রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ১
খালেক নেওয়াজ খান
(খালেক নেওয়াজ খান ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ উভয় পর্বের ভাষা-আন্দোলনেই | সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ঐ সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের
—————
লেখাটি এম আর মাহবুবের ভাষাসংগ্রামের স্মৃতি গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
——————-
সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ পিকেটিং করার সময় গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫২ সালেও গ্রেপ্তার ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।]
ভাষা আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকেই আমি এই আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। আসলে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় দেশভাগের। সঙ্গে সঙ্গেই। ভাষা আন্দোলনের সূচনায় তমদুন মজলিসের একটি বিশাল। ভূমিকা ছিল। এই সংগঠনের উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আমি উক্ত সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনটি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয়। আমি ছিলাম এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিকে সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ছাত্রলীগ নানা কর্মসূচি পালন করে। এই আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের আঞ্চলিক কর্মীদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করি এবং তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চালিয়ে যান। ২ মার্চ ১৯৪৮ সালে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম গঠিত হয়। আমি উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলাম এবং আমাকে এই কমিটির সদস্য মনােনীত করা। হয়।
আমরা ১১ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করি। আমি ঢাকা এবং ঢাকার বাহিরে বার্তা পাঠিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘবদ্ধভাবে হরতাল সফল করার আহ্বান জানাই। এ সময় প্রতিটি দিন আমার প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যে অতিবাহিত হয়। ১১ মার্চ পিকেটিং করতে গিয়ে আমি সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হই। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখা হয়। এ সময় আমার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকেই কারাবন্দি ছিলেন। ১১ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়েছিল। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল খুবই স্মরণীয়। ১১ মার্চের পর সরকার অনেকটা নমনীয় হয়ে যায়। তারা ১৫ মার্চ চুক্তি করে। আমরা চুক্তির শর্ত মােতাবেক মুক্তি লাভ করি। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে আমরা শ্লোগান দিতে দিতে তৎকালীন পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হই। রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহর ভাষণে আমরা ক্ষুব্ধ হই এবং প্রতিবাদ করি।
১৯৪৯ সাল থেকে ১১ মার্চ আমরা রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করি। ১৯৫১ সালে আমিসহ আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা ১১ মার্চকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য পত্রিকায় একটি বিবৃতি প্রদান করি, যা ৮ মার্চ, ১৯৫১ সালে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ১১ মার্চ আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সভার আয়ােজন করি। আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভা থেকেই আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সেদিন। আমি আমার বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ভাষার লড়াই চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে ছিলাম। নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘােষণা করে আন্দোলনকে চাঙ্গা করে তােলে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দীনের উর্দুর পক্ষের বক্তৃতায় আমরা প্রতিবাদ করি। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমার সভাপতিত্বে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকেই ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র-ধর্মঘট এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় সভা হয় সেখানে আমি উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করেছিলাম। এ সভায় কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলে সেখানে আমি সদস্য মনােনীত হই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা দলে-দলে আমতলার সভায় উপস্থিত হই। সেখানে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পিকেটিং করতে থাকলে পুলিশ গুলি চালিয়ে অনেককে আহত এবং কয়েকজন ছাত্রকে হত্যা করে। আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে হতভম্ব হয়ে যাই। ২২ তারিখ থেকে লাগাতার বিভিন্ন কর্মসূচিতে আমি অংশগ্রহণ করি। ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকার আমিসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। আমাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় এক বছর জেলজীবন শেষে ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি লাভ করি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ময়মনসিংহের নান্দাইল নির্বাচনী এলাকা থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনকে পরাজিত করেছিলাম।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম