You dont have javascript enabled! Please enable it!

খুলনার গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শপথ
(বাঙলাদেশ সফররত বিশেষ সংবাদদাতা)

কয়েকটি শহরের বুকে প্রেত নৃত্য করে ইয়াহিয়া যদি ভেবে থাকেন বাঙলাদেশকে শায়েস্তা করবেন তা হলে তিনি দিবাসপ্ন দেখছেন। আমরা তাকে একবার বাঙলাদেশের গ্রাম আর লক্ষ লক্ষ গ্রামবাসীর দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখতে বলি। তিনি বুঝবেন, তার মার্শাল ল’ এর হাত অতদূর পৌঁছানাে সম্ভব নয়।
চব্বিশ পরগণার হাকিমপুর থেকে সােনাইনদা পার হয়ে পৌঁছলাম বাঙলাদেশের প্রথম গ্রাম খুলনা জেলার ভাদিয়ালিতে। সাতক্ষীরা মহকুমার কলারােয়া থানার একটা বেশ বড় গ্রাম। প্রায় ৭০০ ঘর পরিবার আর সাড়ে তিন হাজার মানুষের বাস। হিন্দু-মুসলমান দুই পৌঁছানাে সম্ভব নয়। আর যদিই বা সেই দুঃসাহস তিনি দেখান সে হবে আগুনে হাত দিয়ে হাত পােড়াবার মুগ্ধতা। আজ খুলনার গ্রামে গ্রামে সেই প্রতিজ্ঞাই দেখে এলাম।
মতিহার রহমান এবং গােলাম হােসেন (দু’জনেই সাতক্ষীরা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র) পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন যেখানে ইপিআর এর মুক্তি যােদ্ধারা ক্যাম্প করে আছেন। সেখানে দেখলাম তারা প্রস্তুত হয়েই আছেন শক্রর মােবাবেলায়।
এখন শুধু নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন খুলনা সদর আক্রমণ করবেন না যশাের যুদ্ধরত সাথীদের সাহায্য করতে যাবেন। ইতিমধ্যে তারা গ্রামের যুবকদের তালিম দিচ্ছেন তাদের অবর্তমানে শত্রুর আকস্মিক হানা মােকাবেলা করবার জন্য।
ছাত্রবন্ধু দুটি আমাদের নিয়ে গেলেন আরও তিন মাইল ভিতরে এই অঞ্চলের একমাত্র সরকারী… ইপিআর এর বর্ডার… সাহেব শুনলে সম্ভবতঃ বড়ই মনােকষ্ট পাবেন যে দেয়ালে দেয়ালে লেখা রয়েছে ইয়াহিয়া ভুট্টো নিপাত যাক আর ‘শেখ মুজিবর লাল সেলাম।’ দফতরের পাকিস্তানী পতাকা ছিড়ে ফেলে সেখানে কালাে পতাকা তােল হয়েছে।
নৌকায় নদী পার হবার সময়েই দেখতে পেলাম সংগ্রাম পরিষদের লাল ফেস্টুন আর জয় বাঙলার পতাকা। বাঙলাদেশের মাটিতে পা দিতেই অভ্যর্থন করলেন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম।
সভাপতি রাজ্জাক সাহেব জানালেন, খুলনা থেকে আনুমানিক ৪০ মাইল দূরে যুদ্ধ এখানে না পৌঁছলেও গ্রামবাসীরা প্রস্তুত হচ্ছে যাতে হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্যরা তাদের বেকায়দায় না ফেলতে পারে। স্বেচ্ছাসেবকের নাম তালিকাভূক্তি চলছে মুক্তি ফৌজ সংগঠনের জন্য। প্রায় সমস্ত সমর্থ পুরুষেরাই ইতিমধ্যে নাম লিখেছেন। সগ্রহ চলছে রসদ এবং ঔষধপত্রের প্রয়ােজনের দিনে যাতে অসুবিধায় না পড়তে হয় এবং দরকার হলে যাতে আসে পাশের যুদ্ধ চলছে এমন অঞ্চলেও সরবরাহ পাঠানাে যায়। সংগ্রাম পরিষদের অফিস থেকে দুটি ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক ইপিআরের অবর্তমানে সেখানে রয়েছেন ৮ জন মুজাহিদ। এঁরা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে গ্রামে যাতে চুরি ডাকাতি না হতে পারে সে দিকে নজর রাখছেন। প্রয়ােজন হলে এই মুজাহিদরাও যাবেন যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিফৌজের পাশে দাঁড়িয়ে লড়তে।
ইপিআর ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আরও মাইল তিনেক ভেতরে গেলাম বােয়ালিয়া গ্রামে। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমএলএ মমতাজ আহমদের বাড়ীতে। মহতাজ আহমদ বাড়ি ছিলেন না। কথা বললেন তাঁর ভাগ্নে মানিকুর রহমান। তিনি জানালেন, ইয়াহিয়ার দালালরা গ্রামের লােকের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা পুরানাে কায়দায় সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া চলে। মুসলিম লীগ আর জামাত ইসলামের ঘৃণা দালালরা গ্রামবাসীকে বােঝাতে চেষ্টা করছে, “বাঙলাদেশ কায়েম হলে আমরা সব হিন্দুর দাস হবাে, বাঙলাদেশ এবং ভারতের অধীন। ইসলাম হবে বিপন্ন” বরফ কিন্তু গলছে না এতে। কলারােয়া কলেজের ছাত্র জাকির হােসেন বললেন, “২৩ বছর ধরে “ওরা আমাদের ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্ধ করে রেখেছিল। আমরা ফসল ফলিয়েছি, ওরা তা সুঠ করেছে। আমাদের পরিশ্রমে ওরা করেছে আনন্দ। কিন্তু আর নয়। হিন্দু আর মুসলমান সব এক আজ। আমরা স্বাধীন বাঙলা কায়েম করবই।” সমর্থন জানালেন এখানে উপস্থিত আর সকলে। ১২ই এপ্রিল জামাত-ই-ইসলাম আর মুসলিমলীগ একটা মিছিল করার চেষ্টা করেছিল ইয়াহিয়ার সমর্থনে কলারােয়া বাজারে। মাত্র তেরােটি “কালাে ভেড়া” জুটেছিল মিছিলে।
এই খুলনার গ্রাম। এই স্বাধীন বাঙলা গ্রাম। আমরা ঘুরেছি পায়ে হেঁটে, সাইকেলে গ্রামের পর গ্রামভেদিয়ালি, বরালিয়া, চাঁদা, রাজপুর, মায়াডাঙ্গা, বােয়ালিয়া, কলারােয়া। সর্বত্র একই চিত্র একই প্রতিজ্ঞা। সাধ্য কি ইয়াহিয়ার গুণ্ডারা গ্রাম বাংলার স্বাধীন মানুষকে কাবু করে।

সূত্র: কালান্তর, ১৫.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!