You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.13 | এদের দেখে ভয় পাবাে কেন? | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

এদের দেখে ভয় পাবাে কেন?
(স্টাফ রিপাের্টার)

ঝিকরগাছায় এসে গাড়ি থামাতে হলাে। কপােতাক্ষের ওপর ভারতীয় সেনাদের তৈরী ভাসমান সেতুটির ওপর দিয়ে এখন মিলিটারী কনভয় যাচ্ছে। পুরানাে সেতুটি ভাঙ্গা। পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় এটি ভেঙ্গে দিয়ে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে এসে কপােতাক্ষের পাড়ে দাঁড়ালাম। ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে গত চৈত্র শেষের পলাশ রৌদ্রের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলাম মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন তরুণ সৈনিকের সঙ্গে। যারা নিজেদের মধ্যে গবেষণা করে তখন স্থির করেছিলেন এই সেতুটি ভাঙ্গা ঠিক হবে না। কারণ— “এটি আমাগাে সম্পত্তি।” ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই কয়েকজন বৃদ্ধ এখন নিজেদের মধ্যে এই যুদ্ধ সম্পর্কে নির্ভয়ে আলােচনা করছেন। অদূরে ভারতীয় জওয়ানেরা রাস্তা তৈরি করছেন।
‘কত গাড়ি গেল?’ একজন প্রশ্ন করলেন যেন অনেকটা নিজের মনে। অন্য জন তার পাশে দাঁড়িয়েই উত্তর দিলেন ‘তা পাঁচ হাজার হবে।’ তার উত্তরে সকলে একমত হলেন না, হাসলেন। এরপর আলােচনা শুরু হলে সেতুটি নিয়ে। এটা কিভাবে ভাঙ্গা হলাে সেই বিষয়ে। একজন বললেন, “আরে ধ্যৎ, ব্রীজ ভাইঙ্গা কি ঠেকাইছে? ট্যাঙ্কগুলি দেখছিলি ক্যামনে পাক দিয়া নদী পার হইছে, রাশিয়ান কি না।”
এতক্ষণ ওরা নিজেদের মনেই আলােচনা করছিলেন। আমি দূর থেকে শুনছিলাম। এবার আমি একটু এগিয়ে ওদের আলােচনায় যােগ দিলাম। “আপনারা ব্রীজ ভাঙ্গা, ট্যাঙ্ক যাওয়া সব নিজের চোখে দেখেছেন? সৈন্য দেখে ভয় করেনি?”– প্রশ্ন করলাম। উত্তর যেন সকলে একযােগেই দিলেন। “খানেরা ক্যামনে ভাগে একটু দেখুন না। এতদিন যা বীরত্ব দ্যাখাইছে। – আর ভারতীয় সৈন্যদের আমরা ক্যান ভয় পামু?” – পাল্টা প্রশ্ন করলেন ওরা।
– সত্যিই তাে ভারতীয় সৈন্যদের তারা কেন ভয় পাবে? ওঁরা যে ভারতীয় সৈন্যদের ভয় পায় না, তার নিদর্শন আরাে দেখা গেল, ঝিকরগাছার রাস্তার ভিড় অনেকে রাস্তায় কর্মরত সৈনিকদের সঙ্গে গল্প করছেন। কয়েকটি গরুর গাড়ি, মালপত্র বােঝাই হয়ে এপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপারে যাওয়ার জন্য। যেতে দেরি হবে দেখে অনেকে রাস্তার পাশে প্রহরারত সৈনিকদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন নির্ভয়ে।
গরুর গাড়ির ওপরে বসা মহিলারা ঘােমটার আড়াল থেকে সলাজ চোখে এসব দেখছেন। কনভয়ে যাওয়া গাড়ির ওপর থেকে সৈনিকেরা হাত নেড়ে হেসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন।
মিলিটারী কনভয়ের যাওয়া শেষ হলাে। এবার আমাদের ওপারে যাওয়ার পালা। এই ভাসমান সেতুতে ওঠবার আগেই একটি গরুর গাড়ির চাকা নদীর ভেজা মাটিতে একটু আটকে গেল। তা দেখে ঐ সৈনিকেরাই নেমে এসে গাড়িটিকে টেনে উঠিয়ে ওপারে যেতে সাহায্য করলেন। গাড়ির চালক মাটি ভরা হাতে ঐ সৈনিকদের হাতে হাত লাগিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার গন্তব্যস্থল গেলেন।
শুধু ঝিকরগাছাতেই নয়, যশােরের সর্বত্রই এই ধরণের দৃশ্য চোখে পড়েছে। যশােরের শহরে লােকসংখ্যা এখন কম। যুদ্ধের সময়ে অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। এখন তারা ধীরে ধীরে ফিরছেন। পথে ভারতীয় সৈন্যরা তাদের ফিরতে সাহায্য করছেন। যশাের শহরের মানুষ নারী, পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় বেরিয়ে এসে উল্লাস প্রকাশ করছেন। নির্ভয়ে সৈন্যদের কাছাকাছি ঘােরাফেরা করছে। নির্ভয়ে আব্দার করলাে— “এই হামলােককা ফটো লেও।”
দূরে টিউবওয়েল থেকে কয়েকটি ছােট ছেলেমেয়ে জল নিচ্ছিল। বালতি বহন করতে তাদের একটু কষ্ট হচ্ছিল। এই দেখে ভারতীয় সৈন্যদের একদল এগিয়ে গিয়ে তাকে জল নিতে সাহায্য করল। এখানেই কথা হলাে অশিতপর বৃদ্ধ শ্রীআবদুল আজীজের সঙ্গে। তিনি অবাঙ্গালী এবং ইতিপূর্বে কলকাতার ২৫ নং ফুলবাগানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি জানালেন যে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত ব্যবহারই করছে।
যশােরে এখন সন্ধ্যার পর কাফু দেওয়া হয়। কয়েকজন অধিবাসী জানালেন যে শহরের অধিকাংশ অধিবাসীই এখন বাইরে, যুদ্ধের পর চুরি ইত্যাদি হতে পারে। তাই স্থানীয় অধিবাসীগণই গিয়ে সন্ধ্যার পর কার্ফু দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সন্ধ্যার পর কাফু হয়, ভারতীয় সৈন্য এবং মিত্র বাহিনী শহরে টহল দেয়, আর এর জন্যই তারা এখন রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমান। দীর্ঘ আট মাস পর নিশ্চিন্ত ঘুম। যশাের থেকে মাত্র ১৮ মাইল দূরে এখনাে লড়াই হচ্ছে। তবুও মানুষ স্বস্তিতে ঘুমােন।
শহরে ধীরে ধীরে দোকানপত্র খােলা শুরু হয়েছে, যদিও সংখ্যায় কম। শহরে প্রহরারত ভারতীয় সৈন্যরা একটু অবসর সময়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একটি কাপড়ের দোকানে দেখলাম দুই জন মারাঠা সৈনিক শাড়ীর রং পছন্দ করছে এবং দাম জিজ্ঞেস করছে। আর তার পাশে একজন বাঙালী মিষ্টি হেসে ঐ সৈনিকের স্ত্রীর রং কি আর এর সঙ্গে কোন শাড়ীর রং মানাবে সেই বিষয়ে তার মন্তব্য করছে। অনেকটা বন্ধুর মতাে। আমি অবাক হয়ে এসব দেখছিলাম।

সূত্র: কালান্তর, ১৩.১২.১৯৭১