বঙ্গবন্ধুর কারাসঙ্গী : ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি১
মহিউদ্দিন আহমেদ
আমাকে অনুরােধ করা হয়েছে বিগত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও সেই সম্পর্কিত ঘটনাসমূহ বিবৃত করে একটি লেখা দেয়ার জন্য। হয়তাে মাঝে মাঝে আমার অজ্ঞাতে কখনও দু-এক লাইন মনে রাখার জন্য লিখি। কিন্তু ছাপানাের জন্য লেখা দিতে হবে, এ আমার কল্পনারও বাইরে। ঘটনা ঘটেছে ‘৫২ সালে, ৫০ বছর আগে। আজ এই জীবন সায়াহ্নে, স্মৃতি থেকে লেখা প্রায় একটি অসম্ভব ব্যাপার। ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু পুলিশ আর সরকারের হামলায় তা যে কতবারই না নষ্ট হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।
১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে যে জাতীয়তাবাদের আভাস ছিল এবং পরবর্তীকালে কনভেনশন ডেকে তা বদলিয়ে দুই অংশকে একটা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেদিন থেকেই জাতীয়তাবাদীরা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। র্যাডক্লিফের রােয়েদাদ এই আশঙ্কাকে আরও তীব্র করে তােলে। পূর্ব পাকিস্তানে যখন মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা। হিসেবে প্রবর্তন করার প্রস্তাব দেন জিন্নাহ সাহেব, তখন ভাষার প্রশ্নটা তত্ত্বগত দিক ছাড়িয়ে আরও ব্যাপক হয়ে পড়ে। একটা স্বাধীন দেশের ভাষাকে বদলে ফেলার প্রশ্নটা, বাস্তবতা নিয়ে দেখা দেয়। স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব বিতর্কিত হয়ে পড়লেন। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটা তখন শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয়, গােটা পাকিস্তানীদের কাছে জাতীয় প্রশ্ন আকারে দেখা দিল।
এই সময় আমি মুসলিম লীগের কোপানলে পড়ি এবং আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। হঠাৎ সরকার আবিষ্কার করে যে, বরিশাল জেলে যেহেতু পৃথকভাবে রাখার কোনাে ব্যবস্থা নেই এবং কমিউনিস্টদের সাথে রাখার জন্য তাদের মতাদর্শে আকর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু আমাকে অবিলম্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করা হােক। যে চিন্তা, সেই কাজ। সেই দিনই বিকেলে আমার হাতে হাতকড়া পরলাে,
————————-
১ লেখাটি ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০। বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালােবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
—————
কোমরে দড়ি দিয়ে পুলিশ লাইনে রাখা হলাে। সময়টা ১৯৫০ সালের প্রথমদিকের। পরের দিন ঐ অবস্থায় স্টিমারে করে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলাে। | জেলের মধ্যে বিভিন্ন জিনিসের নামকরণে নিজস্ব ভাষা আছে, যেমন রান্নাঘরকে চৌকা বলা হয়, ওয়ার্ডকে বলা হয় খাতা। আমাকে নেয়া হলাে ৫ নং খাতায়। নিচের তলায় কম্বল বুনানাে হয়। সিড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে প্রথমেই দেখা হলাে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। কৈশাের এবং যৌবনের মাঝামাঝি কালে মুজিবের সাথে আমার দেখা হয়। বিভিন্ন ঘটনাকালে শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে, মুসলিম লীগ কাউন্সিলে। পরবর্তীকালে সে দেখা গভীরতর হয় এবং রাজনৈতিক রূপ নেয়। আমাদের মধ্যে সংঘাত ও কলহ, বন্ধুত্ব, সহৃদয়তা সবসময়ই ছিল। আমাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ কখনই ক্ষীণ হয়নি। সেই শ্রদ্ধাবােধ মুজিবের জীবনের শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। তাই তাে তাকে ভুলতে পারি না এবং সেই কারণেই তাঁকে নিঃশর্ত নেতা হিসেবে গ্রহণ করতে কোনাে দ্বিধাই আমার ছিল না। ৫নং ওয়ার্ডে রাজনৈতিক বন্দি আর একজনও ছিল না, যদিও আরও ১০/১২ জন দ্বিতীয় শ্রেণির সাজাপ্রাপ্ত কিছু আসামী ছিল। বাইরে থাকতে তাদের কেউ কেউ রাজনীতি করত, এমন দু-চারজনকে আমি চিনতে পারি।
মুজিব আমাকে দেখে আশ্চর্য কি হবেন, এমন জোরে পেঁচিয়ে ধরলেন যে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, এদিকে কিন্তু আমার চোখে পানি এসে গেছে, মুজিবকেও দেখছি আড়ালে চোখ। মুছছেন। আমাদের খাট দুটি পাশাপাশি দেয়া হলাে। জানতে পারলাম, যে কারণে আমাকে বরিশাল থেকে আনা হয়েছে সেই একই কারণে মুজিবকেও। ৫নং খাতায় রাখা হয়েছে।
১৯৪৮ সালে জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘােষণায় বাঙালির মনে যে। আগুন জ্বালিত হয়েছিল, তা এক মুহূর্তের জন্য প্রশমিত হয়নি। ধিকিধিকি করে তা প্রতিটি বাঙালির মনে জ্বলছিল। জ্বলছিল আমাদের মনেও। জেলের ভেতরে এই সময় আমরা তীব্র অসহায়ত্ববােধ নিয়ে দারুণ মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম। আমরা কর্মী, রাস্তায়ই আমাদের জীবন, রাস্তায় এই সময় আমরা থাকতে পারছি না, এই মর্মবেদনা ঢাকবাে কি করে? দীর্ঘকালের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছিল একই ধাঁচে। তাই এই বন্দী অবস্থাকে প্রথমবারের মতাে আমাদের কাছে অসহ্য মনে হচ্ছিল। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে এই মর্মবেদনা আরও তীব্র হয়ে উঠলাে। এই সময় থেকেই মাঝে মাঝে মিছিলের স্লোগান কারাপ্রাচীর ভেদ করে ৫নং খাতায় আমাদের কানে পৌঁছতে লাগলাে। এ বিষয়ে আমরা কামরার ভেতর থেকে বাইরের এসে আলােচনা করতাম। এই আলােচনার প্রধান বিষয়বস্তু। ছিল এই বন্দি অবস্থা থেকে কিভাবে আমরা আন্দোলনে অবদান রাখতে পারি, কিভাবে এই আন্দোলনকে পরিচালিত করতে পারি, কিভাবে বাস্তব রূপ দিতে পারি। পরামর্শ করে ঠিক করা হলাে যে, মুজিবকে যে কোনাে প্রকারেই হােক বাইরে পাঠাতে হবে। কোনােভাবেই যেন আমাদের মনের ইচ্ছা কর্তৃপক্ষ জানতে না পারে, সেজন্য সমস্ত বিষয়টি আমরা গােপন রেখেছিলাম। ঠিক হলাে, মুজিব অসুস্থতার ভান করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবেন। সেভাবেই মুজিবকে ডাক্তারের সাহায্যে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করাতে সক্ষম হলাম।
জেলের মধ্যে এখন আমি একা, বন্দি জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলাে। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকলাম। একদিন মুজিব আবার ফিরে আসলেন; ফিরে আসলেন সাফল্যের বার্তা নিয়ে। বাইরে নেতৃবর্গের সাথে আলােচনা হয়েছে এবং ‘৫২ সালের প্রথমদিক থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে তীব্রতর করে মিছিল ও জনসভায় দেশকে কাঁপিয়ে তুলতে হবে। এ্যাসেম্বলির বৈঠককালীন ১৯, ২০, ২১ ফেব্রুয়ারিতে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে।
আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম চরম উত্তেজনায়। পি.সি. থেকে টাকা তুলে রাতে মিলাদ পড়ালাম ভােলার মওলানা মমতাজকে দিয়ে। তারা জানলাে না কেন এই মিলাদ। শুধু আমরা মােনাজাতে মনে মনে বললাম, “আল্লাহ, দেশবাসীর মনের আশা পূরণ করাে।” সংক্ষেপেই জেলের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে একটি বিরাট পদক্ষেপ উত্তীর্ণ হয়েছি বলে…। প্রখ্যাত উকিল রেজায়ে করিম ও মাশাহের মাজারের মাঝখান। দিয়ে নাজিমুদ্দিন রােড জেলখানার প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে। সেখানে দাড়ালে ৫নং খাতা দেখা যায়। আন্দোলনরত মানুষ সে খবর কেমন করে জেনে গেছে জানি না। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মিছিল করে সেখানে এসে দাঁড়াতাে আর স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতাে। মুজিব আর আমি সেখানে গিয়ে তাদের অভিনন্দন জানাতাম আর অন্তরে অন্তরে কথা বলে আসতাম। আমরা আবার অসহায় হয়ে পড়লাম। আগের সকল বিজয়, মুজিবের হাসপাতালের সাফল্য যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল। রাস্তায় রাস্তায় অগণিত মানুষের ঢল, সেই জনস্রোতের সাথে আমরা থাকতে পারছি না-কেমন করে মনকে এ দুঃখ থামাবার জন্য বুঝ মানাবাে?
মুজিব বললেন, ‘মহিউদ্দিন বলাে এখন কি করি?’ আমি বললাম, তুমি বলাে।’ মুজিব বললেন, “রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আমরা আমরণ অনশন ধর্মঘট করবাে। জেল আমাদের জীবনত্যাগের তাে আর বাধা দিতে পারবে না। এখন তুমি বলাে।” “আমার মনে হয়, এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত”-আমি মত দিলাম। যথারীতি কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত পাঠালাম এবং দেশবাসীর কাছে একটি ইস্তেহার লিখে বাইরে পাঠালাম ছাপিয়ে বিলি করার জন্য। সরকার থেকে বহু বাধা-বিপত্তি আসা সত্ত্বেও আমাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। এত চেষ্টা করেও সরকার যে আমাদের কমিউনিস্ট হওয়া বন্ধ করতে পারেনি সেজন্য নিশ্চয়ই তারা আফসােস করেছে। আমাদেরকে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি দিয়ে ফরিদপুরের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলাে এবং এখনও পুরাে কমিউনিস্ট হইনি-এই ভরসায় আমাদেরকে সরাসরি হাসপাতালের নির্জন কক্ষে রাখা হলাে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যতােই জোরদার হচ্ছিলাে, ততােই মুজিবকে ও সাথে সাথে আমাকেও কর্তৃপক্ষ সমীহ করতে লাগলাে। তাদের ধারণা। জন্মেছিল যে, জেল থেকে মুজিব বের হবেনই এবং ক্ষমতায় যাবেন। ইতিমধ্যে ফরিদপুর ও দেশের অন্যত্র মুজিবের মুক্তির দাবিতে মিছিল বের হতে শুরু করে।
দীর্ঘদিন অনশনে আমাদের উভয়েরই স্বাস্থ্য খারাপ হলাে। ইতিমধ্যে খবর আসলাে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি হয়েছে এবং ছাত্র নিহত হয়েছে, শুনে আমরা কাতর হয়ে পড়লাম। আমরণ অনশন ধর্মঘট করলেও সব সময় যেমন এর উদ্দেশ্য থাকে-আন্দোলনকে সাহায্য করা, তেমনি একটা সময় আসে যখন নেতৃবৃন্দ এসে অনুরােধ করলে অনশন ভঙ্গ করা হয়। কিন্তু ঢাকায় গুলি হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত নেতৃবর্গ হয় গ্রেফতার হয়েছে। নয়তাে পলাতক। আমরা প্রমাদ গুনলাম। আমরা মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই। চিন্তা করতে পারছিলাম না। মুজিব দীর্ঘস্থায়ী অনশনের জন্য দৃঢ় প্রত্যয়। ঘােষণা করলেন। আমিও তাতে সায় দিলাম। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, এই হত্যাকাণ্ড গােটা আন্দোলনে নতুন মাত্রা সংযােজিত করেছে এবং খুনী পাকিস্তানি সরকারকে গদিচ্যুত করার সংগ্রাম গণসংগ্রামে রূপান্তরিত হবেই। জানতাম সেই সংগ্রামই আমাদের মুক্তি এনে দেবে।
ইতিমধ্যে একটি অসম্ভব ঘটনা ঘটলাে। অনশন জেলের মধ্যে আইনবিরােধী হলেও দাবি আদায়ের জন্য এটা একটা স্বীকৃত সংগ্রাম। অনশনে থাকাকালীন কোনাে বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে এটা বিরল ঘটনা। কিন্তু শেখ মুজিবকে অনশনে থাকাকালীন অবস্থাতেই মুক্তি দেয়া হলাে। মুজিব চলে যাওয়ার সময় তাঁকে আমার বিছানার কাছে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হলাে। একি, মুজিব কাঁদছেন! হায়রে! আমিও কাঁদছি! একি দুঃখ, না। কোনাে অজানা যাত্রাপথের শপথ!
মুজিব ছাড়া আমার পক্ষে এখন জেলে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠলাে। কর্তৃপক্ষ দু’চার দিনের মধ্যে একই অবস্থায় আমাকেও ছেড়ে দিল।
আমরা একটি জাতির দেশ ও ভাষা দুটোই হারিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থাকলাে না-হলাে পূর্ব পাকিস্তান। বাংলা কথা থাকলাে না-থাকলাে উর্দু। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী। মুজিবের নেতৃত্ব ও সময়ােপযােগী কর্মসূচি বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষাকে রক্ষা করে। তাইতাে মুজিব হাজার মানুষের প্রাণের নেতা-এই জাতির পিতা। অনন্তকাল ধরে জাতি এই মহান নেতাকে স্মরণ করবে।
স্বাধীন বাংলার চিন্তা তাঁকে সব সময়ই আকুল করে রাখতাে। মুজিবের গােটা সংগ্রামই ছিল সেই লক্ষ্যে পরিচালিত। আমার মনে আছে, ১৯৫০ সালের আগে কাগমারীতে কৃষক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। মুজিবও সেখানে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে টাঙ্গাইলে মুজিবের নির্দেশে হাতেম তালুকদার ‘স্বাধীন বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিল। খণ্ডিত পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের অধীনে রাখার তাত্ত্বিক রূপ দেয়ার প্রয়াসে জিন্নাহ সাহেব দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা করেন। মুজিবের প্রত্যেকটা পদক্ষেপেরই উদ্দেশ্য ছিল এই ‘তত্ত্ব’কে আঘাত করা, একে পরাজিত করা। মুজিব পাকিস্তান দাবিকে মনে করতেন পশ্চাৎপদ মুসলমানদের জন্য একটা রেনেসাঁ। দ্বি-জাতিতত্ত্বকে তিনি কোনােদিনই মেনে নেননি। ভাষার দাবি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে সচেতন জাতি হিসেবে। মুসলিম লীগকে ১৯৫৪ সালে ২১ দফা দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনে পরাজিত করে বাঙালি তার জাতীয়তাবাদকে আরেক দফা এগিয়ে নেয়। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির এই জাগরণে ভীত হয়ে ১৯৫৯ সালের নির্বাচন বাতিল করার লক্ষ্যে সামরিক শাসন জারি করে। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি, দুই স্বার্থ-এই চিন্তাকে দৃঢ় করার জন্য পাকভারত যুদ্ধের সূচনা করা হয়। যুদ্ধকালে আরেক দফা প্রমাণ হয় অর্থনীতি ও দেশরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে কত অসহায় করে রাখা হয়েছে। লাহােরে মুজিব ১৯৬৬ সালে ৬ দফা পেশ করে যে সাহসিকতার নিদর্শন রেখেছিলেন তা ছিল আমার চিন্তার বাইরে। এই সাহসিকতা ছিল মুজিব চরিত্রের সহজাত বৈশিষ্ট্য। তড়িৎগতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া, সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর। করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগের প্রত্যয় ছিল মুজিব চরিত্রের অন্য আর একটি দিক। যুদ্ধে কিংবা আটক অবস্থায় তাঁকে আমি দেখেছি, অটল নিঃশঙ্ক। নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসার জন্য কখনও নমনীয় মনােভাব প্রকাশ করেননি তিনি। তাই মুজিবের দাবি, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবিতে রূপ নিয়েছিল, ইয়াহিয়ার সাথে আলােচনাকালে তিনি সেই দাবি থেকে এক পা পিছু হটেননি। অবশেষে সেখান থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ।। মুজিবের আশা জনগণের আশায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
আজ মুজিব নেই, তার চলে যাওয়া আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে বলে আমার। সর্বক্ষণ মনে হয়। তাঁর মতাে নেতা, তার মতাে বন্ধু আজকের কষ্টি পাথরে যাচাই করা যাবে না। রাজনৈতিক মুজিব একটি ধারা, একটি চিন্তা, একটি যুগ। তার বাস্তব জ্ঞান ছিল তীক্ষ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে তার ভূমিকাকে কখনােই খাটো করা যাবে না। তিনি চলে গেছেন, নিঃস্ব করে গেছেন জাতিকে-সেই সাথে আমাকেও।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম