ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ
শেখ মুজিব রহমান
এক. বড় দুঃখের দিনে ছাত্রলীগের জন্ম। আপনাদের পক্ষে সেদিনের চিন্তা করাও কষ্টকর। ১৯৪৮ সালের কথা, যেদিন আজকের এই ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ফজলুল হক হলের কমনরুমে, সেদিনটি ছিল ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৪৮। তখন দেশে বিরােধী কোনাে রাজনৈতিক দল ছিল না।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলাে। সেইদিন বুঝতে বাকি রইল না যে, বাংলাদেশকে উপনিবেশ করার জন্য, বাংলার মানুষকে শােষণ করে গােলামে পরিণত করার জন্য তথাকথিত স্বাধীনতা এসেছে। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৪৭ সালে কলকাতার পার্ক রােডের সিরাজউদ্দৌলা হােস্টেলে একটা ঘরােয়া বৈঠক করি। সেখানে আমার সহকর্মী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বলেছিলাম, “আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।”
কলকাতা থেকে বিএ পাস করে এলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে। রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, বাঙালির জাত শেষ হয়ে গেছে। সেইদিন শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সালেই হলাে আমাদের সংগ্রামের সূচনা। ১৯৪৮ সালে তারা আমার ভাষা ও আমার কৃষ্টির ওপর আঘাত হানলাে। বাংলা ভাষাকে ভুলিয়ে আমাদের উর্দু শেখানাের চেষ্টা হলাে। জিন্নাহ সাহেব। ঢাকায় এলেন। এই ময়দানেই বক্তৃতা করে জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেন, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। তার ওপরে তখন কথা বলে এমন কার ঘাড়ে কটা মাথা ছিল? তবুও প্রতিবাদ করেছিলাম। এইখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল বাংলার ছাত্রসমাজ। প্রতিবাদ করেছিল বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ। অবশ্য আমাদের তখনও ঘাের কাটেনি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকায় আমি গ্রেফতার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে। বলাবাহুল্য, সেদিন ছিল মহা দুঃখের দিন। রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আমরা আন্দোলন করতাম। সেদিন অক্টোপাসের মতাে চারদিক থেকে বাংলাকে এবং বাঙালিকে শেষ করার ষড়যন্ত্র চলছিল। ছাত্র ভাই ও বােনেরা, অতএব অতীতের এইসব কথা মনে করেই ছাত্রলীগের সম্মেলনে আমাকে আসতে হয়। বহুদিন আমি বক্তৃতা করি না, আর বক্তৃতা করার ইচ্ছাও আমার নাই। তবুও যখন ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা শুনলাম, তখন অসুস্থতা সত্ত্বেও না এসে পারলাম না।
আমাদের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় রয়েছে ১৯৪৮-৪৯ সালের ধর্মঘট, ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, তারপরে ৯২(ক) ধারা আমলে ফজলুল হক সাহেব ও আমার গ্রেফতার। ১৯৪৮ থেকে ‘৫৮ সালের মধ্যে বহুবার কারাবরণ করেছি। তারপর এলাে ‘৫৮ সালের সামরিক আইন ও আইয়ুব খানের চোখরাঙ্গানি, ‘৬২ সালের গ্রেফতার, ‘৬৬ সালের ছ’দফা আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, তারপরে স্বাধীনতার সংগ্রাম। এক দিনে হয়নি। ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে এগিয়ে নিতে হয়েছে।১
দুই.
দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগের মধ্যে আমাদের তখন অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। শহীদ সাহেব যে পার্লামেন্টারী পার্টির নির্বাচনে হেরে গেলেন তার। পেছনে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছিলাে। পাঞ্জাবে নতুন নেতা নির্বাচনের কোনাে প্রয়ােজন হয়নি। মামদোতই সেখানে নির্বাচন ছাড়া প্রধানমন্ত্রী থেকে গেলেন কিন্তু পূর্ব বাংলার জন্য নতুন নির্বাচন দেওয়া হলাে। এর কারণ কেন্দ্র থেকে শহীদ সাহেবকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
————————
১. ১৯শে আগস্ট, ১৯৭২, সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ।
——————-
১৯৪৮ সালেই আমরা আর মুসলিম লীগ না করা স্থির করেছিলাম। কিন্তু সে চেষ্টা আমরা প্রথম পর্যায়ে মুসলিম লীগের মধ্যে থেকেই করতে চেয়েছিলাম। এর জন্যে ১৯৪৮ সালে ১১০/১২ জন পুরাতন কাউন্সিলারের সই নিয়ে আকরাম খানের বিরুদ্ধে আমরা একটা রিকুইজিশন মিটিং আহ্বান করেছিলাম। আকরাম খান তখন কলতাবাজারে থাকতেন। আমি নিজে তাঁর বাড়িতে গিয়ে সই সুদ্ধ মিটিংয়ের দরখাস্ত দিলাম এবং দরখাস্ত প্রাপ্তির একটা রশিদ তাঁর থেকে চাইলাম। তিনি যথারীতি আমাকে একটি রশিদ দিলেন।
এর পরদিনের আজাদে দেখলাম যে তিনি মুসলিম লীগ কাউন্সিলকেই সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন এবং আমরা যে ১১০/১২ জনের সই দিয়েছিলাম তাদের নাম কাগজে ছাপিয়ে তিনি ঘােষণা করেছেন যে আমরা কেউ আর মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নই। এরপর নারায়ণগঞ্জে মুসলিম লীগ কর্মীদের সভা হয়। সেখানে রশিদ বই ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা হয়।
১৯৪৮-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করি। তাতে নাঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক মনােনীত করা হয়।
আমি ১১ই মার্চ সেক্রেটারিয়েটের আবদুল গনি রােডস্থ গেটের সামনে গ্রেফতার হই। তার পর আমরা ছাড়া পাই ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায়। ছাড়া পাওয়ার পূর্বে জেল গেটে একটা গণ্ডগােল হয়। শওকত প্রভৃতি দুই একজনকে ছাড়তে জেল গেটের লােকে অসম্মত হয়। পরে আমরা তাদেরকে ছাড়া বের হবে না এ কথা বলায় সকলের জন্যেই রিলিজ অর্ডার আসে। রিলিজ অর্ডার মাত্র একটাই এসেছিলাে। আমরা ছাড়া পাওয়ার পূর্বে জেল গেটে সেদিনই কামরুদ্দীন, আবুল কাসেম, নূরুল ইসলাম প্রভৃতি। গিয়েছিলাে আমাদের সাথে চুক্তির শর্তগুলাে নিয়ে আলােচনা করতে। আমরা অনুমােদন করেছিলাম।
জেল থেকে আমাদের ট্রাকের উপর শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে ফজলুল হক হলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে একটা সংবর্ধনা সভাও। অনুষ্ঠিত হয়।
১৬ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে সভার সময় কে সভাপতিত্ব করবে তাই নিয়ে একটা বিতর্ক হয়। কেউ আমার নাম, কেউ শামসুল হকের নাম, কেউ বা আবার কমিটি অব অ্যাকশনের কারাে কারাে নাম প্রস্তাব করলাে। কিন্তু সভা আরম্ভ করার পর নাঈমুদ্দীন আমার নাম প্রস্তাব করে এবং তখন সেখানে কোনাে আপত্তি ওঠে না।
আমাদের সেখানে আলােচ্য বিষয় একটাই ছিলাে। নাজিমুদ্দীন আট দফা চুক্তি অনুসারে বলেছিলেন নিজে তদন্ত করে দেখবেন। আমরা বললাম যে না সমস্ত ঘটনার Public Enquiry হবে।
১৬ তারিখে মিটিংয়ের পর একটা মিছিল অ্যাসেম্বলির দিকে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ স্লোগান ইত্যাদি দেওয়ার পর সেখানে খুব বেশি ছাত্র আর উপস্থিত থাকে না। সন্ধ্যার দিকে যখন টিয়ারগ্যাস ছােড়ে তখন সেখানে ৪০/৫০ জনের বেশি ছাত্র উপস্থিত ছিলাে না। বাকি যারা ছিলাে তাদের অধিকাংশ অফিসের লােক।
MLA-দের বিরুদ্ধেই মােটামুটিভাবে বিক্ষোভ হয়। তাদেরকে গালাগালি এবং অনেক ক্ষেত্রে মারধর করা হয়। মােয়াজ্জেম ডাক্তার নামে বাগেরহাটের এক MLA-কে ধরে নিয়ে মুসলিম হলে ছাত্ররা আটক করেছিলাে। সেখানে গিয়ে আমি তাঁকে ছাড়াই। শওকত সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বেশ আঘাত পায় পুলিশের হাতে।
১৬ তারিখের এই ঘটনার পর প্রথমে ফজলুল হক হলে এবং পরে বালিয়াদী হাউসে মিটিং হয়। দ্বিতীয় মিটিংটিতে কায়দে আযমের ঢাকা বাসা উপলক্ষে আন্দোলন স্থগিত রাখার ব্যবস্থা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Anti Repression Day করা হয়। আমি তার আহ্বায়ক ছিলাম। সে সময় স্ট্রাইক হয় এবং পরে ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে মিটিং হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মিনিয়াল স্ট্রাইক শুরু হলাে। ছাত্ররাও Sympathetic ধর্মঘট করলাে। আমরা এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলােচনা শুরু করলাম। তারা আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত Bluff দিলাে। তারা বললাে যে কর্মচারীরা ১১টার মধ্যে যােগদান করলে ধর্মঘট বন্ধ হবে এবং তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করা হবে। অনেকে ১১টার মধ্যে যােগ দিয়েছিলাে, কিন্তু সকলের সাথে সময়মতাে যােগাযােগ করতে না পারার জন্যে তারা তাদের যােগ দিতে দিলাে না। কাজেই বস্তুতঃপক্ষে তারা শর্তের খেলাপ করলাে। আমরা তখন ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর পূর্বে অবশ্য আমরা কর্তৃপক্ষের শর্তের ওপর বিশ্বাস করে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিলাম।
আমরা আবার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন, সকলকে হােস্টেল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। আমরা কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে হােস্টেল ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর দেখা গেল যে রাতের অন্ধকারে শতকরা ৬০ ভাগ ছাত্র হল ত্যাগ করে চলে গেছে। সেই অবস্থায় আর হলে থাকার সিদ্ধান্ত রাখা গেল না এবং আমরা সকলে হল ত্যাগ করলাম।
এরপর মােগলটুলীকে কেন্দ্র করে কর্মচারীদের জন্যে আমরা রিলিফ সংগঠন করতে থাকলাম। মুষ্টি ভিক্ষার মাধ্যমেই আমরা সেই কাজে নামলাম। কিন্তু অল্পকাল পরেই কর্মচারীরা অবশ্য একেবারে Demoralished হয়ে গেল। তাদের মধ্যে কেবল মাত্র একজন ছাড়া বাকি। সকলে মাফ চেয়ে কাজে যােগ দিলাে। একজনই শুধু চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেল।
১৭ই এপ্রিল ছিলাে বিশ্ববিদ্যালয় খােলার তারিখ। সেই দিনের মধ্যে ছাত্রনেতাদেরকেও মাপ চেয়ে নিতে বলা হলাে। অন্যথায় তাদের বহিষ্কার করা হবে বলে জানানাে হলাে। ছাত্র নেতাদের মধ্যে আবদুর রহমান চৌধুরী, নঈমুদ্দীন আহমদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল মতিন চৌধুরী প্রভৃতি ১৫/১৬ জন বন্ড দিয়ে দিলাে। ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ বন্ড দেওয়ায় আমরা খুব মুষকিলে পড়লাম। সাধারণ কর্মীরা অবশ্য এদিক দিয়ে অটল ছিলাে। আমরা এর পরই আবদুর রহমান চৌধুরী এবং নঈমুদ্দীন আহমদকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করে দিই। এই আন্দোলনের সময় জগন্নাথ কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছিলাে।
১৮ই এপ্রিল আমরা ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করলাম। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একটা নতুন কমিটি করা হলাে। সেই কমিটির লােকজন নিয়ে আমরা এর বাড়িতে বসে থাকলাম। পুলিশ অফিসার পরে এক সময় দলবল নিয়ে আমাদেরকে সেই স্থান ত্যাগের নির্দেশ দিলাে কিছুক্ষণের মধ্যে। অনেকে চলে গেলেও আমরা ৮/১০ জন থাকলাম। তাজউদ্দীন সেই সময় প্রেস প্রতিনিধি সেজে অভিনয় করায় গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি পায় কিন্তু আমরা কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে। যাই। যারা গ্রেফতার হই তাদের মধ্যে আমি ছাড়া ছিলাে বরকত, হাসনাত, খােন্দকার গােলাম মােস্তফা, আজিজ আহমদ, খালেক নওয়াজ, কাজী গােলাম মাহবুব, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, অলি আহাদ প্রভৃতি।
এই ঘটনার ৫/৭ দিন পর আন্দোলন থেমে যায়। একুশ তারিখ আমার টাঙ্গাইল যাওয়ার কথা ছিলাে কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার জন্যে যেতে পারিনি। এরপর আমি জুন মাসের শেষের দিকে পাই।।
আমি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার পর দবিরুল ইসলামকে (তখনাে জেলে) সভাপতি এবং খালেক নওয়াজ খানকে সম্পাদক করে ছাত্রলীগ আবার নতুনভাবে গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময়…১
তিন
আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনারা জানেন, হাসি-কান্নার ইতিহাস, রক্তের ইতিহাস, অত্যাচারের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, জয়ের ইতিহাস। আপনাদের সঙ্গে বাংলার মাঠে-প্রান্তরে, গ্রামে-গ্রামে আমি কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম থেকে প্রথমে আমি যােগদান করি যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে। তিপ্পান্ন সাল থেকে পঁয়ষট্টি সাল পর্যন্ত কাজ করি সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এবং ছেষট্টি সাল থেকে এ পর্যন্ত সভাপতি হিসাবে।
আপনারা জানেন, কিভাবে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আমরা বাংলাদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম। দুই-শ বছর ইংরেজ এদেশকে শাসন করে। দুই-শ বছর পরে ১৯৪৭ সালে এক ফাকির স্বাধীনতা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বাংলাদেশের জনগণ সংখ্যাগুরু ছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষকে শােষণের পর শােষণ করার জন্য সামরিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘু শাসকগােষ্ঠী ১৯৪৭ সালে নতুন করে বাংলাকে পরাধীন করে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কলােনীতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের মানুষকে শােষণ করে পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী গড়ে তােলে তাদের দেশকে। কিন্তু বাংলার মানুষ চুপ করে থাকে না।
১৯৪৭ সালের পূর্বে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগদান করেছিলাম তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হবাে। কিন্তু সাতচল্লিশ সালেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা নতুন করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছি। এর মধ্য থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। জনগণ তখন বুঝতে পারে নাই। শােষক গােষ্ঠীর নায়করা এখানে শক্তিশালী
—————————
১. সূত্র : ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল। বদরুদ্দীন উমর। পৃ. ২৮৮-২৯১। উল্লেখ্য যে, সাক্ষাৎকারটির শেষ অংশ হারিয়ে গেছে বলে উক্ত বইয়ের লেখক উল্লেখ করেছেন। সাক্ষাৎকার : ২৯, ৯.১৯৬৯)
—————————–
সরকার গঠন করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে। এই অবস্থায়ও আমরা কিছুসংখ্যক দেশপ্রেমিক তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করি।
আমার মনে আছে, ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে আমরা প্রথম ডেমােক্রেটিক ইয়ুথ লীগ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। উদ্দেশ্য, শােষক গােষ্ঠীর মােকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আমরা এগুতে পারলাম না। অনেক সময় থিওরি ও প্র্যাকটিসে গণ্ডগােল হয়ে যায়। থিওরি খুব ভালাে। কাগজে কলমে লেখা থিওরি অনেক মূল্যবান। পড়ে শক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল কাজের সঙ্গে মিল না থাকলে থিওরি কাগজে কলমে পড়ে থাকে, কাজে পরিণত হয় না।
তখনকার দিনে একদল লােক এ ধরনের থিওরির অনুসারী ছিল। এ সময় ভারতবর্ষে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন রণদিভে। তিনি পি সি যােশীকে তাড়িয়ে দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি। বললেন, এখনই অস্ত্রের সাহায্যে মােকাবেলা করা দরকার। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তাঁরা এদিক ওদিক আঘাত হানলেন। আমাদের এখানেও কিছু সংখ্যক কর্মী বুঝতে না পেরে সেই পন্থা অবলম্বন করতে গেলেন। আমাদের সঙ্গে তাঁদের মতের অমিল হলাে। আমরা বললাম, দেশের মানুষকে না গড়ে তুলে, দেশের মানুষকে মােবিলাইজ না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ না নিয়ে চলা যায় না। তারা বুঝতে পারলেন না। ডেমােক্রেটিক ইয়ুথ লীগ ভেঙ্গে গেল।
ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের জন্ম
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন শােষণ করতে চায় তখন তারা আঘাত করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওপর, ভাষার ওপর। তাকে ধ্বংস করতে না পারলে শােষণ করা সহজ হয়ে উঠে না। তাই, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানী শােষকগােষ্ঠী বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানলাে। সংখ্যাগুরু লােকের ভাষার ওপর আঘাত করে আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলাে। তখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলাে মুসলিম লীগ। জিন্নাহ সাহেব তখনও বেঁচে আছেন এবং তাঁর দলের লােকেরাই বাংলাদেশে শাসন চালিয়েছিলাে। তাদের শক্তি ছিলাে, সামর্থ্য ছিলাে, অর্থ ছিলাে। বিদেশী শক্তিও তাদের পিছনে ছিলাে। আমরা ভাষার ওপর। এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারই ফলশ্রুতিতে আটচল্লিশ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ই মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। ঐ তারিখেই অন্যান্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযােগে আমরা শােষক গােষ্ঠীর আঘাতের মােকাবেলা করি।
আজ মনে পড়ে আমার বন্ধু ও সহকর্মী শামসুল হকের কথা, যার সঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি। তিনি আর ইহজগতে নাই। তিনি আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার কথা যদি আজ আমি স্মরণ না করি, অন্যায় করা হবে। মরহুম শামসুল হক আ আমি একসঙ্গে গ্রেফতার হই। তারপরেই আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। আমরা বুঝতে পারলাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন আছে। তা না হলে আন্দোলন করা যাবে না, তাই আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার কাজে আত্মনিয়ােগ করলাম। আমাদের সহকর্মীদের মবিলাইজ করতে শুরু করলাম।
আবার আমাকে গ্রেফতার করা হলাে। আমার সহকর্মীদের গ্রেফতার করা করা হলাে। আমরা সেখানে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করবাে বলে ঠিক করলাম। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে আমি যখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী তখন আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় তারা আমাকে যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
অনেকে ইতিহাস ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের আন্দোলনে তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার ওপর ও আমার দেশের ওপর। আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মােকাবেলা করতে হবে। সেখানেই গােপন বৈঠকে সব স্থির হয়। এ কথা আজ বলতে পারি; কারণ আজ পুলিশ কর্মচারীর চাকরি যাবে না। সরকারি কর্মচারীর চাকরি যাবে না। কথা হয়, ১৬ই ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট করব, আর ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু হবে। জেলে দেখা হয় বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তাঁকে বললাম, আমরা এই প্রােগ্রাম নিয়েছি। তিনি বললেন, আমিও অনশন ধর্মঘট করবাে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমরা অনশন ধর্মঘট করলাম। এর দরুন আমাদের ট্রান্সফার করা হলাে ফরিদপুর জেলে। সূচনা হয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের।
তারা চরম আঘাত করলাে ভাষার ওপর, কৃষ্টির ওপর। চরম আঘাত হানলাে আমাদের ওপর। ১৯৪৯ সালের আওয়ামী লীগ জন্মের পর থেকেই গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগের কণ্ঠরােধ করে দেওয়া হলাে। আওয়ামী লীগের জীবন অতিষ্ঠ করে তােলা হলাে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিলাে। এভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাই। একদিনে সংগ্রাম হয় না। একদিনে দেশ জয় হয় না। একদিনে আদর্শ প্রাতষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য চাই নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এই প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করলেই বক্তৃতা আমি দেবার পারি না। কত চেহারা ভেসে ওঠে আমার সামনে। কত ত্যাগী কর্মী কারাবরণ করেছে। কত ভাই, কত সহকর্মী শহীদ হয়েছে। এদের সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছি। কতদিন আন্দোলন করতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। তাদের কথা আমি স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে। কারণ, আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তারা আমাদের মধ্যে নাই।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চরম আঘাত আসে আওয়ামী লীগের ওপর। শােষকগােষ্ঠী আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির ওপর হামলা চালায়। অত্যাচার চালায় বাংলার মানুষের ওপর। কিন্তু আমরাও বসে থাকি নাই। বাংলার জনগণ, বাংলার ছাত্রসমাজ, বাংলার যুবসমাজ, বাংলার প্রগতিশীল কর্মীরা এই হামলার মােকাবেলা করতে থাকে বারবার। কিন্তু অপর পক্ষ ছিল বড় শক্তিশালী। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র, মেশিন গান।। তাদের কাছে ছিল অর্থ, ছিল ধোঁকাবাজি। তারা বিশেষ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে ধর্মের নাম। আমার বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মের নামে ধোকা দেওয়া যত সহজ অন্য কিছুতেই ততটা সহজ নয়। তাই ধর্মকে তারা ব্যবহার করলাে আমার মানুষকে শােষণ করার অস্ত্র হিসাবে।
শােষকের নয়া ষড়যন্ত্র ১৯৫২ সালের আন্দোলনের পর শােষকগােষ্ঠী দেখলাে যে, বাংলা ভাষাকে এভাবে দাবানাে যাবে না। তাই তারা ছলে, বলে কৌশলে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি ও সভ্যতাকে এবং আমাদের আন্দোলনকে বানচালের চেষ্টা করতে আরম্ভ করে।
১৯৫৪ সালের ইতিহাস আপনারা জানেন। আমরা বায়ান্ন সালে জেল থেকে বের হয়ে আসি। তিপ্পান্ন সালেও আমাদের কর্মী গ্রেফতার হয়।
১৯৫৪ সালে একটা নির্বাচন দেওয়া হলাে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন চীফ মিনিস্টার হন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী আঁতকে উঠে। তারা বাংলার মানুষকে একতাবদ্ধ হতে দেবে না। তাই আবার তারা আঘাত হানার চেষ্টা করে। . যেদিন আমি মন্ত্রী হিসাবে শেরে বাংলার কেবিনেটে শপথ নিয়েছি সেদিনের কথা আমার মনে আছে। ঠিক সেই সময় এক ঘণ্টার মধ্যে আদমজীতে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করা হল। তারা ষড়যন্ত্র করলাে এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তাই সৃষ্টি করলাে তাদের দালালদের দিয়ে এই দাঙ্গা। মানুষের জন্য তাদের কোনাে দরদ ছিল না। মানুষকে তারা ভালােবাসতাে না। ক্ষমতাকেই তারা বড় করে দেখতাে। তাই চুয়ান্ন সালে তারা দাঙ্গা বাধালাে আদমজী পাটকলে। আমার মনে আছে, পাঁচশরও বেশি লােক সেখানে মারা যায়। শপথ নিয়েই আমরা সেখানে দৌড়ে যাই। উপস্থিত হই মােকাবেলা করি। মানুষকে বুঝাবার চেষ্টা করি।
১৯৫১ সালেও তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে বাংলার মাটিতে। এতে এদেশের অনেক নিরীহ লােক জীবন দেয়। এই দাঙ্গা তারা সৃষ্টি করে বাঙ্গালি জাতিকে বিভক্ত করার জন্য। কারণ, বাংলাদেশে যদি বিভেদ সৃষ্টি করা না যায় তাহলে তারা শাসন ও শােষণ চালাতে পারবে না। এমনি করে। তারা চালায় তাদের ষড়যন্ত্র। আমার মনে আছে, তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের ৫০ জনের মত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের কয়েক হাজার কর্মী গ্রেফতার হয়। বাংলার মানুষের ওপরে অত্যাচারের স্টিমরােলার চলে। কিন্তু আমরা নিরুৎসাহ হই নাই। আমরা আরও সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম আরম্ভ করার চেষ্টা করি। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আওয়ামী লীগের পরিষ্কার আদর্শ আমাদের সামনে ছিলাে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ছিলাে।১
——————
১. ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭৪-এ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল। অধিবেশনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্বোধনী ভাষণের অংশবিশেষ।
——————-
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম