You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.19 | মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল পাক অধিকৃত এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলে | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল পাক অধিকৃত এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিফৌজের দখলে
[বাঙলাদেশ সীমান্ত সফরকারী ‘কালন্তর প্রতিনিধি]

ময়মনসিংহ সীমান্ত (বাঙলাদেশ) ১৮ জুলাই- আধুনিক সমরস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক চলমান সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রাম, প্রতিরােধ ও প্রতি আক্রমণ এবং পাকিস্তানী দালাল খতমের অভিযান বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের অভ্যন্তরে পাক দখলিকৃত এলাকায় মুক্তিফৌজ ও গেরিলা বাহিনীর দুদ্ধর্ষ ও ইতস্ততঃ আক্রমণ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া কুকুরদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে অথবা বন-জঙ্গল নদী-নালা অধ্যুষিত এলাকায় দিনের আলােতেও পাক বাহিনীর অবাধ্য গতিবিধি আজ সীমিত হয়ে গেছে।
মুক্তিফৌজের অতর্কিতে আক্রমণে টহলদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে গুলি করতে থাকে। মুক্তিফৌজও তার জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে ১ জন পুলিশ ও ৪ জন নিহত হয়। নৌকার আরােহী টহলদার দলের আরও ৬ জন প্রাণভয়ে নদীর জলে ঝাপ দেয়। তখন মুক্তিফৌজ চারদিকে এদের ঘিরে ফেলে এবং এই ৬ জনকেই গ্রেপ্তার করে। এই ৬ জনের মধ্যে রয়েছে নেত্রকোনা থানা ছােট দারােগা, মহকুমা এ্যাডজুট্যান্ট ও সহঃ এ্যডজুট্যান্ট, ১ জন পুলিশ ও ২ জন রাজাকার দালাল।
এই টহলদার বাহিনীর কাছ থেকে ১০টি রাইফেল ও একটি রিভলবার হস্তগত হয়।
জামালপুর মহকুমার নালিতা বাড়ি, দেওয়ালগঞ্জ প্রভৃতি থানাগুলাে মুক্তিফৌজ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়
ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে পিয়ারপুরে রেল লাইনে মুক্তিফৌজের একটি গেরিলা স্কোয়াড ‘মাইন বসিয়ে রাখে। এই রেলপথে পাকফৌজের পেট্রোল ট্রেনগুলি চলাচল করত আর আশপাশের গ্রামের কাছে ট্রেন থামিয়ে মুরগী, হাঁস, খাসি, ছাগল ও অন্যান্য জিনিস-পত্ৰ জোর করে লুট করত অথবা মাঝে মাঝে নাম মাত্র মূল্যে নিয়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গিনের মুখে তারা চালিয়ে যেত পৈশাচিক নির্যাতন। মুক্তিফৌজের কাছে এ সংবাদ পৌঁছায়। তাই তারা রেল লাইনে মাইন সংযােগ করে। ফৌজি টহলদারী ট্রেন যেমনি এগিয়ে আসছে সেই মুহুর্তেই মাইন বিস্ফোরণ ঘটে এবং ৪টি বগীসহ ট্রেনটি ছিটকে পড়ে ও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
এই মহকুমারই একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিফৌজের এক শক্তিশালী ঘাঁটির উপর পাকবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। তাই এলাকার প্রবেশমুখে কাটাখালি পুল ও মালজিকান্দা ফেরিঘাটের চলাচল পথটি অবরােধ করে রাখার জন্য পাক-জল্লাদদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছিল।
মাত্র কয়েকদিন আগে তরুণ মুক্তিযোেদ্ধা মহম্মদ নাজমুলের নেতৃত্বে এক দুর্ধর্ষ গেরিলাবাহিনী অতর্কিতে এবং সাহসের সঙ্গে এই কাটাখালি পুল ও মালজিকান্দা ফেরিঘাট সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকসৈন্যদের অবাধ চলাচল ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বানচাল হয়ে যায়। এই গেরিলাদল যখন নিজেদের গন্তব্য স্থলের দিকে এগিয়ে চলছিল তখন তিনদিক থেকে পাকবাহিনী এদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। গেরিলা দলের অধিনায়ক তরুণ বীর নাজমুল প্রতিরক্ষার সুযােগ নেই দেখে পেছন থেকে শত্রুর প্রতি ‘ফায়ার করতে থাকে এবং ৫৫ জনের গেরিলা বাহিনীকে দ্রুত সরে পড়ার নির্দেশ দেয়। এই তরুণ বীর অধিনায়ক নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রথমেই গুলিবর্ষণ করে পাকবাহিনীকে ‘পজিশন নিতে বাধ্য করে এবং সেই সুযােগে গেরিলাল রক্ষা পায়। কিন্তু নাজমুল শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।
সেদিন সন্ধ্যায় গেরিলা ঘাঁটিতে নাজমুলের জানাজা (শেষকৃত্য অনুষ্ঠান) পড়ার সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি পেয়েছিলাম।
দেখলাম, দলের অধিনায়ক বীর শহীদ নাজমুলের স্মরণে কয়েকশ’ তরুণ মুক্তিযােদ্ধার শত্রুকে নির্মূল করার কঠিন শপথ ঘােষণা। নাজমুলের বদলা চাই’ এই আওয়াজে যেন সমস্ত গেরিলা শিবিরটি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল।

সূত্র: কালান্তর, ১৯.৭.১৯৭১