ভাষা আন্দোলনে জেল থেকে যােগাযােগ১
কে. জি. মুস্তাফা
কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে দেখা। কথা হল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে। আমরা এক সময় ইকবাল হলের ব্যারাকে বাস করেছি। হলে। যাদের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল তাদের মধ্যে আবদুস সামাদ (তখন নামের সঙ্গে ‘আজাদ যােগ হয়নি), কামরুজ্জামান ও মােহাম্মদ সুলতানের নাম বিশেষভাবে। উল্লেখ্য। আবদুস সামাদ এবং মােহাম্মদ সুলতান ছিলেন যুবলীগের নেতা, কামরুজ্জামান প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তখনকার দিনে আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে যৌথ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য। সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠন করতে আমাদের ঝগড়া-ঝাটি করতে হয়নি। বিভিন্ন হলের নির্বাচনেও আমরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছি। ১৯৪৮ সালের। ডিসেম্বরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী আবদুর রহমান চৌধুরী তখনকার ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থন পান এবং সহ-সভাপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম লীগের প্রতি আকৃষ্ট হন। কর্মজীবনে ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। মােহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী। এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যৌথ সমর্থনে নির্বাচিত হন। কিন্তু আবদুস। সামাদকে যৌথ প্রার্থী করার পরও নির্বাচনে আমরা পরাজিত হই ‘৫১-৫২ সালে। সেবার জয়লাভ করেন মুজিবুল হক, কর্মজীবনে সিএসপি এবং অত্যন্ত। সফল আমলা। ‘৫২-৫৩ সালে আমরা আবার জয়লাভ করি যৌথ প্রার্থী দিয়ে। প্রার্থী ছিলেন ঢাকার শামসুল হক, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছর আমি কামরুজ্জামানকে এসএম হলের নির্বাচনে দাড়ানাের জন্য অনুরােধ করেছিলাম, কিন্তু তিনি সম্মত হননি এই কারণে যে, তিনি তখন। প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সভাপতি। সম্প্রতি সামাদ আজাদের সঙ্গে আলােচনার । * সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি হলের নির্বাচন নিয়েও কথা উঠল। তিনি বললেন, ফেব্রুয়ারি এলেই আপনার লেখা পড়ি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। সম্পর্কে। এবারও নিশ্চয়ই কিছু লিখবেন। আমি বললাম, লিখতে তাে হবেই। যতদিন বেঁচে আছি এবং লেখার ক্ষমতা আছে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবেন।
——————
১ লেখাটি ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালােবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ। থেকে সংকলিত।
——————
বলে জানালেন সামাদ আজাদ। তাদের হয় প্রেস কনফারেন্স, নয় তাে ওয়ার্কিং কমিটির সভা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বায়ান্নর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তার ছিল বিশেষ অবদান। তিনি বললেন, গত বছর থেকে শহীদ দিবসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কাজকর্ম। আমি বললাম, আর এই সময়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত কনভেনশন, মহান একুশের লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে ডুবে থাকার পরিবর্তে ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। ফোন না থাকা যে কত বড় সমস্যা এখন টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। পুরনাে বাসার ফোনটা স্থানান্তর করার আবেদনের পূর্ব শর্তাবলী পূরণে ব্যস্ত আমি।
সামাদ আজাদ প্রশ্ন তুললেন ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের জনসভার কথা। ওই দিন নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরপরই সমবেত জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে মুসলিম লীগ বিরােধী স্লোগানে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে। শুধু প্রতিবাদের ভাষা নয়, তুমুল আন্দোলন গড়ে তােলার দৃঢ় প্রত্যয় দেখা গেল সেদিন ছাত্র-জনতার চোখে-মুখে। ৩০ জানুয়ারি বার কাউন্সিল হলের সভায় সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠিত হল মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে। সংগ্রামের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় সভায়। সিদ্ধান্ত হল, ৪ ফেব্রুয়ারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট, শােভাযাত্রা ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে ছাত্র-জনতার সভা। এরপর ৮ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস। ওইদিন আন্দোলনের কর্মসূচি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাখ্যা করবেন স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। পাশাপাশি পতাকা বিক্রি করে আন্দোলনের তহবিল গড়া হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ, শােভাযাত্রা ও ছাত্র-জনতার সভা।
৩০ জানুয়ারির সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, খেলাফতে রব্বানী পার্টির সভাপতি আবুল। হাশিম, অধ্যাপক আবুল কাশেম, নুরুল হক, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান, অ্যাডভােকেট কমরুদ্দিন আহমদ, যুবলীগের সহ-সভাপতি মােহাম্মদ তােয়াহা, সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, কোষাধ্যক্ষ ও সাংবাদিক তাসাদুক আহমদ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবুদল মতিন, কাজী গােলাম মাহবুব, যুবলীগ নেতা আবদুস সামাদ (আজাদ), গাজীউল হক, মােহাম্মদ সুলতান, কে জি মুস্তাফা (বর্তমান নিবন্ধের লেখক), মােহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, জিল্লুর রহমান, আবদুল মমিন, সাদেক খান, মােহাম্মদ ইলিয়াস, এম আর আখতার মুকুল, মাহবুব জামান জাহেদী এবং আরও অনেকে।
আন্দোলনের কর্মসূচি সফল করার জন্য আত্মগােপনকারী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ, খােকা রায়, শহীদুল্লাহ (কায়সার), মােহাম্মদ তকীউল্লাহ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও অন্যান্য নেতা-কর্মী প্রকাশ্য প্রচারণায়। নামেন। মহিলাদের মধ্যে প্রচারকার্যে অগ্রণী ছিলেন নাদেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন (প্রয়াত), সােফিয়া খান, হালিমা খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, সুফিয়া। করিম, রওশন আরা বাচ্চু প্রমুখ।
আন্দোলনের এই বিশাল আয়ােজনে ব্যক্তিগতভাবে অনুপস্থিত থাকলেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫০ সালে কারারুদ্ধ হওয়ার পর থেকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বায়ান্নর আন্দোলনকালেও। তিনি ছিলেন রাজবন্দি। আন্দোলনে শরিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ও মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারে ধর্মঘট শুরু করেন। এই সময়েও তিনি ছাত্রজননেতাদের সঙ্গে গােপন যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছেন। এক পর্যায়ে অনশনকারী হিসাবে তাকে এবং মহিউদ্দিন আহমদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিকিউরিটি ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালে ছাত্রদের সঙ্গে শেখ মুজিবের যােগাযােগ আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে তাকে এবং মহীউদ্দিনকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলি করা হয়। পথে নারায়ণগঞ্জের। তরুণ ছাত্রলীগ কর্মী মুস্তাফা সারওয়ার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের আন্দোলনে অবিচল থাকার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি অনশন চালিয়ে যাবেন বলেও মুস্তাফা সারওয়ারকে জানান। ইতিমধ্যে ঢাকা ও সারা প্রদেশ। আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে তৎপর হয়ে ওঠে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা বন্ধ করে দেয় প্রাদেশিক সরকার। অভিযােগ, পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে তৃতীয় খলিফা হযরত ওমরের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক অভিযােগ করা হয়েছে। অভিযােগটির কোনােই ভিত্তি ছিল না। আসলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন পােষণ করার কারণেই পত্রিকাটি বন্ধ করা হয় এবং সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেফতার করা হয়। সামনে ছিল একুশ। তারিখে প্রদেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচি। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে চারের বেশি লােকের সভা, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। ওই রাতেই সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের সম্ভাবনা মাথায় রেখে কমিটির অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু ছাত্রদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই আন্দোলন এগিয়ে নেয়া হবে। সভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অনুরােধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বক্তৃতা করবেন। তারপরও যদি ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চায় তাহলে অ্যাকশন কমিটি আপনা-আপনি ভেঙ্গে যাবে। ছাত্ররা শামসুল হকের কথা মান্য করেনি। তারা দশজনের স্কোয়াডে ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথম স্কোয়াড ছিল মহিলাদের। তাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে পরবর্তী দশজনের কোয়াডেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে অশালীন আচরণ করা হয় এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। এক পর্যায়ে ছাত্ররা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ ইতিমধ্যে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। গুলিবর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র আবুল কতসহ চারজনের মৃত্যু ঘটে। ক্যাম্পাস ছেড়ে ছাত্ররা তখন মেডিকেল কলেজের দিকে ভিড় করেন। গুলিবর্ষণের খবর শুনে পূর্ববঙ্গ আইনসভা থেকে সরকারদলীয় সদস্য ও আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন এবং মওলানা আবুদর রশীদ তর্কবাগীশ বের হয়ে এসে ছাত্রদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। সম্পাদক শামসুদ্দিন মুসলিম লীগ ও আইসসভা থেকেও পদত্যাগ করেন। পরদিন হয় এক সুবিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ। সকালে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় বাঙালি বিদ্বেষী সংবাদ প্রকাশ করার প্রতিবাদে তাদের অফিসে অগ্নিসংযােগ করা হয়। সারাদেশ সেদিন ছিল প্রতিবাদমুখর এবং মুসলিম লীগবিরােধী ধ্বনিতে প্রকম্পিত। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলে, যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়।
গত বছর শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর মহান একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারাগারে থাকলেই বাইরে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে না, এটা একটা অরাজনৈতিক অনুমান। দেশের বামপন্থীদের অধিকাংশই কারাগারে কাটিয়েছেন তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়। তারা কি বাইরে রাজনীতির সঙ্গে যােগাযােগ না রেখেই আন্দোলন সম্পর্কে মতামত পাঠাতেন তাদের নেতাদের কাছে? একমাত্র যাদের আন্দামানে পাঠানাে হয়েছিল তারা ছাড়া অন্যদের অধিকাংশই যােগাযােগের কোনাে-না কোনাে চ্যানেল খােলা রাখার ব্যবস্থা করতেন। সেই রাজনীতিকে ‘চিরকুট রাজনীতি’ বলে উপহাস করেন এমন মানুষও দেখা যায়। রাজনীতিতে জড়িত সন্দেহে যাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তাদের মধ্যে যারা একটু প্রভাবশালী তারা তাদের যােগাযােগের চ্যানেল খােলা রাখেন তাদের রাজনীতির স্বার্থেই। তা না হলে সারাদেশের কারাগারে একই ইস্যু নিয়ে রাজবন্দিরা আন্দোলন করতে পারতেন না। চলমান। রাজনীতির ট্রেণ্ড সম্পর্কেও তারা সজাগ থাকতে পারতেন না।
যা হােক, বঙ্গবন্ধুর কথায় আসি। ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমি তাকে বিটিভির পক্ষ থেকে ইন্টারভিউ করি। অনেক প্রশ্নের মধ্যে এ কথাও। জানতে চাই, কারাগারে আটক থেকে কিভাবে তিনি বাইরের আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছিলেন। তিনি জবাবে বললেন, জেল খাটলে কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে একটা সৌহার্দ্য গড়ে তােলা যায়, যা পরে কাজে আসে। তিনি আরও বললেন, ওইভাবেই কারাগারের সহানুভূতিসম্পন্ন কর্মচারীদের মাধ্যমেই তা করতে হয়, খুব সাবধানে। এটা। তােমরাও (অর্থাৎ কমিউনিস্টরাও) করে থাকো-বললেন শেখ মুজিব।
আরও একটি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বায়ান্নর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন তােলা হয়। সেটা হচ্ছে, শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমদ নিজেদের মুক্তির দাবিতে অনশন করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নির্দেশনা দেয়ার সুযােগ সৃষ্টির জন্য নয়। তাই যদি করে থাকেন, তাে মন্দ কি! অনশন করা জেলখানায় শাস্তিযােগ্য অপরাধ। নিজেদের মুক্তির দাবিতে সেই আন্দোলন করলেও একটি নজির খাড়া করা যায় যে, নিজের মুক্তির দাবিতে বহু মনীষী কারাগারে অনশন করেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন যদি অনশন ধর্মঘট করে থাকেন তাদের মুক্তির দাবিতে, তাহলে একই সঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাফল্য কামনাও তারা অবশ্যই করতে পারেন। দীর্ঘদিন কারাবরণ করেও তারা এই পথটা আবিষ্কার করতে পারবেন না -এমন ধারণা করাও অবাস্তব। জেল কর্তৃপক্ষ যদি প্রচারও করে থাকে যে, শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন তাদের মুক্তির জন্য অনশন করেছেন, তাহলে তাে বাইরের সাধারণ মানুষ জানবে, আসলে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যই অনশন করেছেন, অন্য যে কথাটা রটেছে সেটা কর্তৃপক্ষকে ধোকা দেয়ার জন্যই। সবচেয়ে বড় কথা, শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিজের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন এ কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। এত বড় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের মতাে নেতা নিজের মুক্তির দাবিতেই শুধু অনশন ধর্মঘট করবেন এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। একই সঙ্গে নিজেদের মুক্তি ও ভাষা আন্দোলনের সাফল্য কামনা করে অনশন করা সম্ভব।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। বায়ান্ন সালে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের জন্মের তিন বছরের মধ্যে শেখ মুজিব যখন সারা প্রদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা, তখন কি তিনি স্ব-ইচ্ছায় ব্যক্তিগত মুক্তি নিয়ে জেলখানা থেকে বের হতে উদগ্রীব হবেন? শেখ মুজিবকে যারা জানেন তারা এ জাতীয় কোনাে কথাই বিশ্বাস করবেন না। বরং আন্দোলনের সময় তিনি আরও দৃঢ়তা দেখাবেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যাতে সফল হয় তার জন্য সব কিছু করবেন। শেখ মুজিবের মতাে নেতার এমন দৃঢ়চিত্ত হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজ ধ্বংস করার জন্য মাঠে-ময়দানে যারা মিথ্যাচার করে চলেছে, তারা এসব কথা প্রচার করতে বেশি আগ্রহী। বিশ্বের সব নেতাই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালােভাবে জানেন। তাদের কাছে এই মহান জননেতাকে খাটো করে দেখানাে যাবে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনকালে তার মতাে মাতৃভাষাপ্রেমী জননেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানাের সুযােগ একটা বিরল প্রাপ্তি, এটা বিদেশিরা বুঝতে পারবেন, যারা বুঝবে না তারা আমাদের নিজেদের দেশের বাংলা ভাষাবিরােধী, স্বাধীনতাবিরােধী, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ ও মৌলবাদী দলগুলাের নেতাকর্মী। মাতৃভাষা দিবস পালন নিয়ে তারা মােটেই মাথা ঘামায় না। তারা চায় মুজিবের ইমেজ নষ্ট করতে।
আরও একটি কথা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন তাদের অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল হলের কামরুজ্জামান, ফজলুল হক হলের ছাত্রনেতা জিল্লুর রহমান, আবদুল মমিন একবাক্যে স্বীকার করেন বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালে আন্দোলন সম্পর্কে নির্দেশ পাঠিয়েছেন তাদের কাছে। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দেলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এবারও তারা তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তাদের সম্পর্কে সাবধান থেকে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে সাফল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। আটচল্লিশের মুজিবকে যিনি জানেন তিনি তার এই নির্দেশের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না বলে আমি বিশ্বাস করি। শেখ মুজিব কোনাে পরিস্থিতিতেই আন্দোলনের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি, বায়ান্নর মহান একুশের আন্দোলন থেকেও তিনি দূরে ছিলেন না। তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের নেতারা একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেন। পরবর্তী পর্যায়েও শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে থাকা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। ১৯৭২ সালে আমার টিভি ইন্টারভিউকালে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার কারাজীবন সম্পর্কে, সেটাকে। তাে কেউ অসত্য বলে দাবি করেননি। এতকাল পরে তারা হঠাৎ কোথা থেকে জেগে উঠে বলতে শুরু করলেন, মুজিব ছিল না মাতৃভাষা আন্দোলনে। জেলে থাকাকালে আন্দোলনে কোনাে ভূমিকা রাখা যায় না। বলে যারা মনে করেন তাদের বিচারে নেলসন ম্যান্ডেলা নিশ্চয়ই দক্ষিণ স্বনামে একটা নিবন্ধ প্রকাশ করলেন। শিরােনাম হচ্ছে, “পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা।” তিনি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে অগ্রগণ্য হিসাবে উল্লেখ করে লিখলেন যে, “যদি এরপরেও অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন আসে, শুধু তাহলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এ সময় ড. শহীদুল্লাহর এই বক্তব্য এদেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলে দারুণ আলােড়ন সৃষ্টি করে। একুশে ফেব্রুয়ারি : যেভাবে শুরু পাকিস্তান অর্জিত হবার পর দেখা যায় যে, মােট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের আবাসভূমি পূর্ববঙ্গ এবং এদের মাতৃভাষা বাংলা-এর বিপরীতে প্রায় ১২-শ মাইল দূরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তান বহু ভাষাভাষীর এলাকা এবং শতকরা মাত্র ৫ জনের মাতৃভাষা উর্দু। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ থেকে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। শিরােনাম ছিলাে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?” এতে ২টি মাত্র নিবন্ধ। অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাে। এরা হচ্ছেন বিশিষ্ট সংবাদিক ও সােহরাওয়ার্দীর সমর্থক আবুল মনসুর আহমদ এবং মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ড. কাজী মােতাহার হােসেন।
এদিকে ১৯৪৭ সালের ৪-৫ ডিসেম্বর করাচিতে ‘বাবায়ে উর্দু আব্দুল হকের সভাপতিত্বে উর্দু ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান। অতিথি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুল রহমান। এই সম্মেলনেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং প্রস্তাবটি অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানানাে হয়। এই সংবাদ ঢাকায় পৌছলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ৬ই ডিসেম্বর ছাত্ররা প্রতিবাদ সভার পর মিছিল করে কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ আফজাল, সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী নুরুল আমীন এবং মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এঁরা প্রত্যেকেই গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সমর্থন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার সমর্থনে দৈনিক আজাদে আরাে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি লিখলেন, “যাঁহারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়া কিংবা বাংলার স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যমে (মিডিয়াম) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতে ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর। পক্ষে ওকালতি করিতেছেন, আমি তাঁহাদিগকে কাণ্ডজ্ঞানবিহীন পণ্ডিতমূখ। ভিন্ন আর কিছুই মনে করতে পারি না।”
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময় তিনি অনুভব করেন যে, অচিরেই মুসলিম লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এসব ইস্যুর অন্যতম হবে বাংলা ভাষার আন্দোলন। এ জন্যই শেখ মুজিব স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৫০ মােগলটুলীতে পৃথক ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলেন। সেদিনের তারিখটা ছিলাে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। এ দিকে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন, সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী নুরুল আমীনসহ মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা পূর্বের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সমর্থন জানালে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন কুমিল্লার কৃতী সন্তান কংগ্রেসের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী। লিয়াকত আলী খান তীব্র বিরােধিতা করেন। এমনকি তিনি ধীরেন্দ্র দত্তকে। পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টকারী রাজনীতিবিদ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা। করেন। কিন্তু ধীরেন বাবু তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানান।
এসব সংবাদ ঢাকায় এসে পৌঁছলে ছাত্র সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের বিভিন্ন হল ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, ডেমােক্রেটিক লীগ ও তমদুন মজলিশের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন। এই সভাতেই ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চকে বাংলা ভাষা দিবস হিসাবে। ঘােষণা দেয়া হয় এবং দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ১১ই মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে সহকর্মীদের সাথে সচিবালয়ের পাশে আব্দুল গণি রােডে শেখ মুজিব বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে এক পর্যায়ে তৎকালীন পুলিশের। আইজি দোহার সঙ্গে একরকম বলতে গেলে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পুলিশ শেখ মুজিবকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। তাঁর গ্রেফতারের সংবাদে সমগ্র পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এসময় প্রাদেশিক সরকার গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর। পূর্ববঙ্গ সফরের কথা চিন্তা করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আপােষ করলে দিনকয়েকের মধ্যেই শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পর ১৬ই মার্চ শেখ মুজিব ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় পুলিশ হামলা চালায়। এর প্রতিবাদে ১৭ই মার্চ ঢাকায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটে ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানের। বিশাল জনসভায় গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দেন, তখন সভাস্থলে যেসব নেতা ‘নাে’ ‘নাে’ ধ্বনি করেছিলেন, শেখ মুজিব তাঁদের অন্যতম ছিলেন। পরদিন কার্জন হলের সমাবর্তন উৎসবেও ছাত্ররা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপস্থিতিতে বাংলা ভাষার সমর্থনে শ্লোগান উচ্চারণ করলে জিন্নাহ সাহেব হতভম্ব হন। পরে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি এম এ জিন্নাহকে দেয়া হয়। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ সমর্থন করলে ১১ই সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১শে জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানানাের অপরাধে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর করাচীর অদূরে জিয়ারত নামক স্থানে রহস্যজনকভাবে এম এ জিন্নাহর মৃত্যু হলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের পরবর্তী গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নুরুল আমীন পূর্ববঙ্গের। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর করাচীতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘােষণা করলেন যে, “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।” ২০শে অক্টোবর ময়মনসিংহের এক জনসভায়। লিয়াকত আলী খান বাংলা ভাষা সমর্থনকারীদের প্রতি আরাে কঠোর ভাষায়। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন। তিনি বললেন যে, “শত্রুপক্ষীয় চরদের রাষ্ট্রবিরােধী আচরণের বিরুদ্ধে আমি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করছি।” এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত ইস্যুর সমাধান না করতে পারলে পাকিস্তানের নয়া সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
এ ধরনের এক রাজনৈতিক ডামাডােলের মধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পুরনাে ঢাকার রােজ গার্ডেনে জন্ম হল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের’। সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। কারাগারে আটক থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান এক নম্বর যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। অপর যুগ্ম-সম্পাদক। হলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ। এ সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। পাকিস্তানের প্রস্তাবিত সংবিধান রচনার লক্ষ্যে এর খসড়া মূলনীতি প্রণয়ন করে মতামত সংগ্রহের জন্য দেশব্যাপী বিতণের ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগের এ্যাডভােকেট কামরুদ্দীন আহমেদ ও এ্যাডভােকেট আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের সুশীল সমাজ আলােচ্য খসড়া মূলনীতি প্রত্যাখ্যান করে। ফলে সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি আরাে বিলম্বিত হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গের ক্রমবর্ধমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গতি ধারাকে বিভ্রান্ত ও রুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ও বরিশালে কোলকাতায় দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। অবশ্য এর কিছুদিন আগেই হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর উদ্দেশে বেতার ভাষণে সােহরাওয়ার্দীকে “হিন্দুস্থানের লেলিয়ে দেয়া কুকুর” হিসাবে আখ্যায়িত করেন। এমনি এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক প্রকাশ্য জনসভায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে মূলনীতির খসড়া রিপাের্ট আপাতত ধামাচাপা পড়ে। এবার পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দীন এবং গর্ভনর জেনারেল পদে অবসরপ্রাপ্ত আমলা গােলাম। মােহাম্মদ নিযুক্তি লাভ করলেন।
ছাব্বিশ জানুয়ারি, ১৯৫২ সাল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করলেন। খাজা সাহেব তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের গদি শক্ত করবার উদ্দেশ্যে এই জনসভায় প্রকাশ্যে ঘােষণা করলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ চার বছর পর খাজা সাহেব ভেবেছিলেন যে, পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ আর হয়তাে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে। বিশেষ উচ্চবাচ্চ্য করবে না। এ ছাড়া রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটার ফয়সালা হয়ে। গেলে তার পক্ষে একটা অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে ‘পাঞ্জাবী ক্লিককে সন্তুষ্ট করা সহজতর হবে। নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের তৎকালীন মুখপত্র মর্নিং নিউজ পত্রিকায় নাজিমুদ্দীনের এই বক্তৃতা ব্যানার হেডলাইনে ফলাও করে ছাপা হলাে। ফলে প্রতিক্রিয়াশীল মহলে। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘সাহস হল প্রশংসিত।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের প্রকাশ্য বক্তৃতায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লাে। পরদিন ২৭ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনাে কলাভবনের আমতলায় এক প্রতিবাদ সভায় ছাত্ররা তীব্র ভাষায় এর নিন্দা করলাে। এই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মেধাবী ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী সর্বপ্রথম এম. এ. জিন্নাহর আটচল্লিশ সালের উক্তি, লিয়াকত আলীর হুঁশিয়ারি, আর খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র সমালােচনা করলেন। এ সময় পূর্ববাংলায় সরকার-সমর্থক নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও সরকারবিরােধী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছাড়া বাস্তবক্ষেত্রে অন্য কোনাে ছাত্র। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না (তখনও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম। হয়নি) তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন গড়ে তােলার পশ্চাতে সবচেয়ে বেশি অবদান হচ্ছে অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের।
যা হােক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে কমরেড আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে একটা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিলিত শক্তি ভাষা আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে দেয়। এদেরই আহ্বানে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ধর্মঘট ও প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহের খালেক নেওয়াজ খান। ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠলাে। প্রসঙ্গত এখানে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠনের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপনা করা বাঞ্ছনীয় হবে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে তৎকালীন বিরােধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান। ভাসানী এই সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ছাড়াও জনাব। আবুল হাশিমের ‘খেলাফতে রব্বানী পার্টি’, ‘তমদুন মজলিশ’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’, ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ আর ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে যােগ দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বিনাবিচারে। কারাগারে আটক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের গােলাম মাহবুবকে (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করেছেন) আহ্বায়ক নির্বাচিত করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হলাে। এই সর্বদলীয় কমিটি তাদের প্রথম বৈঠকেই ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস ঘােষণা করে সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী সর্বাত্মক ধর্মঘট, শােভাযাত্রা ও জনসভার আহ্বান জানালাে। যুবলীগ, ছাত্রলীগ আর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম। পরিষদের শত শত কর্মী ‘ভাষা দিবস’কে সফল করার জন্য কাজে নামলাে। বাংলার পথ-প্রান্তর পােস্টার ও প্রচারপত্রে ছেয়ে গেলাে।
২০শে ফেব্রুয়ারি : প্রসঙ্গ ১৪৪ ধারা
২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে বলেই আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবক্রমে এই দিনটিকেই ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘােষণা করা হলাে। শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক তখন প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে ঢাকা হাইকোর্টের এ্যাডভােকেট জেনারেল হিসেবে রাজনৈতিক নির্বাসিতের জীবন যাপন করছিলেন।
কিন্তু একটা কথা উল্লেখ করতে হয় যে, এ সময় আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দের একাংশ একটা বিষয় অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন যে, আন্দোলন যেন কোনাে অবস্থাতেই পুলিশ বাহিনী তথা সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘর্ষের পর্যায়ে না যায়। কেননা, সেক্ষেত্রে নুরুল আমীন সরকার পূর্ব বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেয়ার একটা বাহানা পেতে পারে। সে আমলের প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ ভাষার প্রশ্নে অনমনীয় মনােভাব প্রকাশ করলেও তৎকালীন গােপন কম্যুনিস্ট পার্টিসহ বিরােধী দলীয় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই সংঘর্ষের পথ পরিহারের এই মত পােষণ করতাে। এ জন্যই মুসলিম লীগ সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি অপরাহে আকস্মিকভাবে ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করলে, সে রাতেই নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে “১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলেন খেলাফতে রব্বানী পার্টির জনাব আবুল হাশিম এবং আলােচ্য সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত ভােটাভুটির ফলাফল ছিল ১১-৪। কমরেড মােহাম্মদ তােয়াহা ভােটদানে বিরত ছিলেন। এ ব্যাপারে যথাসময়ে আরাে আলােকপাত করবাে। এখন আবার ৪ঠা ফেব্রুয়ারির কথায় ফিরে আসি।
১৯৫২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটার পর একটা ঘটনা। | কিভাবে ঘটেছিলাে সে সম্পর্কে সে আমলের জাদরেল ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টের বিশিষ্ট এ্যাডভােকেট গাজীউল হকের স্মৃতিচারণ থেকে এখানে হুবহু উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। “… চেয়ার এসে সভাস্থলে পৌঁছনাের আগেই এম আর আখতার (মুকুল) টেবিলের উপরে লাফিয়ে উঠে সভাপতি হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি যখন সভাপতির নাম প্রস্তাব করছেন তার মতলব বুঝতে পেরে সৈয়দ নুরুল আলম (পাবনা), এম আর আখতার মুকুলের প্যান্ট ধরে টেনে নামাবার চেষ্টা করছিলেন। এ টানা হ্যাচড়ায় বেচারা মুকুলের প্যান্টের কয়েকটি বােতামই ছিড়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনাব এম আর আখতার (মুকুল) সভাপতি হিসাবে আমার নাম প্রস্তাবের কাজ সমাধা করেন। এর পরেই পুরাে ছয় ফুট লম্বা জনাব কামরুদ্দিন শহুদ পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে হেঁড়ে গলায় প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। জনাব এম আর আখতার (মুকুল) টেবিল থেকে নেমে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি সভাপতির আসন নিলাম। চেয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে পারলাম না। টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠলাম এবং দু’মিনিট বক্তৃতা করেই মিছিলের কর্মসূচি ঘােষণা করলাম। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী জমায়েত হয়েছিল। এ দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিরাট মিছিল সমস্ত ঢাকা শহর। প্রদক্ষিণ করে এবং মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয় বেলতলায় এসে পুনরায় সমবেত হয়। সেখানে প্রদেশব্যাপী ২১ শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানানাে হয়। …
“… এ সময় আর একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৫২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ভােরে জেলখানা থেকে পাচার হয়ে একটি গােপনীয় চিঠি আসে। এ চিঠিতে বলা হয় যে, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান এবং জনাব মহিউদ্দিন আহমদ এ দু’জন অনশন ধর্মঘট করছেন। …
“২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনটার দিকে মধুর রেস্তোরায় বসে আমরা যখন স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা তৈরি করছিলাম, তখন মাইকযােগে পূর্ববঙ্গ সরকারের তরফ থেকে ১৪৪ ধারা জারির ঘােষণা করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে।”
“… সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে জনাব ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদের (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ্যাডভােকেট জেনারেল) সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সভায় স্থির হয় যে ১৪৪ ধারা মেনে নেয়া হবে না। ১৪৪ ধারা অমান্য করতে হবে। এবং এ সিদ্ধান্ত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় জানিয়ে দিতে হবে। অনুরূপভাবে ফজলুল হক হলেও জনাব আবদুল মােমিন-এর (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের খাদ্যমন্ত্রী) সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। ঐ সভাতেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ১৪৪ ধারা মেনে নেয়া চলবে না। ফজলুল হক মুসলিম হলে তখন সহ-সভাপতি ছিলেন জনাব শামসুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব আনােয়ারুল হক খান (পরবর্তীকালে যিনি বাংলাদেশ সরকারের | তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রথম সচিব ছিলেন এবং অতি সম্প্রতি পরলােকগত)।
“২০ তারিখে সন্ধ্যার পর নবাবপুরে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভা আরম্ভ হয়। জনাব অলি আহাদ, মেডিক্যাল কলেজের সহ-সভাপতি জনাব গােলাম মওলা (মাদারীপুর), জনাব আবদুল মতিন এঁরা সকলে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন এবং এঁদের সমর্থন করেন ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি জনাব শামসুল আলম। জনাব মােহাম্মদ তােয়াহা যদিও ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছিলেন, কিন্তু যেহেতু কম্যুনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত ভিন্ন রকম ছিল সেহেতু তিনি ভােটাভুটির সময় ভােটদানে বিরত থাকেন। ফলে ১১-৪ ভােটে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না।’ ভােটাভুটির পরও জনাব অলি আহাদ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না এবং আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রসভা হবে সে ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে যদি রায় হয় তবে আমরা ভাঙ্গার পক্ষে। জনাব অলি আহাদের বক্তব্য শুনে জনাব আবুল হাশিম রাগতঃস্বরে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সভা হবে, সে ছাত্র সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত ছাত্রদের জানিয়ে দেবেন এবং তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তরফ থেকে বক্তব্য পেশ করবেন। যদি তবু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গে তবে স্বাভাবিকভাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে। জনাব আবুল হাশিমের এই বক্তব্য প্রস্তাবাকারে গৃহীত হয়….।”
এ্যাডভােকেট গাজিউল হক ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে, সে আমলের রাজনৈতিক পার্টিগুলাের মনােভাব নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। অবশ্য একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক ছিলেন। জনাব গাজিউল হক আরও বলেছেন-“সেদিন ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে যাঁরা মত দিয়েছিলেন তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং অনিয়মতান্ত্রিক বা বেআইনি কোনাে কাজে তারা যাবেন না। তাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবেন না। কেননা, ১৪৪ ধারা যদি ভাঙ্গা হয় তবে সরকার নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযােগ পাবে। ফলে নির্বাচন পিছিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদে যেসব রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাদের সম্মুখে রাষ্ট্রভাষার জন্য সংগ্রামের চাইতে। পরিষদের নির্বাচন অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। আবার বলা যেতে পারে যে, তারা ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যেতুে চাইছিলেন। কম্যুনিস্ট পার্টিও তখন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছিল না। আওয়ামী লীগ যেদিকে চলবে সেদিকে হাল ধরা’-এটুকুই ছিল তাদের তখনকার রাজনৈতিক কর্মপন্থা। ১৪৪ ধারা যে ভাঙ্গা হবে না এ সম্পর্কে তারা তাদের কর্মীদের পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্তটুকু সন্ধ্যার দিকেই আমরা যারা পার্টির সংগে যুক্ত ছিলাম তাদের হাতে আসে।”
এই স্মৃতিচারণ সম্পর্কে শুধু এই টুকু বলবাে যে, প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে এসে এককালের দুর্ধর্ষ ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব গাজিউল হক সত্য ভাষণ করেছেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরও চাঞ্চল্যকর। কালের নীরব সাক্ষী হিসেবে সব কিছুই তাে অবলােকন করলাম।
১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকা বাঞ্ছনীয়। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে। এই ২০শে ফেব্রুয়ারিতেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিধারা নির্ধারিত হয়ে যায়। ব্যাপারটা সঠিকভাবে বুঝতে হলে কিছুটা পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও। আরও আলােচনা দরকার। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটা থেকে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এজন্যই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি। ‘ভাষা দিবস উপলক্ষে প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে। এতােগুলাে বছর পর পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২টি পক্ষই স্ব স্ব মনােভাব ব্যক্ত করে ফেলেছে। প্রথম হচ্ছে। মুসলিম লীগ সরকার পক্ষ। এঁদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ১৪৪ ধারা জারি করার পর প্রয়ােজন বােধে আইনের ছত্রছায়ায় বল প্রয়ােগ করে ভাষা আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় এঁদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে বাধ্য এবং নুরুল আমিন সরকার এই অছিলায় আসন্ন পরিষদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিতে পারে।
বিরােধী দলগুলাের মতে ভাষা আন্দোলন থেকেও পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। অতএব হরতাল প্রত্যাহার। পূর্ব বাংলার তৎকালীন গােপন ক্যুনিস্ট পার্টিও সক্রিয়ভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন প্রদান করে। অর্থাৎ এই সিদ্ধান্তের বিরােধীদের স্বাভাবিকভাবেই ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। পরবর্তীকালে কোনাে কোনাে গবেষক পার্টির এই সিদ্ধান্তকে লেজুড়বৃত্তি’ ও ‘দুঃখজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সবশেষে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের নেতৃবৃন্দ। এঁদের মত হচ্ছে যে, মুসলিম লীগ সরকার দলীয় স্বার্থে জন-নিরাপত্তা আইনের যথেষ্ট ব্যবহার করে এর মধ্যেই দেশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই অবস্থাকে মােকাবেলার সময় এসেছে। বাংলা ভাষা হচ্ছে বাঙালি জাতির জীবন-মরণ প্রশ্ন। পেশাদার রাজনীতিবিদদের কাছে আসন্ন প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু ছাত্র-সমাজের কাছে মায়ের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষাটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। সুতরাং অতশত তত্ত্বকথা বুঝি না। বাংলা ভাষা ‘দাবি দিবস’ অথাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি যেভাবেই হােক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার অবতীর্ণ হতেই হবে।
এই প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ঘটনাবলী পর্যালােচনা করা অপরিহার্য বলে মনে হয়। এইদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় যখন রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কর্মীরা বাংলা ভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল’-এর প্রচারপত্র বিলি করছিলাে ঠিক তখনই মুসলিম লীগ সরকারের প্রচার দফতরের ভ্যান থেকে মাইকে এ মর্মে ঘােষণা হচ্ছে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করায় সভা-সমাবেশ এবং শােভাযাত্রা ছাড়াও পাঁচজনের বেশী লােকের একত্রে জমায়েত নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হলাে।
২০শে ফেব্রুয়ারি বিকেল নাগাদ শহরে ১৪৪ ধারা জারির খবরটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (পুরাতন ভবন) মধুর স্টলে এসে পৌছলে ছাত্রদের মধ্যে আবার নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। সন্ধ্যায় ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সলিমুল্লাহ হলে এবং জনাব সাহাবুদ্দীন আহমদের। (পরবর্তী সময়ে বিচারপতি) নেতৃত্বে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত দু’টি ছাত্রসভাতেই ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। এদিকে মেডিক্যাল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাও অনুরূপ মনােভাব ব্যক্ত করে। ফলে প্রতিনিধিদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। রাতে নবাবপুর জরুরি বৈঠকের বিবরণ আগেই উল্লেখ করেছি। ১১-৪ ভােটে (কমরেড তােয়াহা ভােটদানে বিরত) কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে না। এরপর নেতৃবৃন্দ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েই স্ব স্ব বাসভবনে প্রত্যাবর্তন করলেন।
ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিশ, খেলাফত রব্বানী পার্টি প্রভৃতি ইসলামী আদর্শের গােষ্ঠীগুলাের ভূমিকাও এখানেই পরিসমাপ্তি।
২০শে ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ১০টা নাগাদ ফজলুল হক হলে বসেই আমরা কর্মপরিষদের এই ‘কাপুরুষােচিত’ সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম। আরও জানতে পারলাম যে, কর্মপরিষদের কিছু কর্মী ঘােড়া-গাড়িতে মাইক লাগিয়ে এই রাতেই ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় প্রচার অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। এবারের ঘােষণা হচ্ছে :‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রস্তাবিত হরতাল প্রত্যাহার হয়েছে। এই ঘােষণা তখন আমাদের কাছে করুণ ক্রন্দন আর আর্তনাদ মনে হচ্ছিল।
১লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে গত ২০ দিন যাবৎ শত শত ছাত্র ও যুব কর্মী অক্লান্ত পরিশ্রম করে একুশের হরতালের জন্য যে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, তা সর্বদলীয় কর্মপরিষদের এক সিদ্ধান্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেলাে। ২০শে ফেব্রুয়ারি শীতের গভীর রাতে যখন দূর থেকে মাইকের আওয়াজে ভেসে আসছিলাে, হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে, তখন ফজলুল হক হলের এক কামরায় বসে আমাদের গুটি কয়েক ছাত্রের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, “১৪৪ ধারা ভাঙবােই। ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল করবােই।”
কিন্তু কিভাবে? হাতে তাে আর ঘণ্টা আটেক সময় মাত্র? সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সদস্য নন, এমন কিছুসংখ্যক ছাত্রনেতাকে অনতিবিলম্বে খবর দেয়া হলাে যে, রাত ১২টায় ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে জরুরি গােপন বৈঠক হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য সংগ্রামী কর্মসূচি স্থির করা। এই বৈঠকে নিম্নোক্ত ১১ জন ছাত্রনেতা এসে হাজির হলেন : ১। গাজীউল হক (বিশিষ্ট আইনজীবী)। ২। হাবিবুর রহমান শেলী (বিচারপতি)। ৩। মােহাম্মদ সুলতান (মরহুম বামপন্থী নেতা)। ৪। এম আর আখতার মুকুল লেখক)। ৫। জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)। ৬। আব্দুল মােমিন (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী)। ৭। এস এ বারী এটি (বিএনপি’র প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী)। ৮। সৈয়দ কামরুদ্দীন হােসেইন শহুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। ৯। আনােয়ারুল হক খান (মুজিবনগর সরকারের তথ্য সচিব)।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম