চট্টগ্রামের রণাঙ্গন থেকে
[সফররত আমাদের প্রতিনিধি]
[প্রথম অংশ পাওয়া যায়নি]
সবাই জানেন ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী কিভাবে শিশু, বৃদ্ধ, নারী নির্বিশেষে বেপরােয়া কোতল করে চলেছে, মায়েদের, বােনেদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছে। বোেমা ফেলে গণহত্যা চালাচ্ছে। এই সব পত্র পত্রিকায় রেডিওতে দৈনন্দিন সংবাদ। কিন্তু এ সংবাদ আজও প্রকাশিত হয়নি কী সুপরিকল্পিতভাবে শতশত বাঙালী অফিসার ও সৈন্যদের জেটিতে, ব্যারাকে ব্যারাকে নির্বিচারে মেশিন গান, মর্টার, ট্যাংক চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের এক অসম্পূর্ণ বিবরণ আমি বিভিন্ন সামরিক অফিসার, সৈন্য, ছাত্র প্রভৃতির কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পেরেছি। আমার বিবরণ মূলতঃ চট্টগ্রাম সম্পর্কেই। এই হত্যাভিযান থেকে যারা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছেন তারাই আজ মুক্তিফৌজের স্তম্ভ। হত্যাভিযানের রাতেই এরা গড়ে তােলেন দুর্জয় প্রতিরােধ যে প্রতিরােধের সামনে হানাদাররা আজ নাস্তানাবুদ হচ্ছে।
পাক সামরিক জুন্টার বিশ্বস্ত ভৃত্য ইয়াহিয়া ঢাকায় আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছে শেখ মুজিবরের সংগে। দীর্ঘ আলেচনার আর প্রতিনিয়ত উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় রয়েছে চট্টগ্রাম জেটিতে তার সৈন্যবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র অবতরণের খবরের জন্যে। আলােচনায় ইয়াহিয়া সাহেব একটা আশার বার্তাবরণ সৃষ্টি করতে সমর্থ, হয়েছিল নিঃসন্দেহে। যদিও এই ধােকাবাজী সম্পর্কে বহু সামরিক অফিসার ও উচ্চতম সিভিল সার্ভেন্টারা অনবরত উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছিলেন আর হুশিয়ারী ও দিচ্ছিলেন। তবুও ইয়াহিয়া শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার জালিয়াতি সাফল্যের সংগে বজায় রাখতে পেরেছিল। তাই যখন সে স্বমূর্তি ধারণ করল তখনই সমগ্র দেশটাকে আর সংগঠিতভাবে প্রতিরােধের মধ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এরই জন্যে প্রতিরােধ গড়ে উঠতে না উঠতেই ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী প্রচণ্ড আঘাত হেনে এক চট্টগ্রামেই ২ হাজারেরও বেশী বাঙালী সামরিক অফিসার ও ফৌজকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিল। আর চট্টগ্রামের দুর্জয় প্রতিরােধ ও সেই রাত্রেই গড়ে উঠেছিল।
বর্বর হত্যাভিযান ও দুর্জয় প্রতিরােধ
চট্টগ্রাম জেটিতে সামরিক সাজসরঞ্জাম ও সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। ২৪ মার্চ দুপুরে খবর রটল যে আজ জেটি থেকে গােলাবারুদ সব আজই ক্যান্টনমেন্টে সরান হবে। ছাত্র ইউনিয়ন ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা মাইক দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে জনগণের কাছে আহ্বান জানালেন কাপাসখােলা জেটির সন্নিকটে জমায়েত হতে। ডক শ্রমিক, ছাত্র ও মধ্যবিত্তেরা হাজারে হাজারে কাপাসগােলায় জমা হতে থাকলেন। গ্রামাঞ্চলের কৃষকরাও কাতারে কাতারে আসতে থাকলেন। বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত জনসভা চলল। স্থির হল যে জেটি থেকে শুরু করে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তার সবটাই ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে হবে। শ্রমিক কৃষক ছাত্র ও মধ্যবিত্ত জনতা জেটি ও রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ফেলেন। জনতার আক্রোশ যেন ফেটে পড়তে চাইছে। তারা সমস্ত রকম হামলার মােকাবেলা করতে দৃঢ় পণ। সুশৃংখল ভাবে অপেক্ষা করছেন শত্রুপক্ষের পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য। সংখ্যায় তারা প্রায় ৬০ হাজার। নেতৃত্বের তরফ থেকে প্রথমে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা হল। জানা গেল তাকে টিক্কাখান দুপুরেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকা নিয়ে গেছেন। আর কোন দিন তিনি ফিরে আসবেন না। তার স্থলে নিযুক্ত হয়েছেন ব্রিগেডিয়ার আনসারী। আনসারীকে বলা হয় যে ২৫ মার্চের পর গােলা বারুদ স্থানান্তরিত কর ঐদিনে একটা সমঝােতা হওয়ার কথা আছে (!) তিনি এসব কথা শুনতে নারাজ। রাত ১১ টার সময় জেটির ৩নং ১৫ নং শেষ পর্যন্ত সবটা জুড়েই ফায়ারিং শুরু হয়। প্রচুর লােক হতাহত হল। কিন্তু রাস্তা পরিস্কার করা গেল না। লােক অবরােধ আরও দৃঢ় করতে লাগল। লড়াই শুরু হল।
৩০০ ইপিআরকে ফল-ইন করে খুন করা হল
ডক থেকে মাল খালাস করার জন্যে ক্যাপটেন আজিজ ও আরেক জন লেফট্যানান্ট সহ ৩০০ ইপিআর সিপাহী (সবাই বাঙালী) ডকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১১ টার সময় মাল খালাসের অজুহাতে রাইফেলগুলি জমা করে ফের পাকিস্তানী অফিসাররা। রাত একটায় প্রায় ওদের কর্ণফুলি নদীর পারে ৩ লাইনে ফলইন করান হল। এসব পরিচালনা করছিলেন বেলুচ রেজিমেন্টের কর্নেল শিকড়ি, মেজর কামাল এর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থলাভিষিক্ত ব্রিগেডিয়ার আনসারী। এই দুর্ভাগা সিপাইদের উপর তিনদিক থেকে মেশিনগানে গুলি বর্ষিত হতে থাকল। উপরােক্ত অফিসাররা সামনে থেকে এ হত্যাভিযানের তদারক করলেন। ক্যাপ্টেন আজিজ, সুবেদার থাকলেও নিহত হলেন এই সংগে। যেসব সিপাহীরা কর্নফুলী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল ন্যাভেল-বােট থেকে এদের জলের উপর হত্যা করা হল। ৩০০ জনের মধ্যে নায়েক বাদউল আলম ও আরেকজন সিপাই-এর মনে সন্দেহ জায়গায় ওরা আগেই সরে পড়ে ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে চলে যায়। এছাড়া মাত্র ১৩ জন। কোনক্রমে সরে পড়তে পেরেছিল। বাকীরা সবাই মেশিন গানের গুলিতে প্রাণ দিল।
ক্যাপ্টেন আজিজের সঙ্গী লেফটান্যান্ট কে এই ঘটনার পূর্বেই কোন এক অজুহাতে ৮ জন নাবিক সৈন্যসহ একটি জীপে করে পাঠান হচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টে। ঐ জীপের ড্রাইভার ছিল বাঙালী। তার মনে সন্দেহ জাগায় সে জীবটাকে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে এসেই হঠাৎ করে রেজিমেন্টের কোয়ার্টারে গার্ডের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। ৮ম বেঙ্গলের লাইনের সামনে দিয়েই ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার রাস্তা। পাকিস্তানী সিপাইরাই ক্ষিপ্র গতিতে নেমেই কোয়র্টার গার্ডের কমান্ডারের কাছে আলমারীর চাবি দাবি করে। গার্ড কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়াকে কন্ট্রাক্ট করে এবং অবস্থা জানায়। জিয়া কোয়র্টার গার্ডে এসে কর্নেল আবদুল রসিদ জানজুয়াকে (৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার) ফোনে আসতে বলেন। কারণ তার নাম করেই এরা চাবি চাইছিল। জানজুয়া কোয়াটার গার্ডে এলে এদের সবাইকে জানজুয়া সহ গুলি করে মেরে ফেলা হয়। রেজিমেন্টের অন্যান্য পশ্চিমী অফিসারদেরও গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এরপর ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে সমস্ত বাঙালী অফিসারও ফৌজ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র কালুঘাট সেতুর দিকে সরে পড়েন। অবশ্য রেজিেেমন্টে অস্ত্রশস্ত্র খুবই অল্প ছিল। আজ ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিফৌজের এক শক্তিশালী অংশ।
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার
১৫০০র মধ্যে ২০০ বেচেছে
ডকে ইপিআর-এর ৩০০ জন বাঙালী সিপাইকে হত্যা করার পর কর্নেল শিকড়ি ও কর্নেল ওসমানির নেতৃত্বে ট্যাংক, মর্টার, মেশিনগান সহ একদল পাঞ্জাবী সিপাই ইবিআরসিতে হানা দেয়। কর্নেল দুজন প্রথমে কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে গার্ডদের আর্মস ইনসপেকশন করবেন বলে ফলইন করিয়ে দেন এবং এদের নিরস্ত্র করেন। পরে তার বাহিনীকে সেন্টারের সমস্ত ব্যারক ঘিরে ফেলতে ও মেশিনগান ফিট করতে নির্দেশ দেন। ট্যাংক ও মর্টার আগেই পজিশন নিয়ে ব্যারাকগুলি কভার করে রেখেছিল। এই রেজিমেন্টাল সেন্টারে ১৭০০ বাঙ্গালী রিকুটে ছিল। রাত ২ টায় ঘুমন্ত অবস্থায় এদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চলে। মেশিনগান ট্যাংক ও মর্টারের এই পৈশাচিক হত্যাভিযানের হাত থেকে মাত্র ২০০ বাঙালী… পালাতে সমর্থ হয়েছিল। কারণ এরা সেন্টারের বাইরে ছিল। আর ১৫০০ বাঙালী নিদ্রিত অবস্থায়ই নিহত হয়েছিল। গার্ডদের অফিসাররা নিজেরই হত্যা করে।
৮ম বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন শহরে থাকতেন পরিবার সহ। তার সেন্টারে প্রচণ্ড গােলা বর্ষণের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন ই,বি,আর, সির কোম্পানী কমাণ্ডার। তারই জবানীতে এ হচ্ছে ঘটনার বিবরণ :
“গােলাগুলির আওয়াজ শুনে সন্দেহাকুল চিত্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিল আমার ব্যাটম্যান। আমার সেন্টারের এক কোম্পানী রাস্তায় টহল দিচ্ছিল যাতে জেটি থেকে অস্ত্র স্থানান্তরে জনতা বাধা সৃষ্টি না করতে পারে। কিন্তু এদের নিরস্ত্র অবস্থায় পাঠান হয়। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের রেজিমেন্টাল সেন্টারের দিকে। ওদিকে ফায়ারিং চলছে দেখে আমি ৮ম বেঙ্গলের লাইনের দিকে গতি পরিবর্তন করলাম। ৮ম বেঙ্গলের এক প্লাটুনকে ব্যাটারিয়ন পজিশন পাহারা দিতে দেখলাম। ওই নিকটবর্তী স্থানে বেসামরিক নাগরিকদের সংগে পাকিস্তানী সামরিক পদের লােকেদের সংঘর্ষ চলছিল এবং গুলিগােলা চলছিল। আবার গতি পরিবর্তন করে নাসিরাবাদ হাউসিং সােসাইটির দিকে চললাম। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শেখের বাসভবনে দেখলাম কয়েকজন পাঞ্জাবী অফিসার কি যেন সলাপরামর্শ করছে। সরে পড়লাম সেখান থেকে। বুঝলাম অবস্থা অত্যন্ত জটিল। অথচ আমি নিঃসঙ্গ। সাহায্যের জন্যে চলে গেলাম লালদিঘি ডি, আই, জি ও এস পির কাছে। তাদের কাছে কিছু অস্ত্র শস্ত্র কিছু পুলিশ ফোস চাইলাম। তারা ইতস্ততঃ করছেন দেখে ফোনে ডি, সির সংগে যােগাযােগ করলাম। তাকে অবস্থাটা জানালাম। তিনি ৫০টা রাইফেল ও এক হাজার গুলি দিলেন। গুলি সংগে করে আরও অস্ত্র ও সৈন্যের খোঁজে পাহাড়তলী পুলিশ ফাঁড়িতে গেলাম। সেখানে পেলাম আমার সেন্টারের ৮১ জন সিপাইকে। রাইফেল ও গুলি তাদের মধ্যে বিতরণ করে তাদের সঙ্গী করে নিলাম। ওখানেই ই,পি,আর এর এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন এর সঙ্গে দেখা হল। ওর কাছে কিছু অস্ত্রশস্ত্র চাইলাম। তিনি আমাকে বলেন যে হালিশহর থেকে আমার প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও গুলি গােলা সংগ্রহ করতে। তিনি আমাকে জানালেন যে তিনি সুনির্দিষ্ট খবর পেয়েছেন যে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক বাটেলিয়ন পাকসৈন্য চট্টগ্রামে আসছে। ঐ ব্যাটেনিয়নটিকে রাস্তায় এমবুশ করে ধ্বংস করে দিতে আহ্বান জানালেন। আর এদিক থেকে যে ১০০০ হাজার ন্যাভেল ফোর্স শহর আক্রমণ করতে আসছে তিনি তার অবশিষ্ট ইপিআর বাহিনী নিয়ে ওদের সঙ্গে লড়বেন। আমি তাড়াতাড়ি করে আমার ফোর্স নিয়ে হালিশহর রওয়ানা হলাম। ক্যাপ্টেন তার বাহিনী নিয়ে ন্যাভেল বেইসের কাছে এম, এ, এস টিলায় নিজের অবস্থান গ্রহণ করতে চলে গেলেন। হালিশহর থেকে আমি প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আবার পাহাড়তলী পুলিশ রিজার্ভে ঘুরে এলাম। এখানে আরও ৫০ জন সশস্ত্র ই,পি,আরকে অপেক্ষা করতে দেখে তাদেরও আমার দলভুক্ত করলাম। এখন আমার ফোর্সটার সংখ্যা দাঁড়াল ১৩১ জন আমি ছাড়া। এর মধ্যে মাত্র দু’জন জুনিয়র কমিশন অফিসার রয়েছেন। বাকী সবাই সিপাই। অস্ত্রের মধ্যে একটি হেভিমেশিন গান ও দুটি এল, এম জি বাকিগুলি সব রাইফেল।
জনসাধারণের সহায়তায় ৪টি ট্রাক সংগ্রহ করে তাদের যাত্রা করিয়ে দিলাম ঢাকা চট্টগ্রাম ট্রাংক রােড ধরে। আমি একজন অসামরিক দ্রলােকের মােটর বাইকে করে এ যাবত ঘুরেছিলাম। তারই বাইকের পেছনে বসে আমার বাহিনীর সঙ্গে চললাম। রাস্তা সার্ভে করতে করতে চললাম। কোথায় এমবুশ গড়া যায়। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে প্রায় ১৮ মাইল দূরে কুমিরাতে একটা উপযুক্ত জায়গাও পেয়ে গেলাম। রাস্তার পশ্চিম পাড়ে পাহাড় রয়েছে। ঐ পাহাড়ে আমার অবস্থানের উত্তর দিকের প্রান্তে মেশিন গানটা বসালাম ও ওটাকে গার্ড দেওয়ার জন্যে এক সেকশন সিপাই রাখলাম। রাস্তার কোল ঘেষে দক্ষিণ প্রান্তে এপারে ওপারে এল, এম জি বসালাম। বাকীদের ভাগ করে অর্ধেক পাহাড়ের উপরে অনেক রাস্তার পূর্বপারের গ্রামে বসালাম। আমার কমাণ্ডাপােষ্টটা রাস্তার দক্ষিণে রাখলাম। উত্তর থেকে ময়মানমতীর ব্যাটালিয়নটা আসবে। আমার ফরমেশনের আকার ইংরেজি ইউএর মত। রাত্রি প্রভাত হয়ে গেল ততক্ষণে। আমার আদেশ ছিল যে ব্যাটালিয়নটা মূলঅংশ আমাদের পজিশনের সম্পূর্ণ ভেতরে আসরে ফায়ার ওপেন করতে হবে। দুই তিন ট্রাক এভান্স গার্ড (advance guard) কে পাস দিতে হবে। আমার অবস্থান খুবই শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলাম। ভাের ৬টার সময় শত্রুর ব্যাটালিয়নের সাক্ষাৎ পেলাম। তিনটে গাড়ি মূল বাহিনী থেকে খানিক ব্যবধান রেখে আগে আগে আসছিল। আমার বাহিনী শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ আওতার ভেতরে না আসতেই ফায়ার ওপেন করেছিল। শত্রুদের অনেকেই প্রথম আঘাতে ধরাশায়ী হল। কিন্তু বাকীরা পজিশন নিয়ে কাউন্টার ফায়ার ওপেন করতে সমর্থ হল। আমি অবস্থাটা বুঝে দেখ যে এবারে যদি অন্ততঃ এক পন্টুন নিয়ে এদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ না করি তবে বেশীরভাগ শত্রুই পালাতে সমর্থ হবে। তাই তাড়াতাড়ি মােটরবাইকে করে রামগড়কে ফোনে কন্ট্রাক্ট করতে গেলাম। নিষ্ফল হলাম।
২৫ শে সকাল থেকে যখন রফিকও ক্যাপ্টেন ভুঞার বাহিনী লড়ে যাচ্ছে তখন সমগ্র চট্টগ্রাম শহরে জনগণ এবং বিশেষভাবে ছাত্র ও শ্রমিকরা লড়তে থাকেন। চিটাগাং-এর টিলায় টিলায়, মহল্লায় মহল্লায় বাঙালী ইপিআর ছাত্র শ্রমিক সবাই প্রাণপণে লড়ে চলেছেন। ডক ইউনিয়নের ডক শ্রমিকরা ডকটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছেন। ৩/৪ দিন পর্যন্ত ডকে আগুন জ্বলতে থাকে। চিটাগাং হারবার দিয়ে আর কোন ভারী সময় সরঞ্জাম ট্যাংক ইত্যাদি নামান অসম্ভব।
এই ডক কয়েক বছরে গড়া হয়েছিল একে আর সত্বর কাজে লাগাবার সকল সম্ভাবনা দূর হর। বীর ডক শ্রমিকেরা ইয়াহিয়াকে এক চূড়ান্ত আঘাত হানলেন।
শহরের এই লড়াই সম্ভবতঃ ২৯ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। হানাদারবাহিনী বহু ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ল। কোথায় যে তারা শক্তি সমাবেশ করবে স্থির করে উঠতে পারছিল না এ ছিল ব্যাপকতম গণ গেরিলা যুদ্ধ। বিপ্লবী ছাত্রেরা ২৫ শে মার্চ বেলা ১২ টায় হাবিব লিমিটেডের দুইটি অস্ত্র ও গােলা বারুদের গুদাম রেইড করে। ওখানে ৫ হাজার চায়নিজ রাইফেল ও ৮ ট্রাক গুলি গােলা পায়। এক হাজার রাইফেল তারা চট্টগ্রামের সংগ্রাম লিপ্ত জনতার হয়ে তুলে দেন, ২ হাজার তৎক্ষণাৎ বিতারিত হয় চট্টগ্রামের ইপিআরদের হাতে এবং ২ হাজার তারা মজুদ করেন নিজেদের ছাত্র বাহিনীর জন্যে। শহরে কদিন ব্যাপী আঘাতের পর আঘাত হানাদারদের মনােবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়ে ছিল। তাদের চোখে মৃত্যুর আতংক ফুটে উঠছিল।
সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত হানাদাররা স্নায়ু যুদ্ধে (Positional Varlor) অভ্যস্ত। কিন্তু যখন তারা গণ বাহিনী। দ্বারা সামনে, পেছনে, ডানে বায়ে যত্রতত্র আক্রান্ত হতে থাকল তখন তারা আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। মুক্তিবাহিনীকে যখন একটা ফ্রন্টে শেষের দিকে জমায়েত করা হল তখনই মাত্র তারা খানিকটা সাম্বৎ ফিরে পেল। তাদের অফিসাররা তখনই মাত্র তাদের পরিচালনা করতে পেরেছিল। ৫ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনী শহরে তাদের শেষ ঘাঁটি রেডিও স্টেশন ছেড়ে চলে এল।
কদিনের লড়াই ও শুধু ডক উড়িয়ে দিয়ে জলপথে বাঙলাকে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করা হয় নি, শুভপুরে ফেনী নদীর উপর গুরুত্বপূর্ণ সেতুটিও উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিবাহিনী ঢাকা ট্রাংক রােডকে অচল করে দিয়েছেন। স্থলপথেও চট্টগ্রাম আজ হানাদারদের কাছে বিচ্ছিন্ন। আমার সঙ্গী একজন বলেন বিপ্লবী সূর্য সেন স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীন চট্টগ্রামের আর ২৪ ঘন্টার জন্যে একে স্বাধীন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আমরা করব চট্টগ্রামকে চিরতরে স্বাধীন।
সূত্র: কালান্তর, ১৯.৪.১৯৭১