বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ এপ্রিল শুক্রবার, ৩০শে চৈত্র, ১৩৭৯
এই মানবিক সমস্যার সমাধান হোক
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ড হেইম টিমের কাছে এক তারাবার্তা পাঠিয়েছেন। মহাসচিব এর কাছে প্রেরিত এই বার্তায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের আটক বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ আটক পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তনের আশু ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বাণীতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে কোন প্রকার পূর্ব শর্ত ছাড়াই অবিলম্বে বাঙালি ও পাকিস্তানিদের স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এবং এ ব্যাপারে মহাসচিবকে সকল উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি দাবি জানান। প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেছেন যে, আটক বাঙালি পাকিস্তানিদের যদি খুব দ্রুত ফেরত না দেওয়া হয় তাহলে উপমহাদেশের অন্যান্য অমীমাংসিত মানবিক সমস্যা মিটিয়ে ফেলার জন্য শুভ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা হবে না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মহাসচিব কুর্ট ওয়ার্ল্ড হেইমের বাংলাদেশ সফরে উদ্ধতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তৎকালে উভয়ের মধ্যে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর আশু নিষ্পত্তি আশা করেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখিত এই প্রস্তাব জাতিসংঘের মহাসচিব এর নিকট অভিনন্দিত হয়েছে এবং সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যা মোকাবেলায় কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে আটক বাঙালিও পাকিস্তানিদের স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সুইস সরকারের মাধ্যমে মীমাংসা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের প্রায় চার লক্ষ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা আজ একটা বিরাট নৈতিক দায়িত্ব জাতির সামনে সমুপস্থিত। এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আটক বাঙালি ও পাকিস্তানিদের স্ব স্ব দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা দরকার। এই মহান দায়িত্ব পালন করবে জাতিসংঘ। এটাই সমাচীন। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের মহাসচিবকে তার প্রস্তাব জানিয়েছেন। বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে শান্তিকামী দেশ। এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। বিশ্ব মানবতার জয় হোক এটা বাংলাদেশ কামনা করে। জাতির জনক শেখ মুজিবের সারা জীবনের সংগ্রাম এর মধ্যেও এই সত্যটি প্রমাণিত। তিনি উচ্ছৃংখলতাকে কোনদিন মেনে নিয়ে রাজনীতি করেননি। বাংলাদেশের মাটিতে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্য চরম বর্বরতা চালিয়েও যেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল সেদিন বাংলার জনগণ ইচ্ছা করলে বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করার পরও সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন আর প্রাণহানি নয় এবার দেশ গড়ার কাজে সবাইকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এরপর থেকে তিনি শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা দিকে জনগণকে আকৃষ্ট করেছেন। এবং আটককৃত পাকিস্তানিদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া আমরা আরও লক্ষ করেছি এবং বিশ্বজনমত স্বীকৃত হয়েছে যে, বাংলাদেশ আটক পাকিস্তানিরা দেশের সাধারন মানুষের জীবনযাত্রা থেকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। মূলতঃ শান্তি প্রত্যাশী বাংলাদেশের জনসাধারণ আজ তাদের আত্মীয় স্বজনকে ফিরে পেতে উন্মুখ। অন্যদিকে পাকিস্তানিদেরও ফিরে পেতে তাদের আত্মীয়-স্বজনের উন্মুখ। তাই আজ নিঃসন্দেহে মানবিক সমস্যা। আর এই মানবিক সমস্যার সমাধান করা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের নৈতিক কর্তব্য। তাই এই কর্তব্য পালনের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের মহাসচিবকে আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা উপমহাদেশের উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই একান্ত ভাবে কামনা করি। এ কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে স্বদেশের আটককৃতদের মুক্তি দিয়ে ফেরত পাঠানোর কাজ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের মহাসচিব মিঃ কুর্ট ওয়ালড হেইম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব আন্তরিকতার সঙ্গে অবিলম্বে বিবেচনা করবেন বলেই আমরা আশা করি।
মুন্সী রইসউদ্দীনের জীবনাবসান
পোস্ট গ্রাজুয়েট হাসপাতালেরে রোগশয্যায় অবশেষে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সাধক রইসউদ্দীনের জীবন নির্বাপিত হয়ে গেল। গত ১১ই এপ্রিল বুধবার সন্ধ্যা সাতটায় ওস্তাদজী আমাদের ছেড়ে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করলেন। ওস্তাদজী আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার রচিত সুর, সংগীতের ওপর গ্রন্থ এবং স্বরলিপির প্রস্তাব রয়েছে।
ওস্তাদ রইসউদ্দীন ছিলেন সংগীতের প্রতি একজন নিবেদিতপ্রাণ সাধক। সমগ্র জীবন ব্যাপী তিনি উন্নতির জন্য চিন্তা ভাবনা করে গেছেন। বাহাত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মৃত্যুকে আমরা তাই অকালমৃত্যু বলে অভিহিত করতে পারিনা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এমনই প্রকট যে, আমরা ওস্তাদজিকে রোগ আক্রান্ত অবস্থায় হারালাম। ব্রংকাইটিস এবং ডায়াবেটিসের রাহুগ্রাস থেকে আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ওস্তাদজীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ওস্তাদজীকে চিকিৎসা করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধু পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কাল-ব্যাধির আক্রমণে তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রামে বিজয়ী হতে পারলেন না। অথচ বেঁচে থাকার প্রশ্নে মৃত্যুর আগেও তিনি ছিলেন দারুণ আশাবাদী। সুস্থ হয়ে তিনি সংগীতের সুর লহরী সৃষ্টি করতে পারবেন বলে আশা পোষণ করেছিলেন। মৃত্যু তার সেই আশাতে ধূলিসাত করে দিয়ে গেল।
আমরা জানি মানুষের জন্ম গ্রহণের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। মৃত্যুকে কেউ রোধ করতে পারেনা। এই অনিবার্য নিয়তিকে আমাদের মাথা পেতে মেনে নিতে হবেই। শত চেষ্টা করেও আমরা আর ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দীনকে আমাদের মাঝে ফিরে পাবোনা। চিরাচরিত প্রথানুযায়ী আমরা ওস্তাদজীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করব। কিন্তু তাতে কি লোকান্তরিত আত্মার শান্তি হবে?
উচ্চাঙ্গ সংগীত জগতে মুন্সি রইসউদ্দীনের জীবনটি ছিল ঘটনাবহুল। তিনি অনেক নতুন রাগ সংযোগ করেছেন। সংগীত স্বরলিপি ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। একজন একনিষ্ঠ সংগীত শিক্ষক হিসেবে তার অবদান আজ আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
ওস্তাদজী আজ নেই এই বলে আমাদের শুধু শোকাভিভূত হলেই তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পাদন করা হবে না। ওস্তাদজীর স্মৃতিকে যাতে আমরা চিরদিন জাগরুক করে রাখতে পারি সে জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত দরকার। আমাদের দেশে এর আগেও অনেক গুণীজনের মহাপ্রয়াস ঘটেছে এবং কিছু দিন পর্যন্ত তাদের ঘিরে আলোচনার ঢেউ বয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে কিছুই হয়নি। আমরা তাদের ভুলে গেছি।
কাজেই, এই মুহূর্তে আমাদের মনে উদয় হয়েছে যে মুন্সির রইসউদ্দীনের কোথাও হয়তো আমরা একই নিয়মে একদিন ভুলে যাব। পৃষ্মতিক প্রবণতায় আমরা নিমজ্জিত হব। অতএব এখন থেকেই ওস্তাদজীর স্মৃতিকে জাগরুক এবং তার দুঃস্ব পরিবার-পরিজনের আর্থিক দুঃখ কষ্ট লাঘব করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
ওস্তাদজী তার জীবনের বর্ণাঢ্য ঘটনা নিয়ে একটি আত্মজীবনী রচনা করতে শুরু করেছিলেন কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি। তবে ৫৭টি স্বরলিপি পুস্তকের পান্ডুলিপি প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গেছে। অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ও অর্ধশতাধিক এই স্বরলিপি পুস্তকগুলো প্রকাশ করার জন্য আমাদের সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। এগুলো প্রকাশিত হলে ওস্তাদজীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে তেমনি তাঁর পরিবার-পরিজন ও আর্থিক দুর্গতির কবল থেকে রক্ষা পাবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক