You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনে রংপুর - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনে রংপুর
নবীন-প্রবীণে গণ-আন্দোলন

ভাষা আন্দোলনের সলতেয় আগুন ধরানাের কাজ শুরু করেছিল নানা বয়সী ছাত্রসমাজ। তাই স্বভাবতই শিক্ষায়তনগুলাে হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। রংপুরই-বা ব্যতিক্রম হবে কেন? রংপুরের স্কুল-কলেজ এদিক থেকে তাদের ভাষিক দায় পালন করে ১৯৪৮ সালের মার্চে প্রতিবাদ- বিক্ষোভের সূচনা ঘটিয়ে। ধর্মঘট, সভা, সমাবেশ, মিছিল, পােস্টারিংয়ের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের প্রকাশ। আর কারমাইকেল কলেজ হয়ে ওঠে রংপরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। যেমন ১৯৪৮ সালের মার্চে, তেমনই ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
দেশভাগের পরবর্তী কয়েক বছর পূর্ববঙ্গের প্রশাসনে ও শিক্ষায়তনের উচ্চ স্তরে ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। উর্দুভাষী অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এবং তাঁদের সহযােগী রক্ষণশীল বাঙালি শিক্ষকদের দেখা গেছে ভাষা আন্দোলনে বাধা দিতে। রংপুর কারমাইকেল কলেজের অবাঙালি অধ্যক্ষ সৈয়দ শাহাবউদ্দিনের এ বিষয়ে ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা। নােটিশ, হুমকি, বহিষ্কার ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে চলেছে আন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা।
এ-জাতীয় চেষ্টায় ১৯৪৮ সালের আন্দোলনে ক্ষেত্রবিশেষে সাফল্য সত্ত্বেও সর্বত্র তা মেলেনি, আর ১৯৫২ সালে তাে নয়ই। ভাষা আন্দোলনে এ-জাতীয় ঘটনার নজির রয়েছে প্রদেশজুড়ে। রংপুরেও তাই কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ এ ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। ঘটনাক্রমে আন্দোলন উপলক্ষে প্রথম বহিষ্কার-আদেশের আঘাতটা পড়ে কলেজছাত্র ভাষাসংগ্রামী নুরুল ইসলামের মাথায়। এরপর তাে ব্যাপক হারে ধরপাকড়।
১৯৪৮-এর ধারাবাহিকতায় বিশেষ উপলক্ষে মাঝেমধ্যেই কলেজছাত্রদের উদ্যোগে সংঘটিত হয়েছে প্রতিবাদ সভা, মিছিল, কখনাে শিক্ষায়তনিক ধর্মঘট বা হরতাল। ‘৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পূর্বঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ধর্মঘট এবং প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেই সঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট তথা হরতাল, মিছিল। তবে ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণে আন্দোলনরত ছাত্রজনতার হতাহত হওয়ার ঘটনা রংপুরেও তীব্র ও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যেমন দেখা গেছে প্রদেশের অন্যত্র।
পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভা শেষে ছাত্র-জনতার ক্ষুব্ধ মিছিলের শহর পরিক্রমা। স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘সংগ্রাম চলছে, চলবে, ইত্যাদি। পুলিশের লাঠিচার্জ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি ছাত্র- জনতার অদম্য দৃঢ়তার কারণে। এই প্রতিবাদী কর্মসূচি অব্যাহত থাকে পরবর্তী দিনগুলােতে এবং তা ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন থানা এলাকায় শিক্ষায়তনগুলােকে কেন্দ্র করে।
ইতিমধ্যে পুলিশ কারমাইকেল কলেজের একজন অধ্যাপকসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করে। প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জোরেশােরে, স্পর্শ করে জনসাধারণকে। শহরের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিশাল জনসভা হয়। এতে বিশেষ ভূমিকা রাখে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলাে। দাবি ওঠে আটক বন্দীদের মুক্তি, মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। পিছিয়ে থাকেনি মহিলাদের একাংশ। মার্চের প্রথম সপ্তাহ অতিক্রম করে আন্দোলন, যদিও ঢাকায় আন্দোলন ইতিমধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
রংপুরে ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বিশেষ করে কারমাইকেল কলেজকে কেন্দ্র করে, তাদের অনেকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য মতিউর রহমান, আজিজুর রহমান, সুফী মােতাহার হােসেন, তােফাজ্জল হােসেন শাহ প্রধান, শাহ আবদুর রাজ্জাক, শামসুল হুদা, শাহ আবদুল বারী প্রমুখ। এ আন্দোলনে আরও যারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য দবিরউদ্দিন, খয়রাত হােসেন, কাজী মােহাম্মদ এহিয়া, ইদ্রিস লােহানি, ইউনুস লােহানি, আজিজুল হক প্রমুখ।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবু হােসেন সরকারের সমর্থনও লক্ষ করার মতাে ছিল। রংপুরের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এতে বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয় সমর্থন- যেমন মণিকৃষ্ণ সেন, জিতেন্দ্রনাথ দত্ত, শংকর বসু, শিবেন মুখােপাধ্যায়, দারাজউদ্দিন মণ্ডল, ময়েরউদ্দিন প্রমুখ। ছিলেন মিলি চৌধুরী, শাহ তবিবুর রহমানসহ আরও অনেকে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আবুল হােসেন।
রংপুরে ভাষা আন্দোলন যথারীতি ছাত্র আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও এর দৃঢ় জনসংশ্লিষ্টতা প্রদেশের একাধিক শহরের তুলনায় বেশি। এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় ‘৫২-পরবর্তী শহীদ দিবস উদ্যাপনে, বিশেষভাবে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছাত্রসংগঠন, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা প্রকাশ পায় একুশে উদযাপন কমিটি গঠনের মাধ্যমে।
রংপুর জেলার মহকুমা শহরগুলােতেই ভাষা আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল না। একুশের (১৯৫২) আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে।
যেমন পীরগঞ্জ, নলডাঙ্গা, লক্ষ্মীপুর, ধলগাছ, পাটগ্রাম, হালবাড়ি হারাগাছা প্রভৃতি এলাকার শিক্ষায়তন, বিশেষ করে স্কুলগুলােকে কেন্দ্র করে একুশের ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে- এ খবর জানাচ্ছে দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক সৈনিক প্ৰভৃতি পত্রিকা। এসব দূর অঞ্চলেও দেখা গেছে ছাত্রদের সমর্থনে জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতা।
১৯৫২-এর ২২ ফেব্রুয়ারি সৈনিক পত্রিকায় পাঠানাে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গতকল্য পীরগঞ্জ হাইস্কুল এবং বাজারে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ওই দিন স্থানীয় হাইস্কুল এবং দোকানপাট সমস্ত বন্ধ থাকে। বেলা ১১টায় ছাত্র ও জনসাধারণের মিলিত একটি শােভাযাত্রা বিভিন্ন ধ্বনিসহকারে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না করা পর্যন্ত ছাত্র ও জনসাধারণকে অবিরাম সংগ্রাম চালাইয়া যাইবার আহ্বান জানানাে হয়।’
ধলগাছেও একই রকম ঘটনা ঘটে। ‘সৈয়দপুর থানার অন্তর্গত ধলগাছ দিয়াবুল্লাহ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় মােহাম্মদ ইউনুছ আলী সভাপতিত্ব করেন। সভায় পুলিশী জুলুমের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শান্তি বিধানের দাবী এবং বর্তমান মন্ত্রীসভার প্রতি অনাস্থা জানাইয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।’ (অজাদ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
দৈনিক আজাদ- এর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘২৭ ফেব্রুয়ারি পাটগ্রাম হাইস্কুল ও বালিকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীগণ শােভাযাত্রা বাহির করে এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “গুলী বর্ষণের তদন্ত চাই” ও “আটক ছাত্রদের মুক্তি চাই” ধ্বনিসহকারে বন্দরের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে। সমস্ত দিন বন্দরে হরতাল পালিত হয়। অপরাহূ ৪ ঘটিকায় স্থানীয় হাইস্কুল প্রাঙ্গণে পাটগ্রাম বড় মসজিদের পেশ ইমাম সাহেবের সভাপতিত্বে এ সভা হয়।’ এ ধরনের ঘটনা থেকে প্রমাণ মেলে একুশের আন্দোলন কতটা সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করেছিল।
সংবাদপত্রগুলাের বিশদ বিবরণে দেখা যায় শুধু জেলা রংপুরই নয়, প্রদেশের প্রতিটি জেলার দূর গ্রামেগঞ্জেও একুশের (১৯৫২) ভাষা আন্দোলন ছাত্র ও জনসাধারণকে প্রতিবাদে মুখর করে তুলেছিল। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ও অনাস্থা প্রকাশ পায় ছােট-বড় প্রতিটি সভায় উচ্চচারিত বক্তব্যে, প্রস্তাব গ্রহণে, সর্বোপরি মিছিলের স্লোগানে।
রংপুরে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ২০ ফেব্রুয়ারিতে এক রাতের শ্রমে। স্থান পাবলিক লাইব্রেরি ময়দান। আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সবাই শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইট-বালু-কাদামাটি দিয়ে তৈরি ছোটখাটো শহীদ মিনারটি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা ভেঙে ফেলে। স্বাধীনতার পর নতুন করে শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়, এখনাে তা বর্তমান।

সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক