সভাপতি জনাব মহসিন আলী সরকারি দমননীতির তীব্র নিন্দা করেন এবং তাঁর উত্থাপিত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিসহ একাধিক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
অন্যদিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে একটি শােকসভার আয়ােজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অ্যাডভােকেট আবদুল হক। এ সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, এই সভা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ফ্যাসিষ্টসুলভ দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে, এই শােচনীয় দুর্ঘটনার যথাযথ বেসরকারি তদন্তের ব্যবস্থা করা হউক। এই সভা আটক ছাত্রদের আশু মুক্তি দাবী করিতেছে।
মতান্তরে ভিন্ন সংবাদসূত্রে (সৈনিক, ৯ মার্চ ১৯৫২) এই সভা ২৪ ফেব্রুয়ারি মিউনিসিপ্যাল বাজারে আবদুল হক সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বিকেল ৪টায়। সভা-সমাবেশ শুরুর আগে বিশাল এক মিছিল শহরের রাস্তাগুলাে প্রদক্ষিণ করে। রাস্তার দুই ধারে দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার- তাতে রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ একাধিক দাবি লাল বর্ণমালায় লেখা। শহরে সেদিন যানবাহনসহ দোকানপাট, অফিস বন্ধ। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে হরতল, ধর্মঘট শহর অচল। এ সভায় পূর্বোক্ত প্রস্তাব ছাড়াও আরবি হরফে বাংলা লেখার সমালােচনা এবং পাকিস্তান অবজারভার-এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয়।
একুশের এই আন্দোলন শুধু কুষ্টিয়া শহরের ছাত্র-জনতাকেই অালোড়িত করেনি, জেলা সদরের অন্তর্গত সন্নিহিত এলাকাগুলােকেও গভীরভাবে স্পর্শ করে একই রকম আবেগে। চলে ধর্মঘট, প্রতিবাদী সভা-সমাবেশ মিছিল। উচ্চকণ্ঠ স্লোগানে দাবি জানানাে হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগত দাবিও। এককথায় একুশের আন্দোলন সমাজে সর্ববিস্তারী রূপ গ্রহণ করে।
কুষ্টিয়া শহরসংলগ্ন কুমারখালীতে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এবং সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বন্ধ থাকে হাটবাজার, দোকানপাট, পাঠশালা-স্কুল ও অফিস-আদালত। দৈনিক আজাদ পত্রিকার ভাষ্যমতে, (৩ মার্চ ১৯৫২) বিকেলে ছাত্রছাত্রী ও জনসাধারণের বিশাল এক মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। এরপর বিশাল এক জনসভা হয় স্থানীয় মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সভাপতি মােহাম্মদ গােলাম কিবরিয়া।
সভায় শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং অবিলম্বে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের দাবি জানিয়ে এবং সরকারি নীতির তীব্র নিন্দা করে বিভিন্নজন বক্তৃতা করেন। প্রতিটি সভা-সমাবেশে ও মিছিলে প্রধান দাবী অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা।
একই ধারায় দৈনিক আজাদ-এর অন্য একটি প্রতিবেদনে (৮ মার্চ ১৯৫২) প্রকাশ, কুষ্টিয়ার খােকসায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় ছত্রদের ব্যাপক আন্দোলনের শুরু। স্থানীয় উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিরাট এক মিছিল বের করে এলাকার রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করে। এ উপলক্ষে এলাকায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। হাটবাজার, দোকানপাট স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ থাকে।
বিকেলে স্কুল প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বিশাল এ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন রাজনীতিবিদ সৈয়দ আলতাফ আলী। সভায় বক্তারা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদী বক্তব্য রাখেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাস বলার স্বীকৃতি, ঢাকায় গুলিবর্ষণের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের প্রকাশ্য আদালতে বিচারের দাবি জানানো হয়। একইভাবে পোড়াদহ রেলওয়ে জংশন এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে প্রতিবাদ দিবস, হরতাল পালিত হয়। সেই সঙ্গে সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
এভাবে কুষ্টিয়া সদর এলাকা ও সন্নিহিত অঞ্চল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক