লালমণির হাটের লড়াই
(বাঙলাদেশ সফররত স্টাফ রিপাের্টার)
ধরলা নদী পার হয়ে মগলহাটে এসে পৌঁছুলাম। সঙ্গী আওয়ামী:ন্যাপের নেতা চিত্তবাবু বললেন, আপনাকে নিয়ে আর এগুবনা। এখান থেকে লালমনিরহাট বিমান বন্দর মাইল পাঁচেক দূরে। “
লালমনিরহাট বিমান বন্দর ইয়াহিয়া সৈন্যদের দখলে। তিস্ত ব্রীজও ওদের দলেই আছে। মুক্তিবাহিনী একে পূনর্দখল করার জন্য ১১.তারিখ রাত্রে প্রবলু, আক্রমণ করেছে। শহরের বেশ খানিকটা মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তে আসলেও বিমানবন্দর কিংবা তিস্তা ব্রিজ মুক্তিবাহিনীর আওতায় আসেনি।
এখানে বসেই লালমনিরহাট রণাঙ্গন সম্পর্কে ন্যাপ নেতার সঙ্গে কথা হলাে।
তিনি জানালেন ২৫ মার্চের আগেই লালমনিরহাট সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ্র গঠিত হয়। এই, সংগ্রাম পরিষদে আওয়ামীলীগ; ওয়ালী ন্যাপ, ভাসানী ন্যাপ-সকলেই ছিলেন।
এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-যুৰা সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করে।….
২৫ মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া সৈন্যদের আক্রমণের সংবাদ পৌঁছানাের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণ লালমনির হাটের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেট করে এবং বিমান, রুন্দর দখল করে। তিস্তা ব্রিজের ওপরুও ব্যারিকেট করে।
২ এপ্রিল তারিখে ইয়াহিয়া সৈন্য তিস্তা ব্রিজ থেকে, ৮ মাইল দূরে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী প্রতিরােধের সৃষ্টি করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রতিরােধে ইয়াহিয়া সৈন্যদের চাৱজন নিহত হয়। স্থানীয় কাউলিয়া থানার ওসি যে-ইয়াহিয়া সৈন্যদের রাস্তা দেখাচ্ছিল সেও মুক্তিঝহিনীর হাতে চরম শাস্তি পায়।
তিন তারিখে ইয়াহিয়া সৈন্য বাহিনী আবার আক্রমণ শুরু করে। তিস্তা ব্রিজের কাছে ঐদিনও মুক্তি বাহিনীর কাছে বাধা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া সৈন্য হারাগাছ রেডি হয়ে লালমনিরহাট বিশাল বন্দরে গিয়ে পৌঁছায় এবং বিমানবন্দরটি দখল করে ফেলে। রংপুর থেকে লালমনির হাট এই ১৮ মাইল পথের দুপাশের গ্রাম যেমন গারাগাছ, খুলিয়াগাছ, সরলখা, সারপুকুর, খুটামারা, হারিভাঙ্গা প্রভৃতি অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।
তিন তারিখে লালমরিনহাট বিমান বন্দরে ইয়াহিয়া সৈন্য বিমানে খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ করে।
লালমনির হাট বিমান বন্দর, উত্তর পূর্ব দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, তাই ইয়াহিয়া সৈন্য যে কোন ভাবেই একে হাতে রাখার চেষ্টা করছে।
অপর দিকে চার তারিখের পর মুক্তি বাহিনীর মনােবল আরও বৃদ্ধি পায়। বহু সরকারী কর্মী নূতন করে এসে মুক্তি বাহিনীতে যােগ দেয়।
১০ এপ্রিল মধ্যরাত্রে মুক্তি বাহিনী তিনদিক থেকে লালমনির হাটে ইয়াহিয়া সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করে। ইয়াহিয়া সৈন্যবাহিনী শহর থেকে সরে এসে সকলে বিমান বন্দরে আশ্রয় নেয়। মুক্তি বাহিনী ১১ তারিখ লালমনিরহাট শহরের অধিকাংশ দখলে নিলেও বিমান বন্দরটি তাদের আওতায় সম্পূর্ণ আনতে পারে নি। তবে মুক্তি বাহিনীর গােলাবর্ষণে বিমান বন্দরটির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে সেই কারণে ইয়াহিয়া সৈন্যবাহিনী এখনও সেখানে বিমান নামাতে পারেনি।
মগরহাটে বসে যখন লালমনির হাটের লড়াই এর গল্প শুনছিলাম ঠিক তক্ষুণি সেখানে ইস্ট পাকিস্তান এপ্রয়ীজ লীগের কয়েকজন কর্মী এসে হাজির।
রংপুর জেলায় এখন কোন রেল চলছে না। ইয়াহিয়া সৈন্যরা এই রাগে রেল কর্মীদের ওপর কি অত্যাচার চালাচ্ছে তার বর্ণনা দিলেন। লালমনির হাটে এ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রাফিক সুপারিডেটে সামাদ সাহেবকে ইয়াহিয়া বাহিনী হত্যা করেছে।
ইয়াহিয়া সৈন্যদের বেয়নেটের মুখে দাঁড়িয়েও ট্রেন চালানাের অস্বীকার করায় একজন ড্রাইভার একজন ফায়ারম্যান ও দুইজন রেলকর্মীকে রেলওয়ে কলােনী থেকে ধরে রাস্তায় দাড় করিয়ে ইয়াহিয়া সৈন্যরা হত্যা করেছিল ১ এপ্রিল তারিখে। এখন অবশ্য রেলকলােনী এবং শহর মুক্তি বাহিনীর দখলেই আছে বলে ওরা জানালেন।
সূত্র: কালান্তর, ২০.৪.১৯৭১