You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায়১
গাজীউল হক

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অত্যন্ত বিরাট, বলা যেতে পারে এটি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই বিশাল প্রেক্ষাপটে ততােধিক বিশালত্ব নিয়ে বিরাজিত একটি নাম-শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অপরটির। সঙ্গে এমনি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে, একটিকে ছেড়ে অন্যটি কল্পনাতে আসে। না। একে অপরের সাথে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কে জড়িত। তাই এসব বিষয়ে কিছু বলতে গেলে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আসতেই হয় আমাদের।
————-
১ লেখাটি ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালােবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ। থেকে সংকলিত।
————–
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের আগেই প্রস্তাবিত পাকিস্তানের শাসকদের স্বরূপ উন্মােচিত হতে থাকে এবং একই সঙ্গে এ অঞ্চলের তখনকার যুবসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষার চিন্তা করতে শুরু করে। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল কোলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হােটেলের একটি কক্ষে। সে বৈঠকে। উপস্থিত ছিলেন হাতেগােনা কয়েকজন-কাজী ইদ্রিস, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান আরও কয়েকজন। আলােচ্য বিষয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের যুবসমাজের। করণীয় কি? এর কয়েকদিন আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এক নিবন্ধে বলেছিলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আজাদে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ড. জিয়াউদ্দীনের উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি প্রস্তাব দিলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি রাষ্ট্রভাষা হয় তবে গণতন্ত্রসম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। একাধিক রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল তখনকার প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার ধারক যুব-সম্প্রদায়কে। এরই ফলশ্রুতিতে সিরাজউদ্দৌলা হােটেলের বৈঠকটি আয়ােজিত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অসাম্প্রদায়িক যুব-সম্প্রদায়ের সম্মেলন ডাকতে হবে। বৈঠকের নেতৃবৃন্দ ঢাকা পৌছালেন, ঢাকার ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। উনিশ-শ সাতচল্লিশ সালের ৬-৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন। আহ্বান করা হলাে।
ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাড়িতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; কারণ এই সম্মেলনে বাধা। সৃষ্টি করেছিল খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকার এবং তার অনুগ্রহপুষ্ট গুণ্ডারা। ৭ই সেপ্টেম্বর সম্মেলনে জন্ম নিলাে পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলাে পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন-
“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে।
তৎসম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।” এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল। উচ্চারিত হয়েছিল নিজের মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকারের দাবি। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করার দাবি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে ভাষার যে দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তা সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হলাে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম ভাগে। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে তাকে প্রকাশ্যভাবে ধিক্কার দিলেন লিয়াকত আলী খান। তিনি এবং রাজা গজনফর আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ব্যক্ত করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দীন বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়।
ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলাে। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসল। সভায় আপােষকর্মীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপােষ করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটি বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠল, ‘সরকার কি আপােষের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হযে। থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তােয়াহা, মােগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপােষকামীদের ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেল। এ সম্পর্কে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে অলি আহাদ বলেছিলেন-“সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌছাতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতাে না।”
১১ মার্চ হরতাল হয়েছিল, পিকেটিং হয়েছিল সেক্রেটারিয়েটের সামনে, সেখান থেকে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁর অপর সাথী অলি আহাদ, শামসুল হক সাহেব, শওকত সাহেব এবং অন্যদের সঙ্গে। ১১ মার্চের আন্দোলন তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা পূর্ব পাকিস্তানে। বেগতিক দেখে খাজা নাজিমুদ্দীন আপােষের কথা তুললেন।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনার পর ৮ দফা সমঝােতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলাে। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যেহেতু বঙ্গবন্ধুসহ ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন, সেহেতু চুক্তির খসড়া কারাগারে নিয়ে গিয়ে। তাতে তাদের সকলের সম্মতি নেয়া হয়। শর্তানুসারে ১৫ মার্চ নেতৃবর্গ মুক্তি পেলেন। বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন পুলিশি জুলুম ও । সরকারের গণবিরােধী ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাদের দাবি আদায়ে বদ্ধ। পরিকর। মুজিব জনতার মনের কথাটি ধরতে পারলেন। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হলাে। সভার সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সভা শেষে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে তিনি ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে ব্যবস্থাপক সভা ঘেরাও করেছিলেন। সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জ হয়েছিল, কাঁদানে গ্যাস ছােড়া হয়েছিল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেদিন সংগ্রামী ছাত্রসমাজ সমস্ত ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
মুজিব তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। মিছিল করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেছিল শত সহস্র ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে বেলতলায় জমা হয়েছে। সবাই পরবর্তী ঘােষণার জন্যে। শামসুল হক চৌধুরী, গােলাম মওলা, আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে সংবাদ পাঠিয়েছেন শেখ মুজিব-খবর। পাঠিয়েছেন তিনি, সমর্থন জানিয়েছেন একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি। একটি বাড়তি উপদেশ-মিছিল করে সেদিন আইনসভা ঘেরাও করতে হবে, বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। আরও একটি খবর পাঠিয়েছেন যে, তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে।
অনশনের নােটিশ দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর। করা হলাে ১৬ ফেব্রুয়ারি। যাবার কালে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে তাঁর। সঙ্গে দেখা করলেন জনাব শামসুদ্দোহাসহ আরাে অনেকে। তাঁদের বঙ্গবন্ধু জানালেন তাঁর এবং মহিউদ্দিন সাহেবের অনশনের কথা। অনুরােধ করে গেলেন যেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল-মিছিল শেষে। আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়। ৮ ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবসহ সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সভা হলাে। সেই সভায় জানানাে হলাে একুশের হরতালের প্রতি দৃঢ় সমর্থন। একুশের রক্তাক্ত সংগ্রাম মুসলিম লীগ সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলে। সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত বঙ্গবন্ধু তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ােগ করলেন স্বৈরাচারবিরােধী গণতান্ত্রিক ভাষা। আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত ও বিকশিত করার জন্য। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দিলেন। জনাব কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি কেটে দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ছাত্রলীগে রূপান্তরিত হলাে। ১৯৫৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে জয়পুরহাটে আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুপারিশ করা হয়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে। আওয়ামী লীগে পরিণত হলাে। বঙ্গবন্ধু ‘৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে এবং মিছিল শেষে সভায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেছিলেন, তারই সফল স্বাধীন বাংলাদেশ; বাহাত্তর সালে বাংলাদেশের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি ঘােষণা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নির্বাসন।
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। তাঁর চিন্তা-চেতনায় ছিল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি বিধানের সংকল্প। বাঙালিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ চেতনা ছিল সর্বদা সক্রিয়। এ ব্যাপারে তিনি আমৃত্যু ছিলেন আপােষহীন, কঠোর। বাঙালি জাতি তার এই অনন্য সাধারণ ভূমিকার কথা কখনাে ভুলবে না।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!