মরণ আঘাত হানাে
নারকেল গাছের নিচে, অরণ্যের আড়ালে, সােনা রং ধান ক্ষেতে, নগর বন্দর গ্রামে বাঙলাদেশ আজ শত্র সেনার হৃৎপিন্ড লক্ষ্য করে ট্রিগার তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণ স্বাধীনতার লগ্ন সমাগত। পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম ভারতবর্ষের মানুষ। পিছনে সারা দুরিয়ার সমাজতান্ত্রিক শিবির। দশ লক্ষ শহীদের শােণিতে রঞ্জিত স্বপ্ন এখন স্বার্থকতার সূর্যতারণে। অরুণ প্রাতের তরুণ মুক্তিসেনানীর দল, তােমরা অগ্রসর হও। তােমাদেরই কবির ভাষা মূর্ত হয়ে উঠুক তােমাদের চূড়ান্ত সংগ্রামে; “বাঙলার মাটি দুর্জয় ঘাটি, বুঝে নিক দুবৃত্ত।” বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আট মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে দেশের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলই শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলেরও এক অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য অংশ মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে এসে গেছে। আধুনিকতম অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ও মার্কিনি সমরবিশারদদের দ্বারা বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাক হানাদের তুলনায় সামরিক শক্তিতে একান্তভাবে খাটো হয়েও মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনগণের অভাবনীয় সাফল্য দুনিয়ার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জলতম অধ্যায়কে মুক্ত করেছে। ইয়াহিয়ার সামরিক জুন্টা ও মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদও বাঙলাদেশের সংগ্রামের বিশাল সাফল্যের বাস্তবতাকে স্বীকার না করে পারছে না। খােদ ঢাকা শহরের কথা উল্লেখ করতে যেয়ে মার্কিনি একচেটিয়া পুজির সাময়িক পত্র ‘নিউজ উইক’ বলতে বাধ্য হয়েছে, “কঠোর পুলিশি নিরাপত্তা সত্ত্বেও ঢাকায় আমার আবাসস্থল থেকে বেরিয়ে মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ পেলাম। মুক্তিবাহিনী ঢাকার দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছেন।” জরুরী অবস্থা ঘােষণা করার পূর্ব হতেই পাক কর্তৃপক্ষ ঢাকা ও অন্যান্য অধিকৃত শহরে নিপ্রদীপ মহড়া চালিয়ে আসছে। অথচ “এরূপ মহড়ার প্রতিরাতেই ঢাকায় গেরিলাদের কার্যকলাপ শুরু হইয়া যায় ও বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে নগরী কাপিয়া কাপিয়া ওঠে। হানাদার, দুশমন ও রাজাকারদের ঘাটিতে বােমা পড়ে, বিদ্যৎ সরবরাহের সাব স্টেশনগুলাে উড়িয়া যায়। ( মুক্তিযুদ্ধ, ২১ নভেম্বর) রাতে নগরীর বেশি কার্যত মুক্তিযােদ্ধাদের হাতেই থাকে এবং ক্যান্টনমেন্ট ও কয়েকটি মূল ঘাঁটি ছাড়া পাকসেনারা বেরােতে সাহস পায় না। এইভাবে বাঙলাদেশের সমস্ত খন্ডে মুক্তিবাহিনী ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে। হানাদারদের দুঃস্বপ্নের মতাে তাড়িয়ে দিয়ে তারা ইতােমধ্যে যশাের, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টের তিন-চতুর্থাংশের মতাে ভূ-খন্ড পুরােপুরি কজায় এনে ফেলেছে। বাঙলাদেশে এখন এমন একটি জেলাও নেই, যার কমবেশি অঞ্চল মুক্তিযােদ্ধাদের আয়ত্তে আসেনি। মার্কিন সাংবাদিক বােরগ্রেড স্বীকার করেছেন যে, প্রতি মুহূর্তে হানাদারদের পায়ের তল থেকে মাটি সরে যাচ্ছে এবং ১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের যে সৈন্যক্ষয় হয়েছে, বাঙলাদেশে ইতিমধ্যেই তারা তার চারগুণ বেশি সৈন্য হারিয়েছে। বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া চক্র কখনও শান্তি প্রস্তাবের কথা তুলছে কখনও বা তাদের প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ভরাডুবি থেকে বাঁচানাের জন্য মধ্যস্থতার আহ্বান জানাচ্ছে কখনও বা রাষ্ট্রপুঞ্জে চীনের মুখ দিয়ে ভারতবর্ষের কুৎসা গাইছে। যে পশ্চিমা শক্তিবর্গ তাঁদের তাঁবেদার ইয়াহিয়ার বিজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে বাঙলাদেশকে শশ্মানে রূপান্তরিত করার জন্য আধুনিকতম মরণাস্ত্র ও অঢেল অর্থ দিয়ে মদত দিচ্ছিল, এখন সমূহ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে তারাও হঠাৎ সমস্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের ধূয়া তুলে রাষ্ট্রসংঘের হস্তক্ষেপের দাবিতে মুখ খুলতে শুরু করেছে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদে ও প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলাের সঙ্গে যােগসাজশে ইয়াহিয়ার সামরিক জুন্টা ছলে বলে কৌশলে একদিকে যেমন বাঙলাদেশে তাদের বীভৎসা থেকে দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টি কল্পিত পাকভারত সংঘর্ষের দিকে নিবদ্ধ করতে চাইছে, অপর দিকে লক্ষ লক্ষ স্বজন হারানাের বেদনা বহন করে বাঙলাদেশ থেকে ভারতে আগত প্রায় এক কোটি শরণার্থী সমস্ত দুঃখ বেদনা সহ্য করেও পরিপূর্ণ স্বাধীন স্বদেশে ফিরে যাওয়ার মাহেন্দ্র লগ্নটির জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছেন। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ষড়যন্ত্র অপরদিকে ছিন্নমূল শরণার্থীদের পূনর্বাসনের প্রশ্ন-এই উভয় গুরুতর সমস্যাকে মােকাবিলা করার জন্য বাঙলাদেশের মুক্তিফৌজ ও সংগ্রামী জনগণকে দৃঢ়তম সংকল্পের সঙ্গে শত্রুর উপর মরণ আঘাত হানতে হবে। মুক্তির দিগন্ত আর বেশি দূরে নয়।
সূত্র: কালান্তর, ২৫.১১.১৯৭১