You dont have javascript enabled! Please enable it!

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে গুলি হয়। সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেক শহীদ রক্ত দেন। বঙ্গবন্ধু তখনও বন্দি। বন্দি থাকাবস্থায়ও ছাত্রদের সঙ্গে সবসময় তাঁর যােগাযােগ ছিল। তিনি যােগাযােগ রক্ষা করতেন এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন।১
পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, চিকিৎসক, গােয়েন্দা সংস্থার লােকজন, আত্মীয়স্বজন অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন।২ ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বরের গােয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওইদিন সকাল ৯টায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তাঁর কয়েকজন পুরােনাে বন্ধু: আনােয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হােসেন এমএনএ, তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, আহমদ হােসাইন এবং প্রায় ৩০ জন মেডিক্যাল ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।৩ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ৩০ নভেম্বর ১৯৫১ তারিখে সকাল ৯.১৫ মিনিটে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ। সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও জনৈক নজরুল ইসলাম। তারা ৯.১৫ মিনিট থেকে ৯.৪৫ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আব্দুস সালাম খান নামক এক গােয়েন্দা সদস্য একটু দূরে দরজার পাশে দাড়িয়ে থাকলেও, তারা কি বিষয়ে আলাপ করেন, তা শুনতে পাননি বলে ৩০ নভেম্বর ১৯৫১ তারিখের গােপন গােয়েন্দা রিপাের্টে উল্লেখ করেছেন।৪
১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আজিজ আহমদ; পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ; পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী ও সহসভাপতি কাজী গােলাম মাহবুব। তাঁরা সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে নানা আলাপ
—————–
১ শেখ হাসিনা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, চতুর্থ মুদ্রণ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা : জুলাই ২০১৮; পৃ. ৭৫
২ বিস্তারিত দেখুন : Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), Hakkani Publishers, Dhaka : February, 2019
৩ Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 116
৪ Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 123
————————–
করেন।১ এভাবে হাসপাতালের কেবিন থেকে নিরাপত্তা-বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ‘পুলিশের নজর ফাঁকি দিয়ে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলােচনা এবং ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে পরামর্শ প্রদান করেন।২ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে, সেখানে বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন।৩
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরে এসে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি পুনর্ব্যক্ত। করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা-বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলােচনা হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের। শুধু। তাই নয়, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর আহ্বায়ক যাতে ছাত্রলীগ থেকেই করা হয়, সে বিষয়েও শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশনা দেন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রােজনামচা এবং বিভিন্ন ভাষণে তিনি। বিস্তারিতভাবে বলেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন : “আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের। রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী। গােলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। … বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ।
———————-
১ “Extract from Secret information, dated 18.2.52 GOEB, Home Poll, F/N, 60648PF, Part-3; উদ্ধৃত, ড. সুনীল কান্তি দে, বায়ান্নে গােয়েন্দা নজরে শেখ মুজিবের দৈনন্দিন জীবন, গতিধারা, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০০৯; পৃ. ১৬।
২ ড. সুনীল কান্তি দে, বায়ান্নে গােয়েন্দা নজরে শেখ মুজিবের দৈনন্দিন জীবন, পৃ. ১৭।
৩ Dacca, 1 January 1952; Secret. “It has been reported that the Security Prisoner, Mujibur Rahman who, on the orders of H.P.M., was brought to Dacca for treatment is taking undue advantage of his coming to Dacca in furthererance of his political activity.” Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 137।
——————————–
নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তােয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। … সেখানেই ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত গঠন করতে হবে।১
কারাগারের রােজনামচায় তিনি আরও স্পষ্ট করে লিখেছেন : ‘জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। … আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গােলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মােল্লা জালালউদ্দিন, মােহাম্মদ তােয়াহা, নাঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরাে অনেকে গােপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।২ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গােলাম মাহবুবের আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়া, সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির শর্ত যুক্ত করা প্রভৃতি বিষয় পর্যালােচনা করলে এ বিবরণের বস্তুনিষ্ঠতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রাধান্য থেকেও এটা অনুধাবন করা যায়। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ‘অনেকে ইতিহাস ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের। আন্দোলনের তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার ওপর ও আমার দেশের। ওপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মােকাবেলা করতে হবে। সেখানেই গােপন বৈঠকে সব স্থির হয়।৩
———————-
১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯৬-১৯৭।
২ শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রােজনামচা, পৃ. ২০৪-২০৫
৩. শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ, ভালােবাসি মাতৃভাষা, অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি স্মারক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ১১ মার্চ ২০০২; পৃ. ৬
———————–
বস্তুত, জেল থেকেই তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্রনেতাদের গােপনে দিকনির্দেশনা দিতেন।১ শুধু তাই নয়, তিনি জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।২ এ প্রসঙ্গে ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছেন : ১৯৫২ সালের একুশের আন্দোলনে তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। কারাগারে থেকে নানাভাবে তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ওই সময়টায় তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে, তাই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। তখন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই ভবনে। অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গভীর রাতে রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আলােচনা করতেন।৩
ভাষা আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অন্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপ-আলােচনা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। বদরুদ্দীন উমর, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল মতিন, আহমদ রফিকসহ অনেকেই এর বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে মহিউদ্দিন। আহমেদ, অলি আহাদ, গাজীউল হক, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম আর আখতার মুকুল, শেখ আব্দুল আজিজ, জিল্লুর রহমান, কে. জি. মুস্তাফা, আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ ভাষাসংগ্রামী এবং মযহারুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, হারুন-অর-রশিদ, মুনতাসীর মামুন, আবু আল সাঈদ, নূহউল-আলম প্রমুখ গবেষক এর পক্ষে জোরালাে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বদরুদ্দীন উমর পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২-র ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার কথা অলি আহাদের বক্তব্য-সূত্রে পরােক্ষভাবে স্বীকার করলেও; পরবর্তীকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় তা সরাসরি নাকচ করে
——————
১ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু সে অবস্থায়ও তিনি ওই আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হন।’-কবীর চৌধুরী, কেন তিনি জাতির পিতা’, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, মােহাম্মদ জিল্লুর রহমান (সম্পাদিত), বৈশাখী প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১১; পৃ. ৪৪
২ মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ঢাকা : জুন ২০১২; পৃ. ৩৭ )
৩ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কথামুখ’, এম আর মাহবুব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৩; পৃ. ৭।
———————

দেন।১ এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হলাে : “শেখ মুজিব ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, যে সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকারীদের বিপুল সংখ্যায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনেক সদস্য আত্মগােপন করে আছেন। এই পরিস্থিতিতে জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি লাভ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে তারও কোনাে ভূমিকা ছিল না এবং আন্দোলনের। পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়াটা সরকার নিজেদের জন্য অসুবিধাজনক বা বিপজ্জনক কিছুই মনে করেনি।২ বদরুদ্দীন উমরের এ বক্তব্য খণ্ডিত। কারাগারে ছাত্রনেতারা যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ভাষা। আন্দোলনের দিকনির্দেশনা নিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর। রহমান কর্তৃক ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যকে যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করেছেন একুশের গান রচয়িতা আবদুল গাফফার। চৌধুরী।৩ ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা প্রদান। সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের আগে থেকেই শেখ মুজিব জেলে ছিলেন। তিনি তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী জেল থেকে তার অনুগত সেপাইদের মাধ্যমে ছাত্রলীগের ও আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের কাছে। গােপনে চিঠিপত্র পাঠিয়ে আতাউর রহমান-শামসুল হক গ্রুপের আন্দোলনবিমুখতা সম্পর্কে সতর্ক করতে শুরু করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সরকার যদি ১৪৪ ধারা জারি করে, তাহলে আওয়ামী লীগ কমান্ডের নির্দেশ যাই হােক, ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীরা যাতে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়, সেই পরামর্শ দিতে থাকেন। সরকারি গােয়েন্দারা যখন টের পেল যে, । শেখ মুজিব জেলে বসে সরকারবিরােধী আন্দোলনে তার দল ও অনুসারীদের। উৎসাহিত করছেন, তখন আকস্মিকভাবে তাকে ১৫ অথবা ১৬ তারিখে
——————-
১ বিস্তারিত দেখুন : বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতকরণ ও তার নায়কেরা’, দেশ, কলকাতা : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
২ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতকরণ ও তার নায়কেরা’, দেশ, কলকাতা : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮
৩ বিস্তারিত দেখুন : আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি : কিছু কথা’, ভালােবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৫৬-৬৮
——————–
ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। … ফরিদপুর জেলে বসেও তিনি চিরকুট পাঠান, যেটি একুশ তারিখে একটু দেরিতে ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে পৌঁছে।১
বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যেকটি মত বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করে একুশের গান রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী আরও লিখেছেন : ‘উমরকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারেকাছেও তিনি ছিলেন না। … একটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলে পদে পদে যে ভুল হয়, ১৪৪ ধারা সম্পর্কে উমরের বালখিল্য উক্তিই তার প্রমাণ।২
আবদুল মতিন এবং আহমদ রফিক নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকা এবং ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে ইতিহাসের কল্পকাহিনি’ বলে অভিহিত করে লিখেছেন : ‘একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ দীর্ঘকাল পর বৃথাই একুশের আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে ‘মিথ’ তৈরির। চেষ্টা চলছে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, সে। চেষ্টা এখনাে চলছে এবং এজন্য দায়ী কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে।৩ আহমদ রফিক তাঁর ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব (২০১৭) গ্রন্থে আগের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে লিখেছেন : দীর্ঘকাল পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) ভূমিকা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা সঠিক তথ্য-নির্ভর ইতিহাস নয়। কেউ বলেছেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন কেউ বলেন পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা তারই, আবার কেউ দাবি করেছেন। ‘আন্দোলনের কর্মসূচি তাঁর কাছ থেকেই এসেছে। দাবিগুলাে এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসেছে যারা কমবেশি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।৪
আহমদ রফিক ও আবদুল মতিনের বক্তব্য পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, তাতে সুনির্দিষ্ট কোনাে তথ্য নেই, আছে ঢালাও মন্তব্য। তাঁরা বলতে
———————-
১ আবদুল গাফফার চৌধুরী, একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি : কিছু কথা, ভালােবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৫৭ ২ আবদুল গাফফার চৌধুরী, একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি : কিছু কথা, ভালােবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ৫৬-৬৮
৩ আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য, সাহিত্য প্রকাশ, তৃতীয় সংস্করণ, ঢাকা : ২০০৫; পৃ. ৮৫-৮৬
৪ আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব, সময় প্রকাশন, তৃতীয় মুদ্রণ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০১৭; পৃ. ১৪১
———————-
চেয়েছেন যে, ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি১ শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হয়ে কেন অসুস্থ অবস্থায়ই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হলেন না? তাঁদের দাবি ভাষা আন্দোলন ‘তখনও চলছে।’ এবং ২ মাস পর ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তব্য দেন, তার ফলে তাঁরা ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে তাঁর যুক্ত না থাকার ‘ঘটনা সঠিক বলে মনে করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন।২ তাদের এ বক্তব্য খণ্ডন করার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
প্রথমত, তারা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।৩ ওই সময়কার ইত্তেফাক, ইনসাফ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর মুক্তির সংবাদ ছাপা হয়। ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নিরাপত্তা বন্দী জনাব মুজিবর রহমানের মুক্তিলাভ’ শিরােনামের সংবাদে বলা হয় : রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র হইতে ঘােষণা করা হইয়াছে যে, বিখ্যাত নিরাপত্তা বন্দী জনাব মুজিবর। রহমান খানকে [ভুলবশত খান বলা হয়েছে গতকাল মুক্তি দান করা হইয়াছে।৪ অর্থাৎ, শেখ মুজিব কারামুক্ত হন ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। প্রকৃতপক্ষে, ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাে ভাষা আন্দোলন চলমানই ছিল না, তাতে শেখ মুজিবুর রহমান যােগ দেবেন কী করে? ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা। সংগ্রাম কমিটির সভায় ‘২৬.২.৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার৫ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু৬ হয়।
দ্বিতীয়ত, ফরিদপুর কারাগারে থাকাবস্থায় এবং কারামুক্ত হয়ে তিনি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ছিলেন না। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা ও শেখ মুজিবুর
———
১ শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তির অর্ডার পান ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে, মুক্তি পান ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। সূত্র : শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৫
২ আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য, পৃ. ৮৫
৩ Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 151
৪ দৈনিক ইনসাফ, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
৫ তাজউদ্দীন আহমদ, ২৫.২.৫২; তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২, চতুর্থ খণ্ড, প্রতিভাস, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ঢাকা : আগস্ট ২০১৪; পৃ. ৫১
৬ তাজউদ্দীন আহমদ, ২৫.২.৫২; তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৫৩
——————–
রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা১ থেকে এ তথ্য জানা যায়। ঢাকায় গুলি চালনা ও ধরপাকড়ের সংবাদ শুনে শেখ মুজিবুর রহমান অতিশয় মর্মাহত হন এবং শহীদদের শােকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দেন। একই সঙ্গে তিনি দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন এবং কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালাে বক্তব্য তুলে ধরেন এবং কারাবন্দিদের মুক্তির দাবি করেন। তিনি করাচিতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করান। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অলি আহাদ (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যােগ দেন) ভাষা আন্দোলনের দুই পর্বেই প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যােগাযােগ হতাে এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তা চলত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন : ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাঁহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযােগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দি মহিউদ্দিন আহমেদ ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন। .. ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে শেখ মুজিবর রহমানকে
———————–
১ ২৩ তারিখে একটা টেলিগ্রাম পেলাম ফরিদপুর জেল থেকে। রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সেখানে কয়েকদিন ধরে অনশন করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ। একুশের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে অনশনের কারণ হিসেবে তার প্রতিবাদও তারা যুক্ত করেছেন এবং সে সংবাদ জানিয়েছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদককে। এই টেলিগ্রামের ভিত্তিতে একটা খবর তৈরি করে আমি আজাদ পত্রিকায় দিয়ে আসি এবং তা যথারীতি মুদ্রিত হয়।’-আনিসুজ্জামান, কাল নিরবধি, তৃতীয় মুদ্রণ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা : আগস্ট ২০১৫; পৃ. ১৮০
————————
ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এই ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নারায়ণগঞ্জ নেতৃবৃন্দের সহিত শেখ মুজিবুর রহমানের। সাক্ষাৎ ঘটে।১
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখা হয়েছিল তখনকার মেডিক্যাল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র মির্জা মাজহারুল ইসলামের। তিনি শেখ মুজিবের পূর্বপরিচিত ছিলেন তাই হাসপাতালে একাধিকবার তার চিকিৎসার খোজখবর নেন। ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন : ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা বন্দি অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমি তখন এই কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র। দোতলায় ৮ নম্বর ওয়ার্ড-সংলগ্ন একটি কেবিনে তিনি থাকেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। রাউন্ড দেয়ার সময় প্রফেসরদের সঙ্গে আমরা যেতাম কিন্তু আমাদেরকে কেবিনে প্রবেশ করতে দিত না। আমি কোনাে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় আমাদের মাঝে প্রথম পরিচয় হয়, পরে ঢাকা এসেও বহুবার দেখা হয়েছে। একদিন বঙ্গবন্ধু এই মির্জা বলে আমাকে ডেকে তাঁর কেবিনের জানালার কাছে নিয়ে যান এবং ভাষা আন্দোলনের খোঁজখবর নেন। তিনি আমাকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।২
তখনকার গােয়েন্দা প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন ভাষাসংগ্রামী ও গবেষকের সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ছাত্রনেতারা গােপনে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর মুক্তির জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দেন। নাইমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, অলি আহাদ ও মােহাম্মদ তােয়াহা দেখা করেন এবং তাঁরা ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতেন। সরকার তাঁকে হাসপাতালে বসে রাজনীতি করার অপরাধে মেডিক্যাল বাের্ড গঠন করে এবং তাদের সুপারিশে তাঁকে অনেকটা সুস্থ বলে ঘােষণা দিয়ে আবার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়। কারাগারে থাকাকালে তিনি ও মহিউদ্দিন আহমেদ চিঠি দিয়ে
——————————
১ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সােসাইটি লিমিটেড, চতুর্থ সংস্করণ, চট্টগ্রাম : ফেব্রুয়ারি ২০০৪; পৃ. ১৩৬-১৩৭
২ মির্জা মাজহারুল ইসলাম, সাক্ষাৎকার; উদ্ধৃত, এম আর মাহবুব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৮৪
——————————–
সরকারকে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন।১
এভাবে পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, এক পক্ষ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা পুরােপুরি খারিজ করে দিয়ে বাহাবা নিতে চেয়েছে; অন্য পক্ষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সব কৃতিত্ব তার কাঁধে তুলে দিতে চেয়েছে। সম্প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তাঁর সম্পর্কে প্রণীত পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনসমূহ প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা কী ছিল, তা দিবালােকের মতাে সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে।২ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় কারাগারে বন্দি অবস্থায়৩ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যােগাযােগ হয়েছে, সরাসরি কথা হয়েছে এবং তিনি আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এবং সে নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ও ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথে নারায়ণগঞ্জে।
তাছাড়া কারাগার থেকে চিঠির মাধ্যমে৪, টেলিগ্রামের মাধ্যমে৫ ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথে নারায়ণগঞ্জে৬ এবং চিরকুট পাঠিয়ে শেখ মুজিবুর
————————
১ মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ঢাকা : জুন ২০১২; পৃ. ৯৯
২ ‘মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাজবন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলােচনা যে হতাে, এই তথ্য মেনে নিতে হয়, কারণ জিল্লুর রহমান ছাড়া অলি আহাদও এই তথ্য দিচ্ছেন।’-বশীর আলহেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা : ২০০৩; পৃ. ১৬৭
৩ ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে।’ -শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯৬।
৪ ‘একজন কয়েদিকে দিয়ে গােপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছােট ছােট করে চারটা চিঠি লিখলাম।’ -শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০০ ঐ
৫ আনিসুজ্জামান, কাল নিরবধি, পৃ. ১৮০।
৬ “তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনশনরত রাজবন্দি বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন ভাইকে মফস্বলের জেলে হাতকড়া দেওয়া অবস্থায় স্থানান্তরের সময় পুলিশ ও সরকারকে অমান্য করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ডাক দেওয়া ছিল এক ভয়ানক দুঃসাহসিকতা। … বঙ্গবন্ধুর সেন্ট্রাল জেল থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট দিয়ে পার হওয়ার কথা শুনে “নারায়ণগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে সাইনবাের্ড লাগানাে হয় “বাইতুল আমান”-এ। ছাত্রলীগের সম্পাদক বজলুর রহমান, ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে আমি, মিজানুর রহমান (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা), মুস্তফা মনােয়ার (পরবর্তীকালে বিটিভি প্রধান) প্রমুখ শেখ মুজিবের মুক্তি চাই স্লোগান দিয়ে স্টিমার ঘাটে গিয়েছিলাম।”
———————–
রহমান ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এটিও সত্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি ওতপ্রােতভাবে যুক্ত ছিলেন, এটা ১৯৪৮ সাল। থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা-বিবৃতি ও সমকালীন পত্র-পত্রিকার সংবাদ পর্যালােচনা করলেই প্রমাণিত হয়।
কারাগারে বসে তিনি এবং মহিউদ্দীন আহমদ ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করলে ভাষা আন্দোলন কর্মসূচিতে আসে উৎসাহ ও প্রেরণা। তাঁদের মুক্তির দাবি যুক্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি ভিন্নমাত্রা পায়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সভায় যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি যুক্ত ছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসভা হয়।১ ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দাবি করে। পােস্টারও দেওয়া হয়।২ ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয় : “Did zonal duty in the Sutrapur P.S. area with W/C Md. Yasuf on 19.2.1952 and this morning (20.2.52) a Bengali leaflet under heading “Hunger Strike of Sheikh Mujibar Rahman” and Mahiuddin was found to be distributed at defferent places of Dacca City.”৩ এছাড়া তাঁদের মুক্তির জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভায় আবেদন করা হয়।
সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় : পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গি কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে দীর্ঘ কারাবাস ও বন্ধ দিনগুলির নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উৎকণ্ঠার ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সব রাজনৈতিক কর্মী, বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনের আশু মুক্তির প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে এক আবেদনপত্র পেশ করিয়াছেন। স্বাক্ষরকারীগণ বলেন, সর্বশক্তি নিয়ােজিত করিয়া আপনারা পাকিস্তানে আইন ও নীতির শাসন,
——————–
১. মুস্তফা সারওয়ার, বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশ ও একুশের সুবর্ণজয়ন্তী’, ভালােবাসি মাতৃভাষা, পৃ. ১০৩-১০৪) > বশীর আল্হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৩৪৩
২ বশীর আল্হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৩৪৩
৩ Sheikh Hasina (edited), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of The Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Vol-2, (1951-1952), P. 140-141
———————–
সৌভ্রাতৃত্ব ও গণতন্ত্র কায়েম করুন। … আসুন আসুন, আপনারা পরিষদের ভিতরে আর আমরা বাহিরে পূর্ববঙ্গের রাজবন্দিদের বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনের মুক্তির দাবিতে আওয়াজ তুলি।১ শুধু রাজপথ এবং সভা-সমাবেশে নয়, বঙ্গীয় আইন পরিষদেও শেখ মুজিবুর রহমানের। মুক্তির দাবি তােলা হয়। তাঁর ‘অনশন পালন বিষয়ে আলােচনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বিলিতে আনােয়ারা খাতুন এমএলএ মুলতবি প্রস্তাব পর্যন্ত। উত্থাপন করেছিলেন।২
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মানবতার নামে’ শীর্ষক এক পৃথক। বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তির দাবি জানান।৩ রাজবন্দিদের অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন : “আমি জানিতে পারিয়াছি যে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। জনসাধারণ। অবগত আছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন হইতে মারাত্মক রােগে ভুগিতে ছিলেন এবং কিছুদিন পূর্বে চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহাকে রােগমুক্তির পূর্বেই আবার জেলে প্রেরণ করা হয়। মহিউদ্দিনের স্বাস্থ্যও দ্রুত অবনতির। দিকে যাইতেছে। এমতাবস্থায় আমরা সহজেই বুঝিতে পারিতেছি যে, এই অনশন ধর্মঘট তাহাদের ভগ্নস্বাস্থ্যের পরিণতি ঘটাইবে। তাহাদিগকে আটক রাখার সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষের অনমনীয় মনােভাব দেখিয়া আমি অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি। আমি মানবতার নামে সরকারের নিকট এই আবেদন করিতেছি যে তাঁহারা মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনকে মুক্তিদান করেন।৪
২৭ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ শরীরেও তিনি গ্রামের বাড়ি গােপালগঞ্জ থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে প্রাণহানির ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বিবৃতি পাঠান এবং শহীদদের শােকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে এসে নিরাপত্তা-বন্দিদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে তিনি একটি সংবাদ
—————-
১ সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
২ হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা : ২০১৩; পৃ. ৫১
৩ আহমদ রফিক, একুশের দিনলিপি, প্রথম মধ্যমা সংস্করণ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৬; পৃ. ৯৮
৪ দৈনিক ইনসাফ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

সম্মেলন আহ্বান করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : “আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যারা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের। পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উস্কানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম। হিন্দু ছাত্ররা কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, একথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম। লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচ ছয়জন লােক। মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান কি না? এত ছাত্র। কলকাতা থেকে এল, একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের। গদিতে থাকার অধিকার নেই।১
১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। জনাব মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতায় সরকারের স্বরূপ উঘাটন করেন। তিনি বলেন জনসাধারণের ন্যায্য দাবি আন্দোলনকে সরকার। রাষ্ট্রের ও এজেন্টদের বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরও চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, এরাও দুশমনের ওপর গণআন্দোলন সৃষ্টি করেছেন। আমার বিশ্বাস শত শত মানুষ আমাদের অনুসরণ করিতেছেন। তার মতে রাষ্ট্রে এর চেয়ে আর কোনাে আইন থাকতে পারে না।২
১৯৫২ সালের জুন মাসে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সমর্থন আদায় করেন এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তাঁকে দিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করান। বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব লিখেছেন : “একটা অনুরােধ করলাম, তাঁকে লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বােঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং । তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি বললেন,
—————-
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১২
২ সাপ্তাহিক সৈনিক, ৪ মে ১৯৫২
—————
“নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তাে আমার নীতি ও বিশ্বাস। তিনি লিখে দিলেন।১ করাচিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা করেন এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনের পর তা দূর হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেছেন : খাজা সাহেব ও লাহােরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়ােজন করলেন। … প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপির প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দুটাই। রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাদের ছিল না। তাদের বলা হয়েছে, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা।২
ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার এক সংবাদে বলা হয় : ‘জনাব রহমান [শেখ মুজিবুর রহমান) প্রকাশ করেন যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানে যথেষ্ট ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হইয়াছিল, কিন্তু সমস্ত খুলিয়া বলিবার পর সে ভ্রান্তি তাহাদের দূর হইয়াছে। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা আজ আর বাংলার দাবিকে অন্যায় মনে করে না। তাহাদের অধিকাংশই আজ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে সমর্থন করেন। জিন্না আওয়ামী লীগের মামদোতের খান, মানকীর পীর প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ বাংলার দাবির প্রতি কিরূপ মনােভাব পােষণ করেন তাহা জিজ্ঞাসা করা হইলে জনাব রহমান বলেন তাহা আমি বলিতে পারি না।৩
১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য চীন সফরে যান। সেখানে গিয়ে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন।৪ এতে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গভীর ভালােবাসা যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে যাঁরা যােগদান করেছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন ভারতের
———-
১ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১৬
২ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২১৮
৩ সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৩ জুলাই ১৯৫২
৪ হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, পৃ. ৫১
———–
মনােজ বসু। চীনের শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান প্রসঙ্গ এবং বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা উচ্চে তুলে ধরে। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন : “মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা হলাে মাঝে আরও কতকগুলাে হয়ে যাবার পর।… ছিয়াশি জন বক্তার মধ্যে বাংলায় মােট দু’জন পাকিস্তানের শেখ মুজিবুর রহমান আর ভারতের এই অধম।১ চীন সফরের সেই স্মৃতি স্মরণ করে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। … কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনােজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লােকের ভাষা। … আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনােজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লােক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তােমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লােকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।২
১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান। খানের সভাপতিত্বে আয়ােজিত ওই জনসভায় বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা কামরুজ্জামান, দেওয়ান মাহবুব। আলী, ইব্রাহিম ত্বাহা, সুলেমান খান, আশরাফ ফারুকী, মুহম্মদ এমাদুল্লাহ, গাজীউল হক প্রমুখ।৩ ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আরমানিটোলা মাঠে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে আরও একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বন্দিদের মুক্তি ও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকা থেকে জানা যায় : “গতকল্য (শুক্রবার) অপরাহে আরমানীটোলা ময়দানে পূৰ্ব্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের উদ্যোগে “বন্দীমুক্তি দিবস” উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন পূর্ব
————
১ উদ্ধৃত, নিতাই জানা (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮; পৃ. ৬৯-৭০
২ শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২২৮-২২৯।
৩. বশীর আলহেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, পৃ. ৫৮০
৪১
পাকিস্তান আওয়ামী মােছলেম লীগের সহঃ সভাপতি জনাব আতাউর রহমান। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আওয়ামী মােছলেম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, গত ভাষা আন্দোলনে। যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন সরকার তাঁহাদের সকলকে বিনা বিচারে জেলে আটক রাখিয়াছেন। … সৰ্বশেষে সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযােগে এবং অন্যান্য কারণে বিনা বিচারে আটক সব রাজনৈতিক বন্দির অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি দাবি করা হয়। অপর একটি প্রস্তাবে বিনা বিচারে আটক মওলানা আবদুল হামিদ খান। ভাসানী এবং অন্যান্য রাজবন্দির স্বাস্থ্য ভাঙিয়া পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ এবং সরকারের জেলনীতির তীব্র নিন্দা করা হয়। আর একটি প্রস্তাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানাে হয়।১
১৯৫৩ সালের শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তােলেন এবং উর্দুকে বয়কট করার ব্যাপারে সােচ্চার হন। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার এক জনসভায় তিনি ঘােষণা করেন, এ দেশ জুড়ে উর্দু বয়কট করার জন্য আন্দোলন শুরু করা হবে।২ এ বছর ৫ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার একটি জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে গােয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘বক্তৃতার সময় শেখ মুজিব বলেন, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এখানকার স্কুল-কলেজে নূরুল আমীন সরকার উর্দু চালু করেছেন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান তার স্কুল-কলেজে বাংলা চালু করেনি। তারা যদি বাংলাকে না মেনে নেয়, তাহলে কয়েক মাস পর আমরাও উর্দুকে বয়কট করব।৩
ভাষা আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ। দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনের আহ্বান জানান।৪ ওইদিন ব্যাপক। কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ঢাকার সর্বস্তরের মানুষ প্রভাতফেরি, শােভাযাত্রা,
————
১ দৈনিক আজাদ, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
২ উদ্ধৃত, মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, পৃ. ৯৬
৩ উদ্ধৃত, মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, পৃ. ৯৬
৪ সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩।
—————
শহীদদের কবর জিয়ারত এবং আলােচনা-সভার আয়ােজন করে। এতে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গােলাম মাহবুব এবং ছাত্রলীগ নেতা এম এ ওয়াদুদসহ অনেকে। ভাষা আন্দোলনের বর্ষপূর্তির সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। ঢাকা প্রকাশ-এ শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলা হয় : “আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব মুজিবুর রহমান সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, গত বৎসর ঠিক এমন দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর ভাষা বাংলাকে আজাদ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীতে ঢাকা শহরে ছাত্র ও জনসাধারণ নির্ভীকভাবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়াছে। তাহারা সেই দিন যে নতুন ইতিহাস রচনা করিয়াছে, সমগ্র জাতি তাহা চিরদিন শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিবে। ২১শে ফেব্রুয়ারীকে তিনি ‘জাতীয় কারবালা দিবস’ বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খােলা রহিয়াছে। হয় তাহারা। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলিয়া মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন। তিনি সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করিবার জন্যও দাবী। জানান।১ শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদানের দাবি তােলেন। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার গােপন প্রতিবেদনে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা সম্পর্কে বলা হয় : “দায়ী ব্যক্তি (শেখ মুজিবুর রহমান) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’-এ বিশেষ নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেন। ২১.২.৫৩ তারিখে ঢাকার একটি জনসভায় তিনি ঘােষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার ‘উর্দু বয়কট করার জন্য প্রদেশব্যাপী দাবি বা আন্দোলন দিবস পালন করা হবে। ২১.২.৫৩ তারিখ ‘শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে তিনি ঢাকায় একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেন।২ ওই দিনের বক্তৃতায় ‘যতদিন বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না পাবে, ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবার প্রতি তিনি আহ্বান জানান।৩
২১ ফেব্রুয়ারির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে গাজীউল হক গেয়েছিলেন তাঁর গান : ভুলব না, ভুলব না- একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না!’ বঙ্গবন্ধুর অনুরােধেই তিনি
——
১ ঢাকা প্রকাশ, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
২ উদ্ধৃত, বেবী মওদুদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার, পৃ. ৫৮
৩ উদ্ধৃত, মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, পৃ. ৯৫
—————-
গানটি ওই অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে গাজীউল হক লিখেছেন : ‘সভায় জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরােধে ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখা আমার গানটি আমাকে গেয়ে শােনাতে হয়। এখানে বলা প্রয়ােজন, ১৯৫৩-৫৪-৫৫ সালে যে গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতাে সে গানটি লিখেছিলাম আমি। গানটির প্রথম লাইন ছিল, ‘ভুলব না, ভুলব না- একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না!’ সময়ের প্রয়ােজনে এ গানটি লিখেছিলাম।১
১৯৫৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিসংবলিত শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ১১ মার্চ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে। যে আলােচনাসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান।২ ১২ মার্চ দৈনিক আজাদ-এ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবী’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয় : ‘গতকল্য (বুধবার) শহরের বিভিন্ন ছাত্রপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়। এই উপলক্ষে গতকল্য সৰ্ব্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কৰ্ম্মপরিষদের পক্ষ হইতে ছাত্র জনসাধারণের নিকট ব্যাজ বিক্রয় করা হয় এবং সন্ধ্যায় বার লাইব্রেরী হলে এক আলােচনা-সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব আতাউর রহমান। সভায় অধ্যাপক আবুল কাসেম, পূৰ্ব্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য আবদুল মতিন, আওয়ামী লীগের জমিরুদ্দীন আহম্মদ, গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী, প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবীতে বক্তৃতা করেন।৩
এভাবে দলিলগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অসামান্য। মূলত, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ঢাকার রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংযােগ স্থাপিত হয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জাগ্রত জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন এবং বাস্তবায়নে। তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে স্বাধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলােতে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ও জাতিসংঘে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু যে অবদান রেখেছেন, তার ফলে ইতিহাস তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।
——————–
১ গাজীউল হক, একুশের সংকলন ‘৮০, পৃ. ১৫৬
২ সাপ্তাহিক সংগ্রাম, ১৩ মার্চ ১৯৫৩
৩ দৈনিক আজাদ, ১২ মার্চ ১৯৫৩
————————

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!