You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.14 | পূর্ব রণাঙ্গন- শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে ভারতীয় ফৌজ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব রণাঙ্গন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে ভারতীয় ফৌজ
(স্টাফ রিপাের্টার)

কলকাতা, ১৩ ডিসেম্বর- গত রাতে টাঙ্গাইল মুক্ত করার পর ভারতীয়বাহিনী ঢাকা থেকে ১৮ মাইল উত্তরে জয়দেবপুরের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ভৈরববাজার থেকে এগিয়ে গিয়ে ভারতের জওয়ানদের আর একটি বাহিনী ঢাকার পূর্বদিকে শীতলক্ষ্যা নদীর কাছে পৌঁছেছে।
ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থানগুলি এখন ভারতীয় বাহিনীর কামানের পাল্লার মধ্যে। মনে হয় ঢাকা মুক্ত করার শেষ পর্যায়ের লড়াইয়ে ভারতীয় বাহিনীও বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করছে।
আজ ভারতীয় বাহিনী ইস্টার্ন কমাণ্ডের জনৈক মুখপাত্র বলেন, ঢাকাকে ঘিরে ভারতীয় বাহিনীর বেষ্টনী সংকুচিত করে আনা হচ্ছে।
উত্তরে হিলি থেকে এগিয়ে ভারতীয় বাহিনী পাঁচবিবি দখল করে বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে গিয়ে পৌঁছেছে। জেলাশহর বগুড়ার মুক্তি আসন্ন।
এদিকে, দক্ষিণ পশ্চিম বাঙলাদেশে খুলনার উপকণ্ঠে আজ তৃতীয় দিন তীব্র লড়াই চলছে ক্যান্টনমেন্ট দখলের। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জানান, পাকফৌজের পালাবার কোনও পথ নেই, তাই তারা মরীয়া হয়ে লড়ছে। “আমরা লড়ছি তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাবার জন্যে।”
যশাের সেক্টরের উত্তরে কুষ্টিয়া মুক্ত করার পর ভারতীয় বাহিনীর পদ্মার পশ্চিমতীরে এগিয়ে গিয়ে হাডিঞ্চ ব্রীজের কাছে পাক বাহিনীর ফেলে যাওয়া একাধিক কামান ও গাড়ি পেয়েছে। উক্ত মুখপাত্র জানান, এখনাে পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় নি।
রংপুর-দিনাজপুর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী হিলি থেকে এগিয়ে গিয়ে পাঁচবিবি দখল করে বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে। এই সেক্টরে লক্ষ্মীপুর ও আজ ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে। এখানে পাকবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের কম্যাণ্ডিং অফিসার ও আরাে ৪ জন অফিসার বন্দী হয়েছেন।
ময়মনসিংহ জয়দেবপুর সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী গতরাতে টাঙ্গাইল দখল করার পর মির্জাপুর ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে। তারা দ্রুত ঢাকার দিকে এগিয়ে চলেছে” বলে উক্ত মুখপাত্র জানান। তিনি জানান, মির্জাপুর থেকে নদী পার হয়ে জয়দেবপুরের কাছে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী পৌঁছেছে, তবে জয়দেবপুর এখনো দখলেক আসেনি। জয়দেবপুরে (ঢাকা থেকে আঠারাে মাইল উত্তরে) পাক সরকারের একটি অস্ত্র কারখানা আছে।
জয়দেবপুর থেকে ঢাকার পথে টঙ্গীও পাকফৌজের একটি শক্ত ঘাঁটি। এই পথে এগুতে অবশ্য ভারতীয় বাহিনীকে কোনও নদী পার হতে হবে না। নরসিংদির দিক থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকায় পৌঁছুতে হলে শীতলক্ষা নদী পার হতে হবে। একই প্রাকৃতিক বাধা-মেঘনা নদীর বাধার সম্মুখীন দাউদকান্দী ও চাঁদপুরের ভারতীয় বাহিনী। কুষ্টিয়া থেকে পাবনা হয়ে এগুবার পথেও বড় প্রাকৃতিক বাধা পদ্মা নদী। এখানকার হাডিঞ্জ ব্রীজের একাংশ পাক বাহিনী ধ্বংস করে গিয়েছে।
সিলেট ও কুমিল্লা সেক্টরে লাকসাম ও কুমিল্লা এলাকায় পাকবাহিনীর ১৪ জন অফিসার ২৫ জন জে সি ও এবং ১০৯৫ জন অন্যান্য স্তরের সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এই সব অফিসার ও সৈন্য ৫৩ ব্রিগেড, ২৩ পাঞ্জাব, ১৫ বালুচ, ৩৯ বালুচ, ৫৩ ফীল্ড রেজিমেন্ট, ৪৭ ফীল্ড কোম্পানী এঞ্জিনীয়াস এবং ২১ আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের অন্তর্ভুক্ত।
চট্টগ্রামের দিকে যে ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে চলেছে, তারা সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছেছে।
আজ ভারতীয় বিমানবহর ভেড়ামারা, হাডিজ্জ ব্রীজ, রংপুর, ময়নামতি ও নরসিংদি এলাকায় শক্রদের ঘাঁটিগুলির উপরে আঘাত হানে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় গােয়ালন্দঘাটে পাকসৈন্যবােঝাই মােটর বােট ও নৌকা বিধ্বস্ত হয়েছে।
ঢাকায় পাক বাহিনীর প্রস্তুতি
সদ্য ঢাকা থেকে আসা বিদেশীদের সূত্রে জানা গেল, ভারতীয় বিমানবাহিনী যেহেতু অসামরিক এলাকায় হানা দেবে না, সেই জন্য পাকফৌজ ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে শহরের বিভিন্ন হােস্টেল, হাসপাতাল খালি করিয়ে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে। ক্যান্টনমেন্টে নাকি রাজাকারদের রেখে দেওয়া হয়েছে।
বাঙলাদেশে পাক দখলদার বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজি “শেষ পর্যন্ত প্রতিরােধ করার জন্য পাকসেনাদের আদেশ দিয়েছেন এবং ঢাকা শহরে তার জোর প্রস্তুতিও চলেছে। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় তারা বিবরঘাটি করেছে এবং মিন্টো রােড, সিদ্ধেশ্বরী রােড খুড়ে পাতাল পথ তৈরি করেছে।
এরই পাশাপাশি ভারতীয় বিমান বাহিনীর ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য পাকিস্তানীরা তাদের বিমান দিয়েই ঢাকার অসামরিক এলাকায় বােমা ফেলে। উপরােক্ত সূত্র থেকে জানা গেল, পূর্ব-পাক কৃষি দপ্তরের দুটি ছােট হলুদ রঙের বিমান গত ৬ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার আশে পাশে বােমা ফেলে এবং পরদিন প্রচার চালায় ভারতীয় বিমান বহর এইসব অসামরিক এলাকায় বােমা ফেলেছে। এই বােমা বর্ষণের ছবিও ফলাও করে পেটোয়া কাগজ গুলিতে ছাপা হয়। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিকচক্রের এই নিষ্ঠুর জালিয়াতী ৯ ডিসেম্বর ধরা পড়ে যায় কুর্মিটোলায়। সেখানে একটি বােমা অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় এবং সেই বােমায় চীনা মার্কা মারা ছিল।

সূত্র: কালান্তর, ১৪.১২.১৯৭১