ভাষা আন্দোলনে বগুড়া
তখন মিছিলের শহর
ভৌগােলিক বিবেচনায় উত্তরবঙ্গের মধ্যমণি বগুড়া। ভাষা আন্দোলনেও শহর বগুড়ার তেমনই ভূমিকা। এর প্রধান কারণ বগুড়ার আযিযুল হক কলেজের (বর্তমান নাম আজিজুল হক কলেজ) ছাত্র-শিক্ষকদের ভূমিকা এবং প্রগতিবাদী ও ইসলামপন্থী- দুই ধারার রাজনৈতিক সচেতনতা ও তৎপরতা। সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বগুড়ার ছিল বিশেষ অবস্থান। ছিল শ্রমিকশ্রেণির সচেতন উপস্থিতি। বগুড়ায় ভাষা আন্দোলন শুরু থেকেই বেশ জমজমাট রূপ ধারণ করে।
তাই ১৯৪৮ সাল থেকেই বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় তবে জোরেশােরেই। এতে আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছিল প্রেরণাদায়ক ভূমিকা। ওই কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের কেন্দ্র করে বগুড়ার ভাষা আন্দোলন সর্বজনীন চরিত্র অর্জন করে। তবে বামধারার রাজনীতিরও ছিল উল্লেখযােগ্য ভূমিকা।
বগুড়ার আন্দোলন সম্পর্কে আবুল হােসেন খােকনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সূচনালগ্নে ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে “ছাত্র ফেডারেশন”-এর উদ্যোগে এবং কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রচ্ছায়ায় বগুড়া আযিযুল হক কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ফেডারেশন নেতা ও সাহিত্যকর্মী আবদুল মতীন (ভাষামতিন নন)। মিছিল সড়কপথ ধরে বগুটা শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় পৌছালে মুসলিম লীগের নেতা ও সমর্থকেরা হামলা চালায়।’
অন্য প্রতিবেদক মিলন রহমানের ভাষ্যেও একই ঘটনাচিত্র দেখা যায়। তার মতে, লীগশাহির গুন্ডাদের আক্রমণে বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক আহত হন। যেমন ছাত্রনেতা আবদুস শহীদ, আবদুল মতীন, সালেহা বেগম প্রমুখ। আন্দোলনে নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন মােখলেছুর বহমান। ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ঢাকা থেকে ঘােষিত কর্মসূচি মাফিক বগুড়ায়ও আযিযুল হক কলেজ থেকে ছাত্রমিছিল শহরে বেরিয়ে এলে তাতে যােগ দেয় সাধারণ মানুষ। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন অধ্যক্ষ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
একই বছরের নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বগুড়া সফর উপলক্ষে ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ সংঘটিত হয়। তাতে নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা গােলাম রহমানসহ একাধিক ছাত্র যেমন আবুল ফজল সিদ্দিকী, নুর মােহাম্মদ খান প্রমুখ। এ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক কলেজছাত্র আতাউর রহমান (কবি হিসেবে খ্যাত), আবদুল মতীন, গাজীউল হক, অধ্যক্ষ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক গােলাম রসুল, অধ্যাপক আবুল খায়ের প্রমুখ। উল্লেখ্য যে এ আন্দোলন পরবর্তী বছরেও হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনের তৎপরতায়।
আটচল্লিশের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা নিয়ে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ব্যাপকতা ও তীব্রতা অর্জন করে। এ উপলক্ষে ১২ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় এডওয়ার্ড পার্কে এক বিশাল জনসভা হয়। ছাত্রনেতাদের সবাই এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। ১৭ ফেব্রুয়ারির এক বৈঠকে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি। এর সভাপতি রাজনীতিবিদ মজিরউদ্দিন আহমেদ, সহসভাপতি কৃষক নেতা আবদুল আজীজ কবিরাজ, আহ্বায়ক ছাত্রনেতা গােলাম মহিউদ্দিন এবং সদস্যদের মধ্যে বিশিষ্টজন শেখ হারুনুর রশীদ, জমিরউদ্দিন মণ্ডল, ছাত্রনেতা আবদুস শহীদ, শ্রমিকনেতা সুবােধ লাহিড়ী, মােখলেছুর রহমান প্রমুখ।
মােখলেছুর রহমানের মতে, ‘এডওয়ার্ড পার্কের জনসভার পরই বগুডার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে’। বলা বাহুল্য, এতে বিশেষ ভূমিকা ছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের। ‘বগুড়া হয়ে ওঠে মিছিলের শহর’। একুশের দিন কয়েক আগে থেকে সংগ্রাম কমিটির ডাকে জেলা স্কুল ময়দানে বিশাল ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবদুল আজীজ কবিরাজ। আহ্বান জানানাে হয় প্রতিটি থানায় সংগ্রাম কমিটির গঠনের।
একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্বঘােষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বগুড়ায় হরতাল পালিত হয়। সেই সঙ্গে সভা, মিছিল ও স্লোগান- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অবস্থা ভিন্ন দিকে মােড় নেয় ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের সংবাদে। সরকারবিরােধী বিক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। হরতাল শেষে অনুষ্ঠিত জনসভায় গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য বগুড়ায় সব শিক্ষায়তন বন্ধ ঘােষণা।’
এখানেই শেষ নয়। পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারিও হরতাল চলে; যানবাহন, দোকানপাট, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। ভাষা-বিক্ষোভ ও আন্দোলন জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। শেরপুর, সান্তাহার, রাজারামপুর পার হয়ে আন্দোলন গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করে, মূলত বিদ্যালয়গুলােকে কেন্দ্র করে।
বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের পূর্বোক্ত ঘটনাবলির সমর্থন মেলে দৈনিক আজাদ-এর কিছু সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে। যেমন :
‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কর্মপরিষদের আহ্বানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ২১শে ফেব্রুয়ারী এখানে (বগুড়ায়) পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। ছাত্র ও জনসাধারণের সম্মিলিত এক বিরাট শােভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে ও “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” প্রভৃতি ধ্বনি করিতে থাকে।
‘বৈকালে স্থানীয় আলতাফুন্নেছা ময়দানে এক জনসভা হয়।…সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবী করা হয়।
‘আগামী মঙ্গলবার সমগ্র শহরে পূর্ণ ধর্মঘট ও হরতাল পালনের প্রস্তাবও সভায় গৃহীত হয়।’ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২)-এর তৎপরতা সম্পর্কে অজাদ-এ ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে লেখা হয়, এইখানে (বগুড়ায়) জগন্নাথ যাতে এক বিরাট ছাত্র সভা হয়।… প্রায় দশ হাজার লােক সভায় যােগদান করে। বগুড়া শহরে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। স্কুল ও দোকানপাট বন্ধ থাকে। বেলা একটায় বিরাট শােভাযাত্রা শহরের প্রধান রাস্তাসমূহ প্রদক্ষিণ করিয়া সভাস্থলে সমবেত হয়। (আজাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)।
তৎকালে মহকুমাহীন জেলা শহর বগুড়ার বিভিন্ন থানা ও দূর এলাকায় ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যেমন পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, জয়পুরহাট, সান্তাহার, রাজারামপুর, শেরপুর থেকে তিলকপুরসহ ( আজাদ প্রতিবেদন)
পৃষ্ঠাঃ ১৭০ গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, মূলত গ্রামের স্কুলগুলােতে।
কিন্তু আশ্চর্য যে আন্দোলনের এতটা ব্যাপকতা ও তীব্রতা সত্ত্বেও বগুড়ায় শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৫৩ সালে স্থানীয় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে। এরপর নির্মিত দুটো শহীদ মিনারের একটি এডওয়ার্ড পার্কে, অন্যটি সাতমাথায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এগুলাে ভেঙে ফেলে। এরপর জনদাবি সত্ত্বেও শহীদ মিনার তৈরি হয় ১৯৮২ সালে শহীদ খােকন পার্কে। এ ধরনের স্ববিরােধিতা বিরল ঘটনা। তবু উত্তরবঙ্গের ভাষা আন্দোলনের পর্যালােচনায় বগুড়া একটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক