You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.23 | যশাের-শ্রীহট্ট চট্টগ্রামে মুক্তিফৌজের তীব্র চাপ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

যশাের-শ্রীহট্ট চট্টগ্রামে মুক্তিফৌজের তীব্র চাপ
সাতক্ষীরা, ভােমরা, কলারোয়া পাকফৌজের কবলমুক্ত

কলকাতা, ২২ নভেম্বর যশোের ক্যানটনমেন্ট, শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে পাকফৌজকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। ঢাকা রেডিও আজ স্বীকার করেছে যে, এই তিনটি রণাঙ্গনেই তীব্র লড়াই চলছে।
মুক্তিবাহিনী বর্তমানে আক্রমণাত্মক কৌশলও পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ নিছক কমাণ্ডো অ্যাকশনের উপর নির্ভর না করে সুশিক্ষিত পাকফৌজকে মুখােমুখি লড়াই দেওয়ার শক্তি অর্জন করেছে। ফলে সমগ্র যুদ্ধের চেহারার পরিবর্তন হতে চলেছে।
মুক্তিবাহিনীর তীব্র অভিযানের চাপে খুলনা রণাঙ্গনের সাতক্ষীরা, ভােমরা ও কলারােয়া থেকে হানাদার পাকিস্তানী ফৌজ পিছু হটে গেছে।
রংপুর রণাঙ্গনে গতকাল থেকে আজ সকালের মধ্যে একের পর এক জগদ্দল, অমলখানা, বড়কাটা, হাতীবাধা ও রায়গঞ্জ মুক্তিবাহিনী পাকসেনার কবলমুক্ত করেছে।
শ্রীহট্ট রণাঙ্গনের জাকিগঞ্জ ও মুক্তিবাহিনীর দখলে এসেছে।
বাঙলাদেশের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহন মনে করছে, বাঙলাদেশে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বস্তুত নিরস্ত্র দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের মুখ যেভাবে পাকিস্তানী হানাদার ফৌজ নিজেদের ক্যান্টনমেন্ট ও ছাউনির মধ্যে গুটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, তেমনিভাবে একদিকে মুক্তিবাহিনীর অভিযানের চাপ ও সাধারণ মানুষের গেরিলা তৎপরতায় অতিষ্ট পাকফৌজ এখন আবার কয়েকটি ঘাঁটিতে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে মরণ কামড় দেবার ইচ্ছা পােষণ করছে। কিন্তু মে মাসের সঙ্গে নভেম্বর মাসের একটা গুণগত তফাৎ হল এই যে, মে মাসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুনরসজ্জিত পাকিস্তানী ফৌজ যখন নতুন করে হামলা চালিয়েছিল, তখন মুক্তিসৈনিকেরা ছিল অসংগঠিত ও কার্যত অস্ত্রহীন। কিন্তু এখন বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনী সবদিক থেকেই অনেক বেশি সংগঠিত, সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত। সুতরাং পাকিস্তানী সমরনায়কদের সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করে নবােদ্যমে অভিযান চালানাে আর এই বছরের গােড়ার দিকের মতাে সহজ নয়।
বাঙলাদেশে দখলদার পাক-বাহিনীর সমর শক্তি
নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে বাঙলাদেশে পাকিস্তানী সমর শক্তির যে হিসাব পাওয়া গিয়েছে, তা হল :
নিয়মিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য সাড়ে চার ডিভিশন বা ৮০ হাজার ; পশ্চিম পাকিস্তনী আধা সামরিক বাহিনী ১০ হাজার ; রাজাকার ২৩ হাজার। অর্থাৎ মােট ১ লক্ষ ১৩ হাজার সশস্ত্র বাহিনী। এছাড়া পাক বিমান বাহিনীর দু’টি স্কোয়াড্রন এখানে রয়েছে। এর মধ্যে একটি স্কোয়াড্রন মার্কিন এফ-৮৬ বিমান নিয়ে ও অন্য স্কোয়াড্রনটি চীনা মিগ বিমান নিয়ে গঠিত। আর রয়েছে ৫টি আমাৰ্ড (সাঁজোয়া) স্কোয়াড্রন যার মধ্যে অধিকাংশ মার্কিন ট্যাঙ্ক নিয়ে মােট প্রায় ৬০টি ট্যাঙ্ক রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারীভাবে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত করলেও “তৃতীয় দেশ” ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি মারফৎ মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে আসছে বলে জানা গেল।
যশাের রণাঙ্গন। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায় যে, যশােরে এখন ট্যাঙ্ক নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে।
গতকাল যশাের শহরের আট মাইল দূরে চৌগাছা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর দখল করে নেয়। এতে পাকবাহিনী আতঙ্কিত হয়ে যশাের সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে এসে মুক্তিবাহিনীকে প্রবল আক্রমণ চালায়। জবাবে মুক্তিবাহিনীও চৌগাছা এবং মনিরামপুর এই দুইদিক থেকে যশাের সেনা নিবাসে আক্রমণ করে। গতকালও আজ তুমুল লড়াই চলে। মুক্তিবাহিনীর হাতে চারটি পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। “ঢাকা রেডিও” তাদের ক্ষতির পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয় সংবাদ ও যুদ্ধের সংবাদের কথা স্বীকার করেছে এবং অভিযােগ করেছে যে “ট্যাঙ্ক” সহ ‘যশাের আক্রমণ করা হয়েছে।
সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া সংবাদে আরাে জানা যায় যে পাকজঙ্গীবাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে এবং বেসামাল হয়ে তাদের সেনানিবাস রক্ষার জন্য জঙ্গী বিমানের সাহায্য নেয়।
আজ দুপুরে পাক জঙ্গীবাহিনী অধ্যুষিতপুরের অদূরে মুক্তিবাহিনী অধ্যুষিত এলাকা যশােরের কেশবপুরের বিমান থেকে প্রচণ্ড বােমাবর্ষণ করে। এতে বহু গ্রামেরও ক্ষতি হয়েছে। মুক্তিবাহিনী চৌগাছা এবং মনিরামপুর থেকে যশাের সেনানিবাসের উপর পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন।
আগরতলা থেকে এক সংবাদে জানা যায় সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানী গােলাবর্ষণের ফলে ত্রিপুরার বহু গ্রামে ব্যাপকহারে সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। বিনা প্ররােচনায় গুলি চালানাের ফলে বহু লােক হতাহত হয়েছে। পূর্ণমাটি গ্রামে এইরূপ গােলাবর্ষণেরই ফলে দুই জন শরণার্থী ও ৮ জন গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন। মাজারি কামানের গােলা এসে পড়লে ‘গৌরাঙ্গলােলা গ্রামের বহু সম্পত্তি সম্প্রতি নষ্ট হয়েছে।

সূত্র: কালান্তর, ২৩.১১.১৯৭১