বরিশালের অভ্যন্তরে ২
(প্রথমাংশ পাওয়া যায়নি)
কোন লােকের জীবনের যেমন নিরাপত্তা নেই তেমনি সসইত্তরও কোন নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিন ডাকাতরা আক্রমণ করছে, লুঠ করছে খুন করছে।
এই পরিস্থিতিতে মুক্তিফৌজের সামনেও বিরাট দায়িত্ব। তারা নিজেদের জীবন রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব ও নিয়েছে।
নারীর সমভ্রম নষ্টকারী ও পাঞ্জাবী সৈন্যদের দালালরা মুক্তিফৌজের হাতে প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে। যেখানেই ঘটনা ঘটছে মুক্তিফৌজ তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দালালদের হত্যা করে দোষীদের শাস্তি দিয়েছে।
গ্রামের পর গ্রামে মুক্তিফৌজের লোেকরা লুঠের মাল ফেরত দিতে বাধ্য করেছে। অতর্কিত আক্রমণে দাঙ্গাকারী দলকে প্রতিহত করে গ্রামবাসীদের রক্ষা করেছে।
তেমনি একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে : জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বরিশাল ও খুলনা জেলার সীমান্তে নদী পাড়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন নিঃস্ব শরণার্থীরা। বাড়ির মালিক হিন্দু না মুসলমান সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে আজ ভাগটা ধর্ম হিসেবে নয়, ভাগ স্বাধীনতার পক্ষে না পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষে সেই হিসেবে। তবে হ্যা, দালালরা বেশীর ভাগই ধর্মের দিক থেকে মুসলমান।
ঘটনার আগের দিন কয়েক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। শরণার্থীসহ বাড়ির মালিকরা সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাই নবাগত শরণার্থীদের বাড়ীর মালিক সাবধানও করেন ডাকাতদের সম্পর্কে। কিন্তু কারুরই করার কিছু ছিল না। রাত ২টা পাশাপাশি ২টি বাড়ীতে ডাকাতদল আক্রমণ করে একই সঙ্গে। দলে তারা ত্রিশজনের মত। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। দরজায় লাথি ও হুঙ্কার চলতে থাকল। কয়েক মিনিট ধরে এই আক্রমণে ভীত শরণার্থীরা আরও সস্ত্রস্ত হলেন। এই সময় হঠাৎ একটু দূর থেকে পাল্টা গুলির শব্দ ও জয় বাঙলা ধ্বনী শােনা গেল। দুপক্ষে গুলি বিনিময়ের পর ডাকাতদল চলে যেতে বাধ্য হয়। আর যাবার সময় ডাকাতি প্রতিহত করেছেন যারা, তাদের এমন একজনের নাম করে শাসিয়ে যায় যে হিন্দু ও তাঁর সেচ্ছাসেবীরা প্রায় সবাই মুসলমান।
ডাকাতরা চলে যেতেই মুক্তিফৌজের লােকরা এসে সকলকে আস্বস্ত করেন ও বলেন- “ভয় নেই, আমরা আছি। আবার বিপদের সময় দেখা হবে।”
হাজার হাজার বরিশালবাসী ফরিদপুর ও খুলনার অধিবাসীদের সঙ্গে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসছেন জীবনের আশঙ্কায় ও জীবিকার অভাবে। পথে পথে ডাকাত, পাকসৈন্য ও দালালদের আক্রমণের ভয়। মুক্তিফৌজ ও সমর্থকরা সেখানেও তৎপর।
বরিশাল ও খুলনা সীমান্ত থেকে ভারত সীমান্তের দূরত্ব প্রায় দেড়শ মাইল। এই পথ পায়ে হেটে অতিক্রম করতে হয়। পয়সা থাকলে কিছু কিছু পথ নৌকায় পাড় হওয়া যায়। জলে কাদায় শিশু ও বৃদ্ধদের কেউ না কেউ প্রতিদিনই মরছেন। অদ্ধাহার-অনাহারে ক্লিষ্ট শরণার্থীরা পথ ধরে দলে দলে এগুচ্ছেন। অন্ধকার পথ। হঠাৎ রাস্তার মােড়ে হুঙ্কার মালপত্রবাহী গরুরগাড়ীগুলিকে অন্য পথে যেতে হবে। শরণার্থীরা গাড়ির সঙ্গে যেতে পারবেন না।
সকলে জিনিসপত্রের মায়া ছেড়ে প্রাণ নিয়ে অন্য পথে গেলেন। পনের মাইল যাওয়ার পর তারা দেখেন ১১টি গাড়িই আছে। তার মধ্যে তিনটি গাড়ির জিনিস পত্র লুণ্ঠিত, অপর গাড়িগুলির চালকরা মালিকদের নিজ নিজ মালপত্র বুঝিয়ে দিলেন। তারা জানলেন- “তারা মুক্তিফৌজ। তাই যথাসাধ্য মালপত্র রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
পথে পথে অশান্তি সৃষ্টিকারী তথাকথিত শান্তি কমিটির লােকরাও সংবাদকে তৎপর। এদের হাত থেকে মুক্তিফৌজের সময়ােচিত সাবধানবাণীতে একটি পিরবার রক্ষা পেলেন :
দু’ভাই ও দু’বােন ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলেছেন। শান্তি কমিটির সভাপতির নজর পড়ল দু’বােনের উপর। তিনি সাধুতার নামে তাদের নিজ বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য থাকবার আমন্ত্রণ জানালেন। মুক্তিফৌজের লােক আগেই সাবধান করে দেওয়ায় তারা জীবন ও সম্ভম রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
আর এক জায়গায় দিনের বেলাতেই অশান্তির নায়ক এক শান্তি কমিটির পাণ্ডাকে মুক্তিফৌজের লােকেরা সময়ােচিত মৃত্যুদণ্ড দেয়।
পথে এমনিভাবেই মুক্তিফৌজ তাদের দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে চলেছেন।
ক্লান্ত শরণার্থীরা সীমান্তের অদূরে এসে পৌঁছেছেন। এমন সময় পাকসৈন্যরা আক্রমণ করে ১ জন মেয়েকে হত্যা করে এক জনকে আহত করে। আর পাঁচ হাজার শরণার্থীর যথাসর্বস্ব লুঠ করার সঙ্গে সঙ্গে ছয় জন যুবতীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। শরণার্থীরা সবাই আতঙ্কিত। যে যার জিনিষপত্র ফেলেও পালাতে উদগ্রীব। এমনই অবস্থা যে, এক পরিবারের মা-বাবা ২টি সন্তান নিয়ে একদিকে যেতে বাধ্য হলেন। আর দুটি সন্তান অন্যদের সঙ্গে রয়ে গেল। ২ জন লােক তাদের জিনিষপত্র নিয়ে দ্বিতীয় দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দল জলে ডোেবা পাট ক্ষেতে নেমে গেলেন। জিনিষপত্র মুটেদেরই দিয়ে দিতে চাইলেন। মুটেরা বললেন- একটু অপেক্ষা করুন অন্য লােক দিয়ে জিনিষ পত্র পৌঁছে দেওয়া হবে। সেই মত সব জিনিষ তারাই সীমান্তের এপারে পৌঁছে দিলেন।
বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিফৌজের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। এ কথা জানিয়ে বর্ষীয়ান জনেনেতা তার দীর্ঘ যাত্রা পথের বহু অভিজ্ঞতার কয়েকটি ঘটনা আমাদের জানিয়েছিলেন। [ঘটনার সময় স্থান ও ব্যক্তিদের নাম নিরাপত্তার স্বার্থে জানানাে হল না।]
সূত্র: কালান্তর, ২০.৭.১৯৭১