You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহ
অগ্নিগর্ভ প্রায় সমগ্র জেলা

ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার যে কটি জেলা শহরে উল্লেখযােগ্য ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখা যায়, জেলা সদর ময়মনসিংহ তার একটি। এখানে মুসলিম লীগের প্রবল দাপটের মধ্যেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া।
ময়মনসিংহে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরেই শহরের বিপিন পার্কে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া। একে আন্দোলনের সূচনা বা সচেতনতা পর্ব বলা চলে।
রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার মতে, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সদ্য গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির নেতৃত্বে সেখানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন রফিকউদ্দিন ভূইয়া। ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবিতে পূর্বঘােষিত আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়, ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিল শেষে বিপিন পার্কে ছাত্র-জনসভা হয়। এতে স্থানীয় রেনেসাঁ সােসাইটির ভূমিকা ছিল।
এরপর ঢাকায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক ঘােষণার প্রতিবাদে ২৫ মার্চ আবারও বিপিন পার্কে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া। সভা শেষে মিছিল। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। মুসলিম লীগের পোষা গুন্ডারাও মিছিলে হামলা করে। আহত হন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির পূর্বঘােষিত আন্দোলনও একইভাবে এ ফেব্রুয়ারি সভা-সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে পালিত হয়। ঢাকায় ২৭ হত্যার সংবাদে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা ২২ ফেব্রুয়ারি রাস্তায় নেমে আসে। ইতিপূর্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ছিলেন আনন্দ মােহন কলেজের অধ্যাপক সৈয়দ বদরুদ্দিন হােসাইন ও সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া।
সভাগুলােতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ছাড়াও গুলিবর্ষণ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি, নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণদান এবং আটক ছাত্র-জনতার মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রতিটি মহকুমায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত ছিল সংগ্রাম কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত ও পরিচালনায় ময়মনসিংহ ও মহকুমাগুলােতে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি যথাযথভাবে পালিত হতে থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারি শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র সাধারণ হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বিপিন পার্কে সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচিও অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের উদ্যোগে ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা তৎপরতা চালায়। বিপিন পার্কে ঢাকার শহীদদের উদ্দেশে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এ পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ হয়ে ওঠে প্রবল প্রতিবাদী শহর। ২৪ ফেব্রুয়ারি রােববার ছুটির দিনেও শহরের পথে পথে মিছিল আর স্লোগান। শহরের সর্বত্র প্রতিবাদী পােস্টার আর কালাে ব্যাজ ও কালাে পতাকায় শহরটিকে যেন চেনা যায় না। শুধু দোকানপাটই নয়, হাটবাজারও বন্ধ, মানুষ তাতে প্রতিবাদ করছে না। ইতিপূর্বে ২৩ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটি ঘােষিত লাগাতার ছাত্রধর্মঘট ও হরতাল পালন অব্যাহত থাকে।
রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার ভাষ্যমতে, অবস্থার মােড় ঘােরাতে মুসলিম লীগ টাউন হলে জমকালাে এক সভার আয়ােজন করে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক জনতার ক্রুদ্ধ প্রতিবাদে উদ্যোক্তারা সভাস্থল ছেড়ে পালিয়ে যান। তাঁদের কয়েকজন নেতা-কর্মী বিক্ষুব্ধ জনতার মারধরের শিকার হন। জেলা শহরে সৃষ্ট আন্দোলনের আবেগ ও বেগ শহর থেকে দূরে মহকুমা থানা ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জে পৌছে যায়। গােটা ফেব্রুয়ারি মাস অবধি এ অবস্থা চলে। এর জের গড়ায় মার্চ মাস পর্যন্ত।
অচলাবস্থা কাটাতে প্রশাসন ব্যাপক গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা ও দমননীতির সিদ্ধান্ত নেয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি নাগাদ রফিকউদ্দিন ভূইয়াসহ সংগ্রাম কমিটির অধিকাংশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তা সত্ত্বেও আন্দোলন পুরােপুরি বন্ধ হয় না। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বিশেষ আক্রোশের কারণে রফিকউদ্দিন ভূইয়াকে দীর্ঘ সময় কারাযন্ত্রণা ভােগ করতে হয়।
ভাষা আন্দোলনে (১৯৫২) ময়মনসিংহ শহর সত্যিই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। মুসলিম লীগদলীয় সংবাদপত্র দৈনিক আজাদ-এর প্রতিবেদনেও তেমন প্রমাণ মেলে (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। তাতে বলা হয়:
‘মােমেনশাহীর ইতিহাসে এই ধরনের হরতাল ইহাই প্রথম। দোকানপাট, সিনেমা, খেলাধুলা, আমােদপ্রমােদ সবকিছু সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে এবং স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালতে সকাল হইতে ছাত্রছাত্রী, উকীল, মুখতার ও বাদী, বিবাদীগণ উপস্থিত হইতে বিরত থাকেন।
‘মফস্বল হইতে পায়ে হাঁটিয়া ও ট্রেনযােগে দলে দলে ছাত্র ও সাধারণ লােক শহরে আসিয়া পৌছে।…ছাত্রদের শােভাযাত্রায় “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “মন্ত্রীসভার পদত্যাগ চাই” প্রভৃতি ধ্বনি উথিত হয়। বৈকালে বিপিন পার্কে আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে ৩০ হাজার লােকের এক সভা হয়।
এ সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন সৈয়দ বদরুদ্দিন হােসাইন, রফিকউদ্দীন ভূঁইয়া, হাতেম আলী তালুকদার, আলতাফুদ্দীন তালুকদার ও শামসুল হক। ঢাকায় যখন প্রচণ্ড দমননীতির কারণে ২৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আন্দোলনে ক্রমে ভাটার টান লাগতে শুরু করে, তখন নিকটবর্তী জেলা শহর গণ- আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ।
আন্দোলনের বিস্তার জেলার সর্বত্র এতটাই যে ২২ ফেব্রুয়ারি ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাইস্কুলের (কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য স্কুল) ছাত্রদের উদ্যোগে পালিত হয় হরতাল, ঈদগাহ মাঠে শামসুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জনসভা।
একই ধারায় সরিষাবাড়ী, মির্জাপুর, নান্দিনা, চণ্ডীপাশা, লাউহাটি, হালুয়াঘাট, ফুলবাড়িয়া, দেওয়ানগঞ্জ, হাজরাবাড়ী, ঈশ্বরগঞ্জ, শ্রীবরদী, গফরগাও প্রভৃতি এলাকায় একই রকম আবেগে একুশের আন্দোলন ছাত্রজনতার উদ্যোগে সংঘটিত হয় ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত।
রাজধানী শহর ঢাকার বাইরে অনেক স্থানে ভাষা আন্দোলনের বার। সংগ্রামীদের শেষ জীবন কেটেছে অভাবিত দুর্দশায়। কেউ তাদের কোন খবর নেয়নি। এর অন্তত একটি উদাহরণ ময়মনসিংহের বীর ভাষাসংগ্রাম রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া।
১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ভােরের কাগজ-এর সাংবাদিক সারােয়ারুল আলম নােমান ভাষাসংগ্রামী রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ভাষা আন্দোলনের বীর সংগঠক রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া আজ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী। কথা বলতে পারেন না স্পষ্টভাবে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা হয়নি তার। এমন করুণ পরিণাম একাধিক ভাষাসংগ্রামীর। এমন আরেক উদাহরণ গাইবান্ধার ভাষাসংগ্রামী কার্জন আলী। এমন আরও কতজন কেউ তার হিসাব রাখেনি।
ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহের এমন ভূমিকা সত্ত্বেও সেখানে শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালনের প্রাক্কালে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা শহীদ মিনার ধ্বংস করার পর স্বাধীন স্বদেশে প্রথমে ছােটখাটো আকারে, পরে ১৯৮৮ সালে টাউন হল প্রাঙ্গণে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!