ভাষা আন্দোলনে খুলনা
বাধার মুখেও সক্রিয় আন্দোলন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বঙ্গোপসাগর স্পর্শ করা জেলা খুলনা। এর সদর শহর খুলনার অবস্থান বিভাজিত বঙ্গের পশ্চিমাংশের সীমান্তরেখায়। বিভাগ-পূর্বকালে শহরটি ছিল শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত প্রধান। ১৯৪৭-এর আগস্টে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উল্লিখিত সংখ্যাগুরুত্বের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। পূর্ববর্তী পর্যায়ে খুলনার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সংগঠন ছিল। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের ছাত্রসংগঠনগুলাে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ শহরে মুসলিম লীগ ও তাদের সরকার প্রশাসনের দাপট বাড়ে। প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে আবদুস সবুর খানের নেতত্বে। গণতন্ত্র, উদারপন্থী, জাতীয়তাবাদী বা সমাজতন্ত্রী রাজনীতি চাপের মুখে সচল থাকার চেষ্টা করতে থাকে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার জন্যও খুলনার কুখ্যাতি রটে। এ অবস্থার মধ্যেও শিক্ষায়তনভিত্তিক প্রগতিশীল ছাত্র-যুবরাজনীতি অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। সে ক্ষেত্রে দৌলতপুর বিএল কলেজের ছিল অগ্রণী ভূমিকা।
প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই খুলনায় দৌলতপুর কলেজকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির মূল ধারাটি ছিল প্রগতিশীল চরিত্রের। ঢাকার সঙ্গে খুলনার যােগাযােগব্যবস্থার সমস্যার কারণে ঢাকার কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযােগ রাখা সহজ ছিল না। তুলনায় কলকাতার মাধ্যমে খবর পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। ১৯৪৮-এর মার্চের আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বের তৎপরতা ছিল পাকিস্তান গণপরিষদে ব্যবহারিক বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হওয়ার প্রতিক্রিয়ায়। ঢাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে সে তৎপরতার শুরু। খুলনায় ২৭ মার্চ দৌলতপুর কলেজে সরকারবিরােধী ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা হয়। এতে বক্তৃতা করেন ধনঞ্জয় দাস, আমজাদ হােসেন, মনসুর আলী প্রমুখ ছাত্রনেতা। পরবর্তী পর্যায়ে ১১ মার্চের ঘােষিত আন্দোলন সফল করার উদ্দেশ্য নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে পূর্বোক্ত ছাত্রনেতৃত্ব।
খুলনার মুসলিম লীগ প্রাদেশিক স্তরে দুই ভাগে বিভক্তির অনুসরণে বিভাজিত ছিল। এ অবস্থায় ছাত্ররা এক গ্রুপের নেতা সবুর খানের সমর্থন চাইলে খান সাহেব কথা দিয়েও কথা রাখেননি। তবু ছাত্রদের আন্তরিক শ্রম ও তৎপরতায় পােস্টার সাঁটা, ইশতেহার বিলির মাধ্যমে প্রচারকাজ ভালােভাবেই সম্পন্ন হয়। এসব কাজে প্রধান ভূমিকা ছিল ছাত্র ফেডারেশনের নেতাদের। যেমন স্বদেশ বসু, ধনঞ্জয় দাস, সন্তোষ দাশগুপ্ত, আনােয়ার হােসেন প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের তাহমীদ উদ্দিন আহমেদ, জিল্লুর রহমান, আমজাদ হােসেন, মমিন উদ্দিন আহমদ প্রমুখ ছাত্রনেতা।
১১ মার্চের আন্দোলন খুলনায় যথাযথভাবেই চলেছে। ছাত্রধর্মঘট, মিছিল, স্লোগান এবং সবশেষে মিউনিসিপ্যাল পার্কে প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান। কিন্তু সরকারি প্রশাসন ও মুসলিম লীগের অপপ্রচার, হুমকি ইত্যাদি কারণে সভায় লােকসমাগম ছিল অল্প। অবশ্য খুলনা শহরের স্কুলছাত্ররা সেদিন দৌলতপুর কলেজ থেকে আসা মিছিলে যােগ দিতে দ্বিধা করেনি।
সম্ভবত আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন না পাওয়ার কারণে প্রশাসন কঠোর দমননীতির মাধ্যমে ছাত্রদের প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। অনেকাংশে সফলও হয়েছে। ১১ মার্চের সভা অনুষ্ঠানের পর গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্র ফেডারেশন নেতা আনােয়ার হােসেন এবং স্থানীয় স্কুলের ছাত্রনেতা মতিয়ার রহমানকে।
১১ মার্চের আন্দোলন জোরদারভাবে শেষ না হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনের দমননীতি বন্ধ হয়নি, বরং আরও কঠিন হয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল দৌলতপুর কলেজ এবং বামপন্থী ছাত্রনেতৃত্ব। তাই আন্দোলনের বেশ কিছুকাল পর গ্রেপ্তার করা হয় কমিউনিষ্ট ছাত্রনেতা সন্তোষ কুমার দাশগুপ্ত ও ধনঞ্জয় দাস প্রমুখ ছাত্রকে।
ভাষা আন্দোলন: ‘খুলনা ও বাগেরহাট জেলা’ গ্রন্থের লেখক ড. শেখ গাউস মিয়ার বিবরণে প্রকাশ, ঢাকায় জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতায় উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে দৃঢ় ঘােষণার প্রতিক্রিয়ায় খুলনায় ইতিপূর্বে স্তিমিত আন্দোলন নতুন করে জেগে ওঠে। পূর্বোক্ত ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে সংঘটিত হয় ধর্মঘট, মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনেকটা জোরালােভাবে। কিন্তু প্রশাসনের দমননীতি বাড়ে বৈ কমেনি। ব্যাপক গ্রেপ্তার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়। উল্লেখ্য, একমাত্র জেলা স্কুল আন্দোলন থেকে দূরে ছিল।
কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের আন্দোলন পর্বে। ইতিমধ্যে ছাত্র ফেডারেশনের ত্যাগী ছাত্রনেতাদের অনেকের দেশত্যাগ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারণে। এ ক’বছরে কলেজে প্রগতিশীল মুসলমান ছাত্রনেতৃত্বের উদ্ভব ঘটেছে পরিস্থিতির টানে। বেড়েছে ভাষাকে কেন্দ্র করে জনসমর্থনের মাত্রাও।
এবার নতুন পরিবেশ, নতুন ছাত্রনেতৃত্ব, তাতে মুসলিম প্রাধান্য। ঢাকার পূর্বঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলনের কর্মতৎপরতা শুরু খুলনাতেও। ছাত্ররা অনেক আত্মসচেতন, অনেক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে দৈনিক আজাদ-এর ছােট্ট খবর :
‘খুলনা, ২২শে ফেব্রুয়ারী।- গতকল্য (২১-এ ফেব্রুয়ারী) বৈকালে স্থানীয় পার্কে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে এক সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব মােহাম্মদ মান্নান।’
এ আন্দোলন গড়ে তুলতে স্থানীয় সাংসদ যেমন বিশেষ ভূমিকা , তেমনি ব্যক্তিপর্যায়ে একুশের কর্মসূচি সফল করতে এগিয়ে আপ কয়েকজন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য প্রধানত এম এ গফুর, তার সঙ্গে সমীর আহমদ, তােফাজ্জেল হােসেন, আবু মােহাম্মদ ফেরদৌস প্রমুখ। এ তৎপরতায় একুশের প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন হয়। ভাষাসংগ্রামী আবদুল হালিম এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন তার লেখা ভাষা আন্দোলনবিষয়ক পুস্তিকা এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায়।
শহরের অধিকাংশ স্কুলছাত্র একুশের আন্দোলনে অংশ নেয়। সক্রিয় ভূমিকা নেয় স্কুলছাত্রীরা। শহরে বেশ কিছু পােস্টার সাঁটা হয় দেয়ালে। টিনের চোঙা দিয়ে শুরু হয় প্রচারকাজ। এবং এসবই চলে প্রশাসনের হুমকি সত্ত্বেও।
বিস্ময়কর যে একশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) থেকে সারা দেশ যখন প্রতিবাদী আন্দোলনে উত্তাল, তখন প্রান্তিক শহর খুলনায় মূল আন্দোলন শুরু হয় ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার খবর পৌছানাের পর।
প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিক্রিয়ায় ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদী কর্মসূচি ব্যাপকভাবে শুরু হয়। শেখ গাউস মিয়া লিখেছেন, ‘২৩ তারিখ খুলনায় সফল ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে ছাত্রদের উদ্যোগে শহরে বিশাল মিছিল বের হয়। দৌলতপুর কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা এ মিছিলে অংশ নেয়। তারা সারা শহর প্রদক্ষিণ করে।… উল্লেখযােগ্য ছিল মেয়েদের মিছিল। সে যুগের পক্ষে এটা ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। মেয়েদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন মাজেদা আলী, আনােয়ারা বেগম প্রমুখ।’
এ সম্বন্ধে অচিন্ত্য বিশ্বাস লিখেছেন, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনায় শান্তিপূর্ণ সফল হরতাল পালিত হয়। ঐদিন বিকেলে মিউনিসিপ্যাল পার্কে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।’ সভাপতি এম এ গফুর। বক্তা আবু মাে. ফেরদৌস, আলতাফ খান প্রমুখ ( আজাদ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
এ বিষয়ে ১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ভােরের কাগজ-এর সংবাদদাতা শেখ আবু হাসান লিখেছেন, ‘এসপি মহিউদ্দিন বললেন কমিউনিস্ট ও হিন্দুরা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়!’ শুরুতে সর্বত্র এমন প্রচার ছিল সরকার ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে। এসব কারণে খুলনায় ১৯৪৮- এর আন্দোলনে তেমন সাড়া মেলেনি। তবে এম এ গফুর, এম এ বারী, তােফাজ্জেল হােসেন প্রমুখ এবং দৌলতপুর কলেজের সংগ্রামী ছাত্রদের চেষ্টায় বিলম্বে হলেও একুশের আন্দোলন সংঘটিত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী পর্যায় পর্যন্ত।
আর এবারও দৌলতপুর কলেজের প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা- যেমন খন্দকার আবদুল হাফিজ, জাহিদুল হক, মীজানুর রহিম, নুরুল ইসলাম প্রমুখ (শেষােক্ত দুজনের সঙ্গে লেখকের ঘনিষ্ঠতা ষাটের দশকের শুরুতে)। আরও পরে যুক্ত হন আবদুল হালিম ও সমীর আহমদ। অচিন্ত্য বিশ্বাসও উল্লিখিত নেতাদের প্রসঙ্গ টেনে পার্কের জনসভা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটাই ছিল খুলনার বৃহত্তর জনসভা।’ এসব বিবরণ ও ব্যক্তিগত যােগাযােগ থেকে বােঝা যায় খুলনার রাজনৈতিক পরিবেশের বাস্তবতা এবং দমননীতির প্রবলতা সম্পর্কে।
তবু ছাত্র হত্যা ও একুশের জাদুকরি টানে খুলনা এ পর্বে প্রাদেশের অন্যান্য শহরের আন্দোলনের সঙ্গে অনেকটা তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছিল। অনুরূপ ভূমিকা ছাত্রদের পাশাপাশি ছিল ছাত্রীদেরও। বিলম্বিত লয়ের কারণে খুলনায় ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি। আহ্বায়ক কর্মতৎপর এম এ গফুর। সদস্য পূর্বে উল্লেখিত ছাত্রনেতারা। ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আন্দোলন অনেক গতিশীল হয়ে ওঠে।
এ সময় প্রতিদিনই শহরে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, স্লোগান, সভা-সমাবেশ চলতে থাকে। এমনকি কিছুটা ব্যতিক্রমী হলেও ৫ মার্চের ঘোষিত ধর্মঘট তথা হরতাল যথাযথভাবে পালিত হয়। পার্কে জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের অনেককে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হতে দেখা যায়।
দূর প্রান্তিক শহর হওয়ার কারণে খুলনাবাসীর পক্ষে যেমন ঢাকার সংবাদি জানা সহজ ছিল না, তেমনি আজাদ-এর মতাে দৈনিকেও খুলনার ভাষা আন্দোলনবিষয়ক সংবাদ ছাপা হয়েছে দেরিতে ও স্বল্পায়তনে। এর মধ্যেও প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, আন্দোলন মূলত প্রকাশ পেয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ অবধি। তবে একটি বিষয় বিভিন্ন সূত্রে স্পষ্ট যে খুলনা শহরের পাশাপাশি বাগেরহাটে আন্দোলন ছিল অধিকতর মাত্রায়। তেমনি ফুলতলার মতাে এলাকাতেও।
পরবর্তী সময়ে খুলনার মুসলিম লীগ দলের একচ্ছত্র নেতা স্বৈরাচারী ও সম্প্রদায়বাদী সবুর খানের দাপটে খুলনার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্নমাত্রা অর্জন করে। এমনকি সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রেও। সবকিছু মিলে প্রথমে দৌলতপুর কলেজের অভ্যন্তরে শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৫৩ সালে শহীদ। দিবস পালন উপলক্ষে (শেখ গাউস মিয়া)।
ভাষাসংগ্রামী আবদুল হালিমের মতে, খুলনা শহরে বিভিন্ন সময়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হলেও তা স্থায়ী হয় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় ২৩ ফেব্রুয়ারিতে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক