ময়মনসিংহ পাক-অধিকৃত এলাকা দখলের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম
শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার নিহতঃ দারােগা ও দালালদের আত্মসমর্পণ
(বিশেষ সংবাদদাতা)
বাঙলাদেশ সীমান্ত থেকে, ১৮ অক্টোবর- বাঙলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ময়মনসিংহে পাকঅধিকৃত এলাকা দখলের জন্য বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে মুক্তিবাহিনীর এক দুদ্ধর্ষ ও বিরামহীন সংগ্রাম করে চলেছে।
ইয়াহিয়ার ভাড়াটে হানাদারদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের বহু ঘাঁটি, থানা ও শক্রর চলাচল ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে পাক অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন অংশে মুক্তিবাহিনী ও পাকহানাদারদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়— দারােগা, পুলিশ, আনসার, রাজাকার প্রভৃতির দালালেরা আত্মসমর্পণ করে বহু অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ ও সরকারী তহবিলের টাকা মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।
এই লড়াই এ মুক্তিযোেদ্ধাদের কয়েকজন শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। এই বীর শহীদদের মধ্যে রয়েছেন: নুরুজ্জামান, জামাল উদ্দিন, ইয়ার মামুদ, ভবেশদাস, ফজলুল হক, ডা: আজিজুল হক, দ্বিজেন্দ্র বিশ্বাস, আবুল হােসেন, আবদুল আজিজ, পরিমল দে, রিয়াজ উদ্দিন আবদুল সালাম ও আবদুল হাকিম মােল্লা।
মুক্তিবাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ নেতা তারা মিঞা আহত হন। তারা মিঞার নেতৃত্বে একটি বিশেষ এলাকায় বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালিত হয়।
তারা মিঞার নেতৃত্বে ৭০ জন মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বাহিনী লাইট মেসিনগান, রাইফেল ও গ্রেনেডসহ ময়মনসিংহের পূর্বে নেত্রকোনায় ঠাকুর কোনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দেয়। ফলে শত্রুসৈন্য ও দালালদের চলাচল ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
মুক্তিযােদ্ধারা কৈরাইলে একদল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে ঘিরে ফেলে এবং দারােগা, পুলিশ, আনসার, এডজুট্যান্টসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের ৬টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।
ঐ দিনই সন্ধ্যার প্রাক্কালে উপরােক্ত মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি তাদের গােপন অবস্থান থেকে পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। পাকসেনারা যে মুহূর্তে টহল দিতে শুরু করে তখনই মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ১৭ জন পাকসেনাকে খতম করে দেয়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত শত্রুদের শক্ত ঘাঁটি লমাকান্দা থানা ঘেরাও করে। থানার ১১টি রাইফেল, ১ হাজার টাকা মূল্যের ওষুধপত্র এবং নগদ ১ হাজার ৬৫ টাকা মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এই থানা দখলের সংগ্রামে ৫ জন রাজাকার নিহত হয় এবং থানার সহকারী দারােগা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিবাহিনী থানা দখলের পর যখন নাজিরপুরের পথে অগ্রসর হয় তখন টহলদারী পাকসেনাদের একটি দলের সম্মুখীন হয়। উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। এই অতর্কিত আক্রমণের মুখে পাকসেনারা বেসামাল হয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষে একজন মেজরসহ ১৭ জন শত্রুসৈন্য ও দালাল খতম হয়।
উল্লেখযােগ্য যে, পাকসেনারা উপরােক্ত কমলাকান্দা থানা দখল করে নেয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা স্কোয়াড চারদিক থেকে কলমাকান্দা থানা লক্ষ্য করে গােলা ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। ফলে ১ জন কর্নেলসহ ৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। সেদিন জয়ে উল্লাসে মুক্তিযোেদ্ধারা নাজিরপুরে পাকসেনাদের ঘাটির দিকে অগ্রসর হয় এবং অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ১৯ জন পাক সেনা খতম হয়।
ময়মনসিংহের এই গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পাকসেনারা প্রচণ্ডভাবে মার খেয়ে পালিয়ে যায় এবং পরে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করে পুনরায় মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাটিতে আক্রমণ করে। উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৪ জন পাকসেনা প্রাণ হারায়। এদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের নেতা তারামিঞা আহত হন। এবং নুরুজ্জামান, জামালউদ্দিন, ভবেশ দাস, ইয়র মামুদ, দ্বিজেন্দ্র বিশ্বাস, ফজলুল হক ও ডা: আজিজুর হক শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।
মুক্তিবাহিনী কেন্দুয়া থানা আক্রমণ করে রাইফেল সহ ১২ জন অফিসারকে গ্রেপ্তার করে। থানা তহবিলের ২ হাজার ৫শ’ ৪৫ টাকা মুক্তিযোেদ্ধাদের হস্তগত হয়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলার বিখ্যাত আটপাড়া থানা আক্রমণ করে। থানার দারােগা আত্মসমর্পণ করে। এই এলাকার স্থানীয় জনসাধারণের সহযােগিতায় গেরিলারা ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করে এবং থানা থেকে ১৭টি রাইফেল নিয়ে যায়।
পাকসেনারাও গােপনে অবস্থান করে ও অকর্তিত আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনীকে খতম করার কৌশল গ্রহণ করেছে। এবং এই উদ্দেশ্যই পাকসেনারা রামপুর বাজারে ওৎ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের এই গােপন অবস্থানের সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এক অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করে। এই আক্রমণে ৭ জন পাকসেনাসহ ১৬ জন রাজাকার দালাল খতম হয়।
বিখ্যাত টংক এলাকা লেজুরার রামপুর, গৌরীপুর এবং রাজনগরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর গােপন ঘাটি থেকে যাতে পাকসেনাদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র সেলুরা বাজারে কোনাে আক্রমণ না হতে পারে, সেজন্য আগে থেকে পাকসেনা মুক্তিযােদ্ধাদের উপর গােলাগুলি চালাতে শুরু করে। মুক্তিযযাদ্ধারা তার যােগ্য প্রত্যুত্তর দেয়। এই সংঘর্ষে রাজাকার ২৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পাকসেনাদের এক সুরক্ষিত ঘাটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য মুক্তিবাহিনীর অন্যতম বীর অধিনায়ক ডা: মামুদ, মহম্মদ জিরাউল ও হাসেম উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক থেকে শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করে ও শত্রুদের ছাউনী ও বাঙ্কার গুলি বিধ্বস্ত করে দেয়। এই সংগ্রামে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। মুক্তিযযাদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন : আবুল আজিজ, রিয়াজউদ্দিন, পরিমল দে, আবদুল সালাম, আবুল হােসেন, আবদুল হাকিম মােল্লা
মুক্তিবাহিনীর একটি দল কাজী মৈনুদ্দিনের নেতৃত্বে হালুয়াঘাট নালিতাবাড়ির মধ্যবর্তী ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দেয়। এই সময় রাজাকার দালালরা বাধা দিতে আসে। মুক্তিযযাদ্ধারা একটি গুলি খরচ না করেও ১টি রাইফেলসহ ৩ জন রাজাকার গ্রেপ্তার করে।
শত্রুর চলাচল ব্যবস্থা অচল করে দেওয়ার জন্য আবদুল হক চৌধুরী, আবুল কাসেম ও উইলিয়াম মারাকের নেতৃত্বে মুক্তিযোেদ্ধাদের তিনটি দল গামার তলা, চেতাখালি প্রভৃতি অঞ্চলের ৩টি সেতু ধ্বংস করে দেয়।
মুক্তিবাহিনীর নায়ক মহম্মদ মজফফর এর নেতৃত্বে একটি দল হালুয়াঘাট এলাকায় পাকসৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বহু পাকসেনা ও রাজাকার নিহত ও আহত হয়। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একদল হতাহত পাকসেনাদের জামালপুর শহরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা গেছে।
মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার সৈয়দ সফিউদ্দিন, নায়েক মান্নান ও মজফফরের নেতৃত্বে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা শেরপুরের কাছে তম্ভরে পাকসেনাদের অন্যতম সুরক্ষিত ঘাটির উপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষেই গুলি বিনিময় চলতে থাকে। আধঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষ চলে। এই সংঘর্ষে ২০ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার দালাল নিহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর তরুণ অধিনায়ক লুতফর ও রসিদের নেতৃত্বে দুশাে মুক্তিযােদ্ধা জামালপুর মহকুমার সরিষাবাড়ি থানা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে কয়েকজন রাজাকার দালাল নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী পুনরায় সরিষাবাড়ি থানা আক্রমণ করে এবং পাকসেনাদের মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে রাজাকার দালালসহ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। সংখ্যা জানা যায় নি। মুক্তিযােদ্ধাদেরও কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা আহত সঙ্গীদের নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
সরিষাবাড়ি থানার পাক পাড়ায় ৭ জন রাজাকার স্থানীয় গােয়ালাদের বাড়ি লুণ্ঠন করতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা দা ও ফালা দিয়ে সুন্টনকারী ৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে এবং ৬টি রাইফেল হস্তগত করে এবং রাইফেলগুলি মুক্তিবাহিনীর হাতে সমর্পণ করে। ১ জন রাজাকার পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
পরদিন পাকসেনাদের এক বিরাট বাহিনী পাকপাড়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম আক্রমণ করে ১৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে ও গ্রাম দুটো পুড়িয়ে দেয়।
সূত্র: কালান্তর, ১৯.১০.১৯৭১