বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের এক বিস্ময়
হাজরা পার্কে জনসভায় ভবানী সেন
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা জেলা পরিষদের উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতায় হাজরা পার্কে আয়ােজিত এক বর্ণাঢ্য, মহতী জনসভায় কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন বলেন, রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষপাদে পৌঁছে ‘সভ্যতার সংকট’ শীর্ষক রচনায় পূর্ব দিগন্ত থেকে নব অভ্যুদয়ের যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আজ বাঙলাদেশের উদ্ভব ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে বাস্তবে রূপায়ন সেই ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে তুলেছেন। তিনি জানান, “পৃথিবীতে বােধ হয় এত দ্রুত কোথাও কোন গণমুক্তি সংগ্রাম সফল হতে পারে নি। সেদিক থেকে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বস্তুতঃই ইতিহাসের এক বিস্ময়।”
বিপুল হষধ্বনির মধ্যে শ্রীসেন বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী জগত এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার এক অঙ্গ অর্থাৎ চীনের সক্রিয় সমর্থন পাকিস্তানের চার হাতকে পাঁচ হাতে পরিণত করলেও তাকে বাঁচাতে পারে নি। কারণ ইয়াহিয়ার পেছনে মার্কিন-চীন আঁতাত থাকলেও বাঙলাদেশ ও ভারতের পেছনে আছে মহা সােভিয়েত ইউনিয়ন, যে সােভিয়েত অন্যান্য ভূমিকা নিয়ে ওদের যৌথ চক্রান্ত প্রতিহতও ব্যর্থ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববিপ্লবের দুর্গ সােভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি “অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন জানিয়েছে ভারত পাক যুদ্ধ ও বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পরিণতিতে ভারত-পাক উপমহাদেশ থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চিরতরে বহিষ্কৃত করার ডাক দেন। তিনি বাঙলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় জওয়ানদের আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শেষ পর্যায়ে উপনীত মুক্তিযুদ্ধের জয় প্রত্যাসন্ন, কিন্তু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরও সংগ্রাম থামবে না।
শ্রীসেন বলেন, বাঙলাদেশের এই বিস্ময়কর সংগ্রামে বাঙলাদেশের জনগণের
শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবক-শিক্ষক-অধ্যাপক-শিল্পী-পুলিশ-গুপ্তচর বাহিনীর-মধ্যে যে সর্বব্যাপক ঐক্য তা যথার্থ অভূতপূর্ব ; এই প্রথম দেখা গেল কোন মুক্তি সংগ্রামের পাশে এসে দাঁড়াল এমন কি গুপ্তচরবাহিনীও। আবার ভারতেও বাঙলাদেশের সপক্ষে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও সকল মানুষের মধ্যে যে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়েছে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে সেই ঐক্য দেখা যায় নি। আর এই প্রথম একটি দেশের ধনিকশ্রেণি প্রতিবেশী এক দেশে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে যে দেশকে মুক্ত করতে সহায়ত করল।
“বাঙলাদেশে নতুন অধ্যায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে। বাঙলাদেশের পথে প্রান্তরে কেবল ইয়াহিয়া বাহিনীই পরাস্ত হচ্ছে না, ধ্বংস হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া উপনিবেশিকতার নীতি, যেহেতু গত ৯ মাসে বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার তাণ্ডব নৃত্য ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই তাণ্ডব নৃত্য।”
নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েত বক্তব্য— শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের মূল কারণে : বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর অত্যাচার : ঢুকতে হবে- কী ইঙ্গিত বহন করছে তা বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, কেউ কেউ ভেবেছিলেন আমেরিকাই আমাদের মঙ্গলকাঙ্গী, আবার কেউ ভেবে ছিলেন চীনই একমাত্র রক্ষাকর্তা। এখন মার্কিন ও চীনা লবী ধরাশায়ী– জনসঙ্ থেকে সিপিএম এখন সােভিয়েতকে অভিনন্দন জানাতে বাধ্য অথচ যে ভারত সােভিয়েত চুক্তি বাঙলাদেশের সংগ্রামের জয়ের পথ প্রস্তুতকারক সেই চুক্তি সম্পর্কে একদিন জনসঙ্ঘ মুখপত্র ‘মাদার ল্যাণ্ড, স্বতন্ত্র মুখপত্র ‘স্টেটসম্যান ও সিপি এম মুখপত্র ‘গণশক্তি’ এক সুরে বলেছিল ওটা মুক্তিযুদ্ধ বানচারের উদ্দেশ্যে রচিত। “আজ সােভিয়েত সমাজতন্ত্রের পক্ষে ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিন্দায় যে ঐক্য দেখা গেছে আগে তা কখনও দেখা যায় নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র ভারতকে বাঁচাচ্ছে সােভিয়েত দেশ।”
সি,পি,এ, প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঐ দল বাঙলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশ করে পশ্চিমবঙ্গকে ‘কেন্দ্রের উপনিবেশ’ বলে প্রমােদবাবু বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান তােলেন। এ যেন চাঁদ আকাশে ঘােরে বলে, সি,পি,এম-এর ছেলেরাও আকামে ঘুরতে চায়। তিনি এই আশা প্রকাশ করেন যে, সি,পি,এম, তার রাজনীতিক পর্যালােচনা করবে।
মার্কিন সরকার ভারতে সাহারা দেবে না বলে যে চাপ দিচ্ছে তাকে স্বাগত জানিয়ে শ্রীসেন বলেন, ভারত সরকারের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির দাবি ঘােষণা করা ও চলার নেব না, আমেরিকার সব পাওনা বরবাদ করব।
চীনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে তীব্র ভাষায় কশাঘাত করে শ্রীসেন জানান, “যদি চীন ইয়াহিয়ার পক্ষে তার ভূমিকা না বদলায় তবে তার কপালে প্রচুর দুঃখ আছে।”
কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা জেলা পরিষদ সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত ইয়াহিয়ার যুদ্ধ চক্রান্ত ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত রােধে জাতীয় ঐক্য গড়ার এবং সমাজদ্রোহী, চোরাবাজারী, বিভেদপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক কমিটি গড়ার ডাক দেন।
সভায় পৌরহিত্য করেন, হরেন চট্টোপাধ্যায়। স্বীকৃতিদানের জন্য এবং মার্কিন সাহায্যপুষ্ট পাক জুন্টার যুদ্ধরােধে সময়ােচিত পদক্ষেপের জন্য ভারত সরকারও বিশ্ব সমাজতন্ত্রের পথিকৃৎ সােভিয়েতকে অভিনন্দন এবং মার্কিন ও চীনকে ধিক্কার দিয়ে ; শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে এবং কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী জি, এম, সাদিকের মৃত্যুতে শােক জ্ঞাপন করে তিনটি প্রস্তাব নেওয়া হয়। সাদিকের প্রতি শ্রদ্ধার এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভা শেষে এক বিরাট মিছিল দেশপ্রিয় পার্কে গিয়ে শেষ হয়।
সূত্র: কালান্তর, ১৩.১২.১৯৭১