ময়মনসিংহ ঘােষগাও দেওয়ানগঞ্জের এলাকা থেকে পাকসৈন্যর পশ্চাদপসরণ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
মুজিবনগর, ১৮ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ঘােষগাঁও এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের প্রচন্ড আক্রমণে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে।
ময়মনসিংহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং উত্তরবঙ্গ ও পূর্বঙ্গের অন্যতম সংযােগস্থল দেওয়ানগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই এলাকাগুলাের মধ্যে রয়েছে ডাংধর, চররামপুর, গামখাওয়া, হাতিবান্ধা প্রভৃতি এখানে সর্বদলীয় যুক্ত উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটির তত্ত্বাবধানেই এলাকার থানা, অফিস, আদালত, কাসটম অফিসের কাজ সংক্রান্ত অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
এই জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হালুয়াঘাট থেকেও মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে পাকহানাদারেরা পশ্চদপসরণ করেছে।
রংপুর জেলার পাটেশ্বরী দখলের পর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আর দক্ষিণে পাক-অধিকৃত এলাকার দিকে অগ্রসর হয়। নাগেশ্বরী থানার চারদিকে গেরিলারা ঘেরাও করে ফেলে নাগেশ্বরীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু গেরিলারা ধ্বংস করে ও শত্রুর চলাচল ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়।
এই ভাবে একদিকে যেমন এলাকার পর এলাকা মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠান সংগ্রাম চলছে তেমনি পূর্বাঙলার সর্বত্র পাক অধিকৃত এলাকা থেকে ইয়াহিয়া সৈন্য ও রাজাকার দালালদেরকে উৎখাত করার অভিযান অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে।
ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ জেলার গােলখালিতে পাকসেনাদের এতটি শক্তিশালী ঘাটির উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এক বীরত্বপূর্ণ আক্রমন চালায়। ফলে একজন সামরিক অফিসার সহ ৬৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। এই অভিযানের সময় জনৈক পাকসেনা গেরিলাদের হাতে ধরা পড়ে এবং বহু অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। গত রবিবার ময়মনসিংহের একটি অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযােদ্ধার এক অতর্কিত আক্রমণে ৯ জন পাকসেনা সহ সামরিক বাহিনীর জনৈক জুনিয়র কমিশনড অফিসার খতম হয়।
ময়মনসিংহ জেলার মুক্তিবাহিনীর জনৈক গেরিলাযােদ্ধার ডাইরি থাকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, বিগত কয়েক সপ্তাহে গেরিলাযােদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণের ফলে প্রায় দু’শতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছে।
রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী রণাঙ্গন
গত ১৬ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা রাজশাহী জেলার গােদাগারি এলাকায় পাক সেনাদের ঘাঁটি অবরােধ করে এবং প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালায়। ফলে ৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়।
দক্ষিন খেটকিবাড়িতে গেরিলারা ৩ জন শত্রু সৈন্য খতম করে। জাতিবান্ধী ও পাবেলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে গেরিলার রেললাইন বিধ্বস্ত করে ও শত্রুর চলাচল ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়।
সিলেট রণাঙ্গন
তুকার বাজারের কাজে পাকসেনা ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের এক প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। ফলে ৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এই সংঘর্ষে ২ জন মুক্তিযােদ্ধাও শহীদের মৃত্যুবরণ করেন।
কুষ্টিয়া যশাের খুলনা রণাঙ্গন
১২ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায় আলমডাঙ্গায় মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ঘাঁটি ঘেরাও করে এবং প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১৪ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলার আঙ্গুলবাড়িয়া পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাও করে এবং ১২ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ খতম করে। নাটসি গাগারি যােগাযােগ পথে এক বিস্ফোরণের ফলে ১১ জন হানাদার ও এক রাজাকার নিহত হয়। খােদাইরপুরে… ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। ফলে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১৩ জন পাকসেনারা মৃত্যু ঘটে। এই সংঘর্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩ জন হতাহত হন।
সাকুরা মােহনপুরে একটি আধা সামরিক ক্যাম্পের উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে। এই অভিযানে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এই ক্যাম্প থেকে ৫৭ টি রাইফেল হস্তগত করে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, রায় পাড়াতে পাকসেনা ও রাজাকারের মধ্যে গােলা বিনিময় হয়। ফলে ৪০ জন রাজাকার প্রাণ হারায়। পাকসেনাও রাজাকারদের মধ্যে সংঘটিত এই সংঘর্ষের কোন কারণ জানা যায় নি।
ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রণাঙ্গন
গত ১৫ নভেম্বর নােয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়ার পাকসেনাদের উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং ৫ জন পাকসেনা খতম করে।
ঢাকা শহর ও উপকণ্ঠে গেরিলাদের প্রচণ্ড তৎপরতার ফলে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ বেসামাল হয়ে পড়ে এবং ১৭ নভেম্বর সকার ৫টা থেকে টাকা শহরে আকস্মিকভাবে কার্ফ জারী করে এবং প্রতি বাড়ি বাড়ি তল্লাসী চালায়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরােধ গড়ে তােলে। এই অতর্কিত প্রতিরােধের মুখে বহু পাকসেনা হতাহত হয়।
সূত্র: কালান্তর, ১৯.১১.১৯৭১