বাংলার বাণী
ঢাকা: ১১ এপ্রিল বুধবার, ২৮শে চৈত্র, ১৩৭৯
সোজা পথে আসতে হবে
পাকিস্তানকে সাহায্য দানকারী পাশ্চাত্য দেশগুলো-এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আগামী জুন মাসের পর পাকিস্তানকে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে আর সময়ও সুবিধা দিতে রাজী নয়। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানকে বৈদেশিক ঋণ শোধের বিষয়টি ইতিপূর্বে এইড পাকিস্তান কনসোর্টিয়াম প্রায় ২৬ মাস ঝুলিয়ে রাখতে সম্মত হয়নি। এই ২৬ মাসের মেয়াদ আগামী জুন মাসের শেষ হবে। এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা ইচ্ছে থাকলেও আর অপেক্ষা করতে পারবেন না। তাই পাকিস্তানের গুপ্ত সরকারকে তারা চাপ দিতে শুরু করেছেন, যাতে তারা বৈদেশিক ঋণ শোধের ব্যাপারে জুন মাসের আগেই ঢাকায় মুজিব সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছেন।
বাতাস যে বর্তমানে পাকিস্তানের বিপক্ষে বলছে এবং সে বাতাসের তোড়ে পড়ে ভুট্টো সরকার যে হালে পানি পাচ্ছেন না ঋণ পরিশোধের প্রশ্নটি তারই প্রমাণ।
ভুট্টো সাহেব অনেক আশা করেছিলেন যে সম্প্রতি ঢাকায় যে ৬ টি আন্তর্জাতিক এজেন্সি এবং হাজার হাজার ১৯টি সাহায্যদাতা দেশ এর সঙ্গে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠক হয়েছে সে সময় ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে সাহায্যদাতা দেশগুলো বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারও কোন অবস্থাতেই সাবেক ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো আপোষ করবে না। তবে যদি পাকিস্তান বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেয় তখন দেখা যাবে গত চব্বিশ বছরের মধ্যে কত পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পাকিস্থানে এসেছে এবং সেদিনের কতটা অংশ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের নাম ভাঙ্গিয়ে কি পরিমাণ ঋণের অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের পাচার করা হয়েছে। এসব প্রশ্নের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন। পাকিস্তান যে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সহজে বাজিমাত করতে পারবে এমন মনে করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
আমরা যতদূর জানি ঢাকায় সাহায্যদাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক এজেন্সির প্রতিনিধিদের সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রশ্নটিই কোন কোন দেশ উত্থাপন করেনি এমন নয়। তবে বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যাখ্যা করেছে।
বাংলাদেশের বক্তব্যের মধ্যে কোনরকম ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই বলেই বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন যে ৮৫০ মিলিয়ন ডলারের চাহিদা দেখিয়েছেন, বিদেশি সাহায্যদানকারীরা তার মধ্যে অন্তত ৫৬০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে দিতে কোন তালবাহানা বা বিলম্ব করবে না।
সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, গোটা পরিস্থিতি বাংলাদেশের অনুকূলে। পাকিস্তান যদি নতুন সাহায্য না পায় তাহলে অর্থনৈতিক সংকটের অতলে তলিয়ে যাবে। তাই ভুট্টোকে আগের হম্বিতম্বি ছেড়ে সোজা পথে আসতে হচ্ছে। ঘটনার গতিপ্রবাহ বাধ্য করছে সোজা পথে এগিয়ে আসতে। ইতিহাসের বিচিত্র গতি বোধহয় একেই বলে।
অযথা অপচয় কেন?
গতকালের বাংলার বাণীতে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’ শীর্ষক সংবাদের বাংলাদেশ বিমানের আভ্যন্তরীণ কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ বিমান সম্প্রতি ছয় লাখ আন্তর্জাতিক টিকিট ছাপাবার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার তিন লাখ টাকা খরচ হবে এবং তারপরে শতকরা দেড়শ’ ভাগ শুল্কের শতকরা তিরিশ ভাগ বিক্রয় কর ও টিকিট ভাড়া মিলিয়ে আনুমানিক প্রায় চৌদ্দ লাখ টাকা খরচ হবে। এর ফলে প্রতি টিকিটের ছাপা খরচ প্রায় পৌনে তিন টাকা পড়বে।
খবরে আরো প্রকাশ যে, বাংলাদেশ বিমানের টিকিট ছাপানোর উদ্যোগ সম্বন্ধে বিমানের ফাইন্যান্স ম্যানেজার ও কিছু জানেন না বলে তিনি জানিয়েছেন। অথচ উত্তরা ব্যাংকের লন্ডন অফিস ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিসে এই টিকিটে বিজ্ঞাপন দেয়ার অনুমতি চেয়েছে।
গোপনীয়তার সঙ্গে লন্ডন থেকে বাংলাদেশ বিমানের টিকিট ছাপানোর উদ্যোগ উত্তরা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বিস্মিত ও বিভ্রান্ত করেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে আন্তর্জাতিক টিকিট ছাপাবার জন্য ব্যাংকের কাছে বিজ্ঞাপন দেয়ার অনুরোধ জানায় এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি উত্থাপনও করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের লন্ডন অফিস থেকে যে অনুরোধ পেয়েছেন তাতেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায় যে, সরাসরি লন্ডন থেকে টিকিট ছাপানো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এছাড়াও কথা আছে। বাংলাদেশে যদি এই আন্তর্জাতিক টিকিট ছাপানো হয় তবে টিকিট প্রতি খরচ পড়ে সোয়া এক টাকার মতো এবং ঢাকাতেই সুন্দর ও উন্নত মানের আন্তর্জাতিক টিকিট ছাপাবার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে চালু টিকিটগুলো বাংলাদেশেরই ছাপা।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে কোন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেই। কবে থেকে এই ফ্লাইট নিয়মিত চালু হবে তাও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই নগন্য সংখ্যক যাত্রীদের জন্য ছয় লাখ টিকিট ছাপাবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এছাড়াও লন্ডনে ছাপা প্রতি টিকিটের খরচ যা পরবে বাংলাদেশ ছাপালে তার অর্ধেকেরও কম খরচ প্রতি টিকেটে পড়বে। আবার লন্ডনে ছাপা টিকিটের টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করতে হবে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেশ গড়ার নানাবিধ কাজে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন। বৈদেশিক মুদ্রা অতি কষ্টে বাংলাদেশ আয় করে। বাংলার মাটি, জল, হাওয়ার মতো বাংলাদেশের অর্থ সম্পদও জনগণের। জনগণের এই অর্থ সংকটের দিনে টিকিট ছাপাবার বিলাসিতায় খরচ করবার কি আবশ্যকতা আছে।
সবার উপরে মানুষ সত্য-
বাংলার বাউলশ্রেষ্ঠ মরমী কবি শাহ লালন ফকিরের দুইশততম জন্ম জয়ন্তী তাঁর পবিত্র জন্মভূমি যশোর জেলার হরিণাকুন্ডু থানাধীন হরিশপুর গ্রাম সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পালিত হয়েছে। বাংলার আলোবাতাস এবং মাটির রসে সঞ্জীবিত যে ক’জন অশিক্ষিত অথচ মরমী কবি সাহিত্যিক এবং দার্শনিক রয়েছেন লালন শাহ লালন ফকির তাদের মধ্যে অন্যতম।
অধ্যাত্ম সাধনা বাংলাদেশ একসময় দারুণভাবে বিস্তার লাভ করেছিল কিন্তু সেই অধ্যাত্ম সাধনার মূল তত্ত্বটিকে আবার অনেকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। এবং তারই ফলে অধ্যাত্ম নামে অনেক অনাচার এবং অসামাজিক কাজকর্মও সংঘটিত হয়েছে। যেমন পাকিস্তানিরা ধর্মের নামে অধর্মমূলক ক্রিয়াকাণ্ড করতে দ্বিধা করেনি। এরমধ্যে আবার পাশ্চাত্য দর্শন তত্ত্বের নতুন দিক এদেশে ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করে। সেই অধ্যাত্ম বাংলাদেশ থেকে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
সূর্যের আলো যেমন সত্যি, তেমনি সঠিক অধ্যাত্ম তত্ত্বের এবং জীবন দর্শনের মূল তত্ত্বটিও শাশ্বত। তাই জীবন-দর্শনের সেই মূল সুর এবং কথা কোনদিন মিথ্যা হয় না, যুগ যুগ ধরে তা আলোর মতোই শাশ্বত রূপ নিয়ে বিরাজ করে। বাংলার অক্ষত পল্লীর অখ্যাত পরিবারে জন্ম নিয়েও শাহ লালন ফকির জীবন সম্পর্কে যে দর্শন প্রচার করেছিলেন সভ্য সুন্দর সেই দর্শন তত্ত্ব আজও একই ঔজ্জ্বাল্যে উদ্ভাসিত। মানুষের প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি উদার মনোভাব শাহ লালন ফকিরের অধ্যাত্মতত্ত্বের মূল সুর তার জীবন দর্শনের সঞ্জীবনী সুধা তা বর্তমান গতিবাদ দর্শন তত্ত্বের অনুসারীদেরকে সচকিত করে তুলেছে। শাহ লালন ফকিরের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে এখনো মতভেদ দূর না হলেও সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, বিশেষ কোন ধর্মের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বর্ণগোত্র সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষ এক এবং একই মানুষকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনদর্শন তা চিরকাল সূর্যালোকের মতোই উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে।
দারিদ্র, খুদা, যুদ্ধ, ধ্বংস এবং মানুষের মানুষের যে বৈষম্যের নীতি আজও বর্তমান বিশ্বে বিরাজ করছে বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সমাজ জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ সেই সমাজে শাহ লালন ফকিরের অধ্যাত্ন তত্ত্বের সেই অমর বাণী সেই জীবনদর্শনের অনুসারী হয়ে আমাদের সেই সমাজ থেকে বিভেদ হিংসা, বৈষম্য, দারিদ্রতা ইত্যাদি সবকিছুর ঊর্ধ্বে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তার জন্মজয়ন্তী উদযাপন করা সার্থক হবে। এবং এজন্য বাংলায় এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়া সেই মহান পুরুষের অলিখিত বাণী সংগ্রহের সুব্রতা করার প্রতি সরকার এবং জনগণের মনোযোগ আমাদের আন্তরিক কাম্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক