ভাষা আন্দোলনে ঢাকা
ইতিহাসে অবহেলিত গ্রামাঞ্চলের আন্দোলন
মোগল আমলের ঐতিহ্যবাহী প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ছােট শহর হলেও ইংরেজ আমলের জেলা হিসেবে ঢাকার বিস্তৃতি ও খ্যাতি যথেষ্ট। এ শহরের রাজনৈতিক গুরুত্বও যথেষ্ট, যেমন ঢাকা জেলার মহকুমা শহরগুলাের। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ জেলার মহকুমা শহর নারায়ণগঞ্জ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিচিত্র ঘটনাবহুল কেন্দ্রস্থল শহর ঢাকা। তাই আন্দোলনের ইতিহাসে ঢাকার ঘটনাবলি ব্যাপকভাবে উল্লিখিত। এ ক্ষেত্রে আমরা ঢাকাই আন্দোলনের সূত্রগুলােই শুধু উল্লেখ করব। গুরুত্ব পাবে ঢাকার দূর এলাকার ঘটনাবলি।
ঢাকায় ভাষাবিক্ষোভের তাত্ত্বিক রূপ দেখা দেয় ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাস পর থেকেই। এ ক্ষেত্রে তমদুন মজলিসের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর নেপথ্যে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কিছুটা প্রকাশ্যে তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশন এবং গণতান্ত্রিক যুবসমাজের উদ্যোগে ১৯৪৮-এ বহু উল্লেখিত মার্চের আন্দোলন সংগঠিত রূপ নিয়ে দেখা দেয় ১১ মার্চ থেকে, যা ১৫ মার্চের পর স্থগিত করা হয়।
এরপর মূলনীতি কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মূলত রাজনৈতিক নেতাদের চেষ্টায় ১৯৫০ সালে সভা, সমাবেশ ও মিছিল বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পায়। বছর কয়েকের প্রস্তুতির পর আসে একুশের বিস্ফোরক ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)। একুশে ফেব্রুয়ারির এ আন্দোলন দুটো ঘটনায় ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রথমত, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা এবং পুলিশের গুলিতে ছাত্রজনতার আত্মদান (২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি)। শেষােক্ত ঘটনার প্রভাবে গােটা প্রাদেশের শহর-গ্রাম আলােড়িত। এর মধ্যে তৃতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে এক রাতের শ্রমে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ও ঢাকা শহরের আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজসহ অন্যান্য কলেজ ও স্কুলগুলাের ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে এবং সাধারণ ছাত্রদের ব্যাপক কর্মতৎপরতায়। এ লড়াই চলে পুরাে ফেব্রুয়ারিসহ মার্চের প্রথম সপ্তাহ অবধি (৫ মার্চের নির্ধারিত হরতাল)।
ঢাকা জেলার মহকুমা শহরগুলাের বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকায়ও আন্দোলনের দাবদাহ লক্ষ করা গেছে, যার কিছু বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে সংবাদপত্রে। যদিও শহর ঢাকায় তখন পত্রিকার সংখ্যা হাতে গােনা। সেখানে প্রধান বাংলা দৈনিক আজাদ (সরকারদলীয় পত্রিকা)। তবু এতেই আন্দোলনের খবর তুলনামূলক বিচারে বেশি। ঢাকা জেলার তিন মহকুমা শহরের ভাষা আন্দোলনবিষয়ক বিবরণ পৃথকভাবে লেখা হয়েছে।
এর বাইরে ঢাকা জেলার বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকার পত্রিকানির্ভর বিবরণে দেখা যায় ভাষা আন্দোলনের তৎপরতা। এবং তা মূলত স্কুল এবং গুটিকয়েক কলেজভিত্তিক। যেমন ঢাকার নিকটবর্তী নবাবগঞ্জ, কলাকোপা, বান্দুরা, জয়পাড়া, গালিমপুর, চড়াইল, কালিয়াকৈর, বাঘাপুর, গৌরগঞ্জ প্রভৃতি প্রান্তিক এলাকার হাইস্কুল ও মাইনর স্কুলের ছাত্রসমাজ ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি তথা একুশের আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারা ক্লাস বর্জন করে ধর্মঘট, মিছিল ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকারি ভাষানীতি ও দমননীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছে ( আজাদ, ৫ মার্চ ১৯৫২)।
এগুলাের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছাত্রদের সূচিত আন্দোলনে জনসমর্থন মিলেছে সক্রিয়ভাবে। মিছিল-সভায় তারা অংশ নিয়েছে। কোথাও দীর্ঘ মিছিল এলাকা পরিভ্রমণ করেছে। কোথাও বিশাল জনসভা। এ তালিকায় আরও রয়েছে একাধিক ঘটনা- ‘মালী ইউনিয়নের স্কুলসমূহের চারশত ছাত্রের হরতাল, মিছিল ও প্রতিবাদ সভা ( আজাদ, ৪ মার্চ), ধামরাই, শিমুলিয়ায় ছাত্রমিছিল ও সভা ( আজাদ, ৪ মার্চ ১৯৫২)।
সাভারে ছাত্রদের মিছিল ও প্রতিবাদ সভাই শেষ কথা ছিল না। সাভার হাটে পালিত হয় পূর্ণ হরতাল। নিকটবর্তী কাশিমপুর কাছারি প্রাঙ্গণে বিরাট জনসভা। সভাপতি কবিরাজ ব্রমেন্দ্র কুমার গােস্বামী। সভার প্রস্তাবগুলাে পূর্বৎ (আজাদ, ৬ মার্চ ১৯৫২)। বারদী হাইস্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগেও বিরাট সভা এবং প্রস্তাব গ্রহণ (৬ মার্চ ১৯৫২), শিবপুর হাইস্কুলের ছাত্রদের আয়ােজিত বিরাট এক জনসভায় সভাপতিত্ব করেন মােহাম্মদ আলী। এখানকার দীর্ঘ ছাত্রমিছিলেও স্লোগান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’, ‘ছাত্রবন্দীদের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি।
মনােহরদী থানার হাতিরদিয়া বাজারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় (২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১৫ হাজার লােকের জমায়েত। সভাপতি ডা. মােজাফফর হােসেন। একই দিন হাতিরদিয়া, মনােহরদী, শিমুলিয়া, শিবপুরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সভায়ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং আরবি হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং প্রস্তাব গ্রহণ ( আজাদ, ৪ মার্চ ১৯৫২)।
ঢাকা জেলার অন্যতম বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র রিকাবীবাজারে (কমলাঘাট) ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিরাট এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আজাদ পত্রিকার ভাষ্যে বলা হয়, এই বন্দরে সর্বত্র পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। ডা. মাে. নূর হােসেন সভাপতিত্ব করেন। একটি প্রস্তাবে স্থানীয় এমএলএ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। ( আজাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
অন্য একটি খবরে প্রকাশ, জয়দেবপুরে রানী বিলাসমণি হাইস্কুলের ছাত্র এবং জনসাধারণের সমবায়ে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২)। এতে প্রকাশ পায় সরকারি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ (আজাদ, ১ মার্চ ১৯৫২)।
ছাত্রদের এই প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রবণতা থেকেই বুঝতে পারা যায় সারা দেশে গ্রামাঞ্চলেও একুশের প্রতিবাদ আন্দোলন কীভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। তাদের সঙ্গে পুরাে জনসমর্থন এক অভাবিত ঘটনা।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক