You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের জন্য আমরা কি করতে পারি

বুধবার পশ্চিমবঙ্গে হরতালের ডাক এই রাজ্যের মানুষদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। তার কারণ, মানুষ এই মুহূর্তে বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সমর্থন প্রকাশ করার জন্য যে গভীর আকুতি বােধ করছেন সেটা এই হরতালের ভিতর দিয়ে রূপান্তরিত হতে পারে। যদিও একথা বলা যেতে পারে যে এমন একটা প্রচণ্ড আবেগ মথিত উপলক্ষে হরতালের উপযােগিতা নিতান্তই সীমাবদ্ধ, তাহলেও এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এই হরতালের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনােভাব একটা স্বতঃস্ফুর্ত অভিব্যক্তি লাভ করবে। এই হরতালেন মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেখানে কোন বিরােধ নেই সেখানে জনসাধারণের ঐক্য যাতে অটুট থাকে সেদিন লক্ষ্য রাখা প্রয়ােজন। এই হরতাল পরিপূর্ণ শান্তির মধ্যে, সম্পূর্ণ বিনা বাধায় উদযাপিত হওয়া উচিত। আমরা আশা করি যে, বুধবারের হরতালের উদ্যোক্তারা এবিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হরতালের পর কি? এটা আদৌ অস্বাভাবিক নয় যে, এই দেশের মানুষ প্রতিবেশী দেশের সংগ্রামীদের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট সাহায্য দেওয়ার জন্য বলতে গেলে অস্থির হয়ে উঠেছে। এই বাংলাদেশের মানুষগুলাে কয়েক বছর আগে আমাদেরই স্বদেশবাসী ছিল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের নাড়ীর যােগ রয়েছে। এই জীবনমরণ পরীক্ষার দিনে তাদের প্রতি এদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরতম তন্ত্ৰীগুলাে সহানুভূতির সুরে অনুরণিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেকথা ছেড়ে দিলেও সেখানে যা হচ্ছে সেটা বলতে গেলে ইতিহসের একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। অসামরিক শসনের বিরােদ্ধে সামরিক শসনের অভূত্থান আমরা দেখেছি, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসামরিক জনতা কতৃক সামরিক শাসনের অধীন রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকার, এমন দৃশ্য কে কবে দেখেছে? ভারতের মানুষ ঘরের পাশে বলেই এই ঘটনার তাৎপর্যটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করবে। সরকারি বিবৃতির মধ্য দিয়ে, লােকসভার সদস্যদের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে, দিল্লীর জনসভার মধ্য দিয়ে, কলকাতার ময়দানের জনসভার মধ্য দিয়ে, বােম্বাইয়ে ও অন্যত্র বিক্ষোভ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের প্রতি এদেশের মানুষের অভূতপূর্ব মমতা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে ঐ সংগ্রামী মানুষগুলির পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, যেভাবে হােক, তাদের সাহায্য করার জন্য একটা গভীর আকুতি।
এখন পর্যন্ত এই আকুতি অসংগঠিত ও বাস্তব পরিকল্পহীন। সকলেই বুঝছে একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু ঠিক কি করা দরকার অথবা কতটা করা যায় সেবিষয়ে কারও স্পষ্ট কোন ধারণা নেই। সেই কারণে পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার কোন চেষ্টা না করে যিনি যেমন বুঝছেন, কেউ পাকিস্তানি দূতাবাসগুলির সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। আসল কথা হল, মানুষের মধ্যে যে আবেগ দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযোেদ্ধাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবার জন্য যে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে হরতালের পর একটা সুনির্দিষ্ট, একমুখী কর্মসূচীর মধ্যে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নেই, সেই উদ্দেশ্যে তাদের সামনে নেতৃত্বেও রাখা হচ্ছে না। মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনাকে এভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে পারে। এমনকি এটা পশ্চিমবঙ্গের গতানুগতিক রাজনৈতিক রাজনৈতিক দলাদলির আরেকটি উপলক্ষে পরিণত হওয়াও সম্ভব। এই আগ্রহ-উদ্দীপনা যাতে একটা নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় সেজন্য নেতৃস্থানীয় মানুষের এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গেই এর বেশী প্রয়ােজন। প্রতিবেশী দেশের এই ঘটনা সম্পর্কে নয়াদিল্লীতে ভারত সরকার কি নীতি গ্রহণ করবেন তা আরও কয়েক দিন না গেলে বােঝা যাবে না। সরকারকে অবশ্যই অনেক ভাবনা-চিন্তা করে, চারদিক বাঁচিয়ে তাদের নীতি স্থির করতে হবে। তাহলেও বেসরকারি স্তরে মানুষ যদি সরকারি নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেও কয়েক পা এগিয়ে যায় তাহলে কোন ক্ষতি নেই এবং সরকারও তাতে বাধা দিতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আজ ঠিক কি ধরনের সাহায্য প্রয়ােজন তা যাচাই করার জন্য, প্রয়ােজনীয় সাহায্য সংগঠিত করার জন্য, সেই সাহায্য যথাস্থানে পৌছে দেওয়ার জন্য রীতিমত একটা সংস্থা গড়ে তােলা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে অবিলম্বে যদি সর্বস্তরের মানুষদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা শক্তিশালী কমিটি তৈরি করা হয় তাহলে এমন একটা সংগঠিত কর্মসূচী নিয়ে হয়তাে অগ্রসর হওয়া যাবে বাঙলা দেশের মানুষকে তাদের এই বিপদের দিনে সত্যিকার সাহায্য দেওয়া যাবে। আর তা না হলে সমস্ত আবেগই একটা নিরর্থক অপচয়ে পর্যবসিত হবে যেতে পারে অথবা ভুল পথে চালিয়ে হতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক না হয়ে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!