You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ই জুন, বুধবার, ২৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

বিজয়ের প্রত্যয়ী শপথ হোক

বাংলাদেশের জনগণের জন্য বছরের সেরা সুসমাচারটি পাওয়া গেল। জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রবেশ পথে সবচাইতে বড় বাধাটি উৎরানো হলো। নিরাপত্তা পরিষদ গত সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কাছে বাংলাদেশের তার ১৩৬তম সদস্য করে নেয়ার সুপারিশ করেছে। আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক বসবে। বিশ্বসভায় তার যোগ্য ও যথার্থ আসন গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য এখন মাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার রইল। ইতিমধ্যেই সংঘের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক সদস্য বাংলাদেশের সাথে স্বীকৃতি বিনিময় করেছেন অবশিষ্ট দেশগুলি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলবে এটা আশা করা যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই সর্বজনীন স্বীকৃতি সহজে অজুপথে আসেনি। তা আসবার কথা ওর নয়। আমাদের স্বাধীনতা লড়াইটা ছিল দুই পক্ষের ঘোরতর বৈরীতার সৃষ্টি। যুদ্ধ কেবল বাংলাদেশের রণাঙ্গনে হয়নি। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চত্বরেও বেধেছিল। বৃহৎশক্তি, যাদের হাতে ভেটো ক্ষমতা, তারা দু’শিবিরে ভাগ হয়ে লড়ছিল। ১৯৭১ এর ষোলই ডিসেম্বরের পরও তার প্রতিক্রিয়া থেকে যায়। হারাপার্টি ও যেতা পার্টির বন্ধুবান্ধবরা ভাগাভাগি হয়ে স্ব স্ব বান্ধবকে সমর্থন করতে থাকে। কালক্রমে হারা দলের সমর্থন কমতে থাকে। এবং তা বোধগম্য কারণেই। এই প্রতিবাদশীল শক্তিসমূহের সংঘাতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের প্রবেশপথ করে নিতে হচ্ছে। কাজটি আপাতদৃষ্টিতে যতই অন্যায়সুলব্ধ বলে মনে হোক, বস্তুতঃ তা ছিল কঠিন। অস্বাভাবিক ধৈর্য, সাহস, তীক্ষ্মধি লক্ষ বিশ্বরাজনীতির ক্রমবিবর্তন ও পাশ পরিবর্তনের জোয়ার ভাটার প্রতিটি স্তরকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এবং বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সে কাজটি করেছেন। এসব কৃতিত্বের দাবী আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর। তিনি প্রতিটি কঠিন পরীক্ষায় শক্ত হাতে হাল ধরে বাংলাদেশের জনগণকে পাশ করিয়ে নিচ্ছেন। যারা এই কঠিন কুট প্রক্রিয়ায় তার সহকর্মী হয়ে, তার অনুগামী থেকে এবং তার সরকারের কর্মী হয়ে এই অসাধারণের পথকে ত্বরান্বিত করেছেন তাদের অবদানকেও খাটো করে দেখার কোন কারণ নেই। সকলের সচেষ্ট অবদান ছাড়া এতো বড় মহৎ কর্ম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
এ অবদান কেবল নেতাও কর্তাদের নয়, এদেশের জনগণের। একটি সভ্যভব্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য, নিজেদের গুটিয়ে গুছিয়ে একটি জাতি হিসেবে সংঘবদ্ধতা অর্জনে তারা তৎপর না হলে স্বাভাবিক নিয়মে একটি আইনানুগ সরকার প্রতিষ্ঠার কাজটি স্বাধীনতার পরপরই সম্পন্ন করতে না পারলে বাইরের শ্রদ্ধা আমরা পেতাম না-স্বীকৃতিও না। দেশের মূল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আজকের দিনের এই মহান কৃতিত্বের অংশীদার। আইনানুগ বিরোধীদলী গুলিও। ছোট হোক বড় হোক তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকে কাজ করার উদ্যোগ নিয়ে আমাদের জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। বাইরের বিশ্বে তার প্রভাব পড়বেই। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় শাসকদলের পাশাপাশি বিরোধী দলের একটি ভূমিকা থাকে। স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলির অস্তিত্বের গুণগত তাৎপর্য কম নয়। দুঃখ হয় কেবল তাদের জন্যই যারা ‘সশস্ত্র আক্রমণ’ দেশের নাম পরিবর্তনের কথা তুলে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণে বাধা দিয়ে চলছিলেন। তারা এই মহান বিজয়ের শরিক হতে পারলেন না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের কূটনীতির মূল সুর-কারো প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে বেড়ানো নয়, সম্ভাব গড়ে তোলা। বাংলাদেশের অস্তিত্বকে গ্রাহ্য করে তোলা। এই বাস্তববুদ্ধি আমাদের সাহায্য করেছে। সিমলা চুক্তি, দিল্লি চুক্তি এবং ত্রিপক্ষীয় দিল্লি চুক্তি দক্ষিণ এশীয় এই উপমহাদেশের নিজস্ব সমস্যাগুলি সমাধানের ‘মাইলস্টোন’ হিসেবে কাজ করেছে। কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলির সরকারপ্রধানদের সম্মেলন, আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সভা আমাদের সাথে বিশ্ব নেতাদের সমঝোতা দিগন্ত প্রসারিত করে। যে সকল বিশ্ববরেণ্য নেতারা বাংলাদেশ সফর করেছেন বা তাদের দেশে আমাদের নেতাদের আপ্যয়ন করেছেন তারাও অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে কম অবদান রাখেন নি। কারন তারা যে বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখছেন, এই বাস্তবতার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়বেই। এই সকল সভ্য আলোচনার যারা উদ্যোক্তা ও সমঝোতা বিধানে যাদের অবদান রয়েছে তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
নিরাপত্তা পরিষদের পনেরোটি সদস্য রাষ্ট্রের ঐক্যমতের ভিত্তিতে আমরা জাতিসংঘের প্রবেশের অনুমোদন পেয়েছি। এটা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ ইতিপূর্বে গণচীন আমাদের স্বীকৃতির প্রশ্নে আপত্তি করেছিল এবার জাতিসংঘে চীনের চার্জ দ্য এফেয়ার্স উপমহাদেশের পরিস্থিতি অনুকূল বিকাশকে স্বাগতম জানিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন, ‘বাইরের হস্তক্ষেপ’ বহির্ভূত থেকে এই অঞ্চলের ‘দেশগুলি’ শান্তি ও সম্প্রীতিতে বাস করবে। চীনের দৃষ্টিভঙ্গির এই গুণগত পরিবর্তন আনয়নে উপমহাদেশের দেশগুলির নিজস্ব ভূমিকা কম নয়। মানবিক সমস্যার সমাধান, পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশের বাস্তবতা উপলব্ধি, যুদ্ধাপরাধীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা নিজেরা নিজেরা করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক সমস্যা’ সমাধানের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি তা উপেক্ষণীয় নয়।
বাংলাদেশের জাতিসংঘের প্রবেশ আমাদের জন্য বিরাট কূটনৈতিক বিজয়। এত বড় বিজয় সমসাময়িককালে অন্য কোনো দেশ লাভ করতে পারেনি। কিন্তু এই বিজয় গর্বে বিমোহিত ও মাতোয়ারা হয়ে বসে থাকার ফুরসত আমাদের নেই। দেশের সামনে এখনো অনেক সমস্যা পড়ে রয়েছে, নতুন নতুন সমস্যা মুখ ব্যাদান করে আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত। দারিদ্র, ক্ষুধা, জরা, বেকারত্বের পাশাপাশি নৈরাজ্য, মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি ইত্যাদি সমস্যাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে। এবং সে কাজে এখনই হাত লাগাতে হবে। বিজয় উৎসব নয়, বিজয়ের প্রত্যয়ই আমাদের মূল শপথ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!