বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ এপ্রিল সোমবার, ৩রা বৈশাখ, ১৩৮০
আজ ঈদে মিলাদুন্নবী
আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (দঃ) জন্মগ্রহণ করেন তিনি পরলোকগমন করেন ওই একই তারিখে। অজ্ঞানতা ও পঙ্কিলতার মধ্যে যখন সমাজ আচ্ছন্ন তখন শান্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলা মহান বাণী নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) আরব ভূমিতে আবির্ভূত হন। তার চিন্তা চেতনা শুধু সামাজিক অবক্ষয় থেকেই আরবি ওদের রক্ষা করেনি বরং তৎকালীন রাজনৈতিক অগ্রসরতার দিকনির্দেশ হিসেবে তা চিরদিন অম্লান থাকবে। তিনি ছিলেন প্রগতি ও সামাজিক ন্যায় বিধানের প্রতীকস্বরূপ। তার মৃত্যুর পরও ইসলামের মূল বক্তব্য ও অনুশাসন মোতাবেক মানুষের আত্মিক সমৃদ্ধি সাধনে বহুলোক চিন্তা সাধনা করে গেছেন। বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইসলাম এক বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই ইসলামের নামে তথা ধর্মীয় অনুশাসনের নামে স্বার্থোদ্ধার, মতলববাজি ও জন নির্যাতনের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। যেহেতু মানুষের ভাবাবেগের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে ধর্মের একটা বিশেষ প্রভাব রয়েছে সেই হেতু তাকে অন্যায় ভাবে ব্যবহার করবার সুযোগ গ্রহণ করতে স্বার্থাম্বেয়ীরা কোন সময় পিছপা হয়নি। আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি বিগত পঁচিশ বৎসরে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল এই ইসলামকেই বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেবার জন্য কি জঘন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ন’মাস এই ইসলামের নামে চলেছে লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা এবং অগ্নিকাণ্ড। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে ন্যায়ের জন্যই তাদের সংগ্রাম। দু’লক্ষ মা বোনকে ধর্ষণ করার সময় ইসলাম রক্ষার তাগাদাকেই যুক্তি হিসেবে খাড়া করা হয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এই দ্বিতীয়বার আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতে যাচ্ছি। এই দিনটিতে তাই আমাদের শপথ নিতে হবে ইসলামকে প্রগতি ও সামাজিক ন্যায় বিধানের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর শিক্ষা ও তাই। তার শিক্ষা ও নির্দেশ অমান্য করে আর কেউ যাতে পবিত্র ধর্মকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বাস্থ্য অর্জনে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রেখে একমাত্র আমরা সেই মহান পথপ্রদর্শক এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের সেই উদ্বুদ্ধ করুক।
ওদের বাঁচতে হবে
প্রকৃতির ক্ষুব্ধ ভুজঙ্গ আবার আঘাত হেনেছে বাংলার বুকে। দুর্ভাগা বাঙালি আবার প্রকৃতির রুদ্ররোষের শিকারে পরিণত হয়েছে। এ যেন বাঙালির ললাট লিখন। প্রতিবছরই এটা ঘটছে। এজন্য বাংলার প্রকৃতির এক অলিখিত বিধান।
কালবৈশাখীর ছোবলে গত বৃহস্পতিবার ফরিদপুর জেলায় এক বিস্তীর্ণ জনপদ আবার বিরান হয়ে গেছে। মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট স্থায়ী ঘূর্ণিঝড়ের দুর্নিবার ভয়ঙ্কর আঘাতে আবার বাংলাদেশের শ’দুয়েক হতভাগা আদম সন্তানকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন হাজারের মতো। আর যে যে এলাকা বা গ্রাম গুলোর উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় অতিক্রম করেছে সেগুলোর অবস্থা আজ অবর্ণনীয়। কোথাও বা গাছের মগডালে ঝুলছে কারো দেহহীন মস্তক কোথাও বা এক গাঁয়ে অশ্বত্থ বা বটগাছ উড়ে গিয়ে হুমরি খেয়ে পড়েছে অপর গাঁয়ের টিনের ঢালার ওপর। নারকেল গাছের শীর্ষে অবস্থান করছে কোন কুলবধুর নিরাবরণ দেহলতা। সে এক অকল্পনীয় ব্যাপার। একদা যে জনপদ নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধা-যুব, তরুণী-প্রৌঢ় প্রাণের প্রাণ চাঞ্চল্য আর কল কাকলিতে ছিল মুখর প্রাণবন্ত আজ সে সব জনারণো যেন চিল শকুন আর কুকুরের ভেজ্যমচ্ছপ যেন। অসংখ্য গলিত লাশ আর আহত মানবতার আর্তনাদ উঠছে যেন ওদের উল্লাস ধ্বনি কানে বাজে।
সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় প্রলয় আর মহাপ্রলয় যেন এ বাংলা নিত্য সাথী। স্মরণকালের মধ্যে ১৯৬০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এগুলো বয়ে গেছে। তারমধ্যে সত্তুরের মহাপ্রলয় বিশ্ব ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। সেবারও বাংলার দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের চারশত বর্গ মাইল এলাকায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। অথচ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু এ দুর্যোগ কবলিত আহত অসহায় নিঃসহায় হতাশাগ্রস্ত মানবতার জন্য মানুষের করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে।
দুর্যোগ লাঞ্ছিত মানবতার জন্য বাংলাদেশ সরকার এ যাবৎ নগদে সাড়ে ছ’লাখ টাকা ও কয়েক হাজার টন খাদ্য বিনামূল্যে বিতরণ করার জন্য বরাদ্দ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তথ্য মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজ ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ইতিমধ্যেই সরেজমিনে দুর্দশাগ্রস্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে এসেছেন এক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায় পঙ্গু দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছেন ঠিক তখনই “বিষফোঁড়ের” মতো এই আঘাতে সরকারি বা একা কদ্দুর কি করতে পারবেন। এক্ষেত্রে দেশের একাংশে দুর্দশাগ্রস্ত এ মানব গোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য গোটা দেশবাসী কে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য বস্ত্র পথ্য ঔষধ অর্থ আর সামর্থ দিয়ে এই শ্মশানের বুকে রাবার প্রাণ চঞ্চল প্রাণবন্ত জনপদ জাগিয়ে তোলার জন্য আজ দেশের আপামর জনগণকে বিনাদ্বিধায় আর কালক্ষেপণ না করে ছুটে যেতে হবে। ছুটে গিয়ে বাঁচাতে হবে লাঞ্ছিত মানবতা কে তাই আজ আমরা দেশবাসীর কাছে এই জাতীয় সংকটকালে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাতে চাইঃ ছুটে যাও ওদের বাঁচাও।
পাকিস্তানের নয়া সংবিধান
পাকিস্তানের সংবিধান অবশেষে সেখানকার জাতীয় পরিষদের অনুমোদন লাভ করেছে। আগামী ১৪ই আগস্ট থেকে তা কার্যকর হবে বলে বলা হয়েছে। বিরোধী দলগুলো বেশকিছুদিন বিভিন্ন আপত্তি তুলে সংবিধান অনুমোদনে বিলম্ব করে আসছিল। অবশেষে সংবিধান পাস করা হয়েছে। দলগুলোর কোন আপত্তিই টিকেনি।
পাকিস্তানের সংবিধান গণতান্ত্রিক, কি অগণতান্ত্রিক, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কতটুকু নিশ্চিত করা হয়েছে অথবা তারা জনগণের কল্যাণই বা কতটুকু সাধন করতে পারবে তা নিয়ে আপাতত আমরা আলোচনায় যাচ্ছি না। যে বিষয়টা আমাদের বিশমিত করেছে তা হলো পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে উল্লেখ। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। ইতিমধ্যে ছোট বড় একশটি দেশ এই নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছাড়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন করে আলাপ-আলোচনা চলছে। খোদ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথা বার বার প্রকাশ করেছেন। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের নয়া সংবিধানে বাংলাদেশকে তার অংশভুক্ত বলে উল্লেখ করা শুধু বিস্ময়করই নয় বরং বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেও আমাদের মনে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর চক্রান্তের মারপ্যাঁচে ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি এমনিতেই বেশ নাজুক। তার উপরেই উপমহাদেশেরই একশ্রেণীর লোক সেই তপ্ত আবহাওয়াকে আরো অধিক উত্তপ্ত করে তোলার জন্য ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা, পাকিস্তানকে সমর সজ্জিতকরণ এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। মিঃ ভুট্টো বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই দায়িত্বগুলোই পালন করে চলেছেন।
সম্প্রতি উপমহাদেশের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সৎ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে যে উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে পাকিস্তানের এই নয়া সংবিধান সে উদ্যোগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। উপমহাদেশের শান্তি বিরোধী মহলও তেমনি আশা করে। তারা চায়না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশসমূহ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলুক। একে অন্যের সাহায্য এবং সহযোগিতার নিয়ে নিজ নিজ দেশের সমস্যা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। তারা এটা চায়না কারণ এতে এই অঞ্চলে তাদের খবরদারির অবসান ঘটবে, ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। নয়া সংবিধানের মাধ্যমে মিঃ ভুট্টো সেই শান্তি বিরোধী শক্তিকে মদদ যুগিয়েছেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক