You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.13 | সাবাস জওয়ান | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

সাবাস জওয়ান

জল, স্থল ও উর্ধ্বাকাশে ভারতের তরুণ যােদ্ধারা দিনের পর দিন বীরত্বের ইতিহাস সৃষ্টি করছেন। বর্তমান যুদ্ধে প্রধানত উন্নত যন্ত্রপাতি নির্ভর হলেও যারা সেই যন্ত্র ব্যবহার করে তাদের দক্ষতা, সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা ছাড়া আজকের যুদ্ধ সম্ভব নয়। ভারতীয় জওয়ানরা সেই ব্যক্তি-কৃতিত্বে পরিচয় দিনের পর দিন পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিস্তীর্ণ রণাঙ্গনে দিয়ে চলেছেন।
কিন্তু ব্যক্তিগত দক্ষতা, সাহস ও বুদ্ধিমত্তাই কি একটা সৈন্য বাহিনীর শক্তির একমাত্র উৎস। তাহলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান ও জাপান শােচনীয় পরাজয় বরণে বাধ্য হলাে কেন? পাক-বাহিনীর সৈন্যরা কি যুদ্ধ বিদ্যায় অন্যের তুলনায় কম পারদর্শী? শুধু সমর যন্ত্র এবং আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিপুর্ণভাবে পরিচালনাই যদি একটা সেনাবাহিনীর বীরত্বের ইতিহাস সৃষ্টির মানদণ্ড হতাে তাহলে পৃথিবীর অন্যতম মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম থেকে লেজ গুটিয়ে পালানাের পথ খুঁজত না।
আধুনিক সমরাস্ত্র এবং তার ব্যবহারের নিপুণ শিক্ষা, ব্যক্তিগত বুদ্ধি, সাহস এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আরও একটি অস্ত্রের প্রয়ােজন দেশপ্রেম। কিসের জন্য যুদ্ধ, কেন জীবনদান কেনই বা শক্ৰহত্যা ও এ সম্পর্কে স্থির বিশ্বাসই এই দেশপ্রেমের উৎস। একটা দেশের সৈন্যবাহিনী যখন এই বর্মে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে নামে তখন মনের আবেগ সঞ্চালিত হয় অস্ত্রে, ঘৃণার আগুনে লক্ষ্য হয় স্থির, নিষ্কপ। অর্থাৎ যুদ্ধ যদি ন্যায় যুদ্ধ হয় তখন যাদের ভাড়াটে বলে বিদ্রুপ করা হয় সেই সৈন্যবাহিনীর চেহারা পাল্টে যায়। ন্যায় ও দেশপ্রেমের অগ্নি শিখা তখন তাকে খাটি সােনায় পরিণত করে।
এই মুহুর্তে বাংলাদেশের মাঠে, প্রান্তরে, নদী, নালায় যে ভারতীয় জওয়ানরা অস্ত্র হাতে ছুটে চলেছেন তাঁদের মধ্যে এ ধরণেরই এক প্রেরণা কাজ করেছে। তাদের পাশে যে মুক্তিবাহিনী জন্মভূমির মুক্তির জন্য গত আট মাস ধরে জ্বলন্ত দেশপ্রেমের শিখা বহন করে ছুটে চলেছেন হয়ত তাদের আবেগ সঞ্চালিত হয়েছে ভারতের তরুণ যােদ্ধাদের মনে। কিংবা বাঙলাদেশের যে সাড়ে সাত কোটি জনতা অমান দীপশিখার মত শত ঝড়-ঝঞা উপেক্ষা করে বাঙলাদেশের মুক্তির স্বপ্ন-শিখাকে প্রজ্বলিত রেখেছেন ভারতের তরুণ সেনানীরা হয়তাে বা তাদের ঐ দীপালােকে উদ্ভাসিত হয়েছেন। কিংবা গত দু বছরে ভারতে জনজাগরণের যে প্রবল স্রোত বাধা-বন্ধ মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র প্রগতির লক্ষ্যে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে ভারতের এই বীর সেনানীর হয়তাে সেই স্রোতধারায় সিক্ত হয়ে নতুন চেতনা লাভ করেছেন। কারণ যাই হােক ভারতের জওয়ানরা আর প্রচলিত অথে সৈন্য নেই তারা আজ যােদ্ধা নিজের দেশের জন্য লড়ে আবার প্রতিবেশীর মুক্তির জন্য প্রাণ দেয়।
বাঙলাদেশের যেখানেই যুদ্ধ হচ্ছে এবং মুক্ত হচ্ছে সে রকম প্রত্যেকটি জায়গায় ভারতের তরুণ সেনানীদের এই নব-পরিচয়ের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। সেনাপতিরা বলেছেন দখল করা নয়, আমাদের যুদ্ধ লক্ষ্য হলাে প্রতিবেশীর জন্য মুক্ত করা। সৈন্যরা সেই নির্দেশ পালন করেই ক্ষান্ত হননি তারা সঙ্গে সঙ্গে হাসি ফুটিয়ে চলেছেন বাঙলাদেশের লক্ষ কোটি মা-ভাই-বােনের মুখে। অশক্তের প্রতি নিজেদের সবল বাহু বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত প্রতিবেশীর পরিচয় দিচ্ছেন। এ শুধু শিক্ষাদানের বিষয় নয় এ হলাে অনুভূতির বিষয় এক নব-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার বিষয়। বিশ্বের যে কোন দরবারে ভারত সরকারের আচরণ নিয়ে সংকীণ স্বার্থ দুষ্ট রাষ্ট্র নায়করা যাই বলুক বাঙলাদেশের মাটিতে ভারতের জওয়ানরা রচনা করছেন বীরত্বের পাশাপাশি দেশপ্রেমের ইতিহাস। যে দেশপ্রেম নিজের দেশকে ভালবাসতেই শেখায় না প্রতিবেশীকেও পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
এই নব-চেতনাকে স্বাগত জানিয়ে বলব দীর্ঘজীবী হােক।

সূত্র: কালান্তর, ১৩.১২.১৯৭১