বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩০ এপ্রিল সোমবার, ২৭শে বৈশাখ, ১৩৮০
উপমহাদেশে শান্তি ও বিশ্বজনমত
উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু শান্তি অন্বেষা শেষ হয়নি। শান্তিবাদী মহলের পক্ষ থেকে বারবার এসেছে শান্তির ডাক কিন্তু অশান্তির অপদেবতারা পরাজিত হয়নি। সুর অসুরের কাছে এমনি ভাবে মার খেয়েছে প্রতিবার। এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ কার্যকরী উদ্যোগ গৃহীত হয় কদিন আগে। বাংলাদেশ এবং ভারত এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা নির্ধারণ করে। সারা দুনিয়ার শান্তিবাদী মানুষ একে অভিনন্দন জানায়; পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘাড় বাঁকান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থহীন সিদ্ধান্ত ঘোষণা মিঃ ভুট্টো সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। দাদ নিতে চেয়েছেন তাই তিনি পাকিস্তানে আটক নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর।
প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর এই আচরণ অমানবিক। ফ্রান্সের প্রবীণ চিন্তাবিদ মঁসিয়ে মালরো ভুট্টোর এই আচরণের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। ধিক্কার ধ্বনী উঠেছে ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের নেতৃবৃন্দের মুখে। উপমহাদেশের সমস্যাবলী বিশেষ করে পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের সমস্যার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূতেরা বিদেশে রওনা হচ্ছেন। তারা পাকিস্তানের এই শান্তি বিরোধী ভূমিকা তথা সেখানে আটক বাঙ্গালীদের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যে বর্বরসুলভ নীতি অনুসরণ করে চলেছে তার সঠিক চিত্র তুলে ধরবেন।
পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের প্রশ্নে বিদেশে প্রচারকার্য তেমন ব্যাপক হয়নি বলে অনেকেরই ধারণা। তাছাড়া যুক্ত বিবৃতি এবং তৎপরবর্তীকালে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক সংখ্যা ঘোষণার পর দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধবন্দীদের থেকে অন্যত্র সরে যাবে। এই সময়টা তাই সবচাইতে উপযুক্ত সময়। ব্যাপক প্রচার কার্য এবং উপমহাদেশে সমস্যাবলী সঠিক চিত্র তুলে ধরতে যদি বিদেশে আমাদের দূতরা সত্যি সক্রিয় হন তবে বিশ্বজনমত ন্যায়তঃই আমাদের অনুকূলে থাকবে।
পাকিস্তানও যে অবস্থাটা একবার এই উপলব্ধি করতে করেনি এমন কথা বলা যায়না। দুদিন আগেই চীনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মিঃ আগা শাহী হংকংয়ে বলেছেন, মিঃ ভূট্টো নাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধী নন। তবে তার কথায় এ বিচার হতে হবে ‘বিচারের স্বার্থেই, প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে মিঃ ভুট্টোর ইতিমধ্যেই গোঁফ নেমেছে। এখন তাকে সম্পূর্ণ বাস্তবতাটাকেই মেনে নিতে হবে।
রেলপথে পণ্য চুরি
বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীসাধারণের যাতায়াতে পক্ষে যেমন দুর্গম হয়ে উঠেছে, তেমনি পণ্য পরিবহন ক্ষেত্রেও এক অচলায়তনে পরিণত হয়েছে। গতকাল বাংলার বাণীতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের রেলপথে বিভিন্ন মালামাল চুরি ও ক্ষতির পরিমাণ নাকি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। রেলপথে আজকাল আর কেউ তেমন মালামাল আনানেয়ার ব্যাপারে উৎসাহী নয়। ফলে রেলপথে মাল পরিবহন এর পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। কিন্তু তবুও মালামাল চুরি ও ক্ষতির পরিমাণ রীতিমতো অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। রেল কর্তৃপক্ষ রেলপথে চুরি ও ক্ষতি রোধ করার ব্যাপারেও নাকি সম্পূর্ণ অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। এজন্যই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ওপর আস্থা সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছেন। জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা রেলপথে পণ্য বহন না করে চড়ামূল্যে অন্যান্য যানে পণ্যসামগ্রী বহন করছেন। স্বাভাবিক কারণেই তাই বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী দাম বেশি পড়ছে। রেলপথে যদি যাত্রীর নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তাহলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অর্থহীন প্রহসনে পরিণত না হয়ে পারেনা। রেল কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার তথ্য কমিশনের রিপোর্টেও ধরা পড়েছে কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা আমরা জানিনা।
আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বর্বর হানাদার বাহিনী আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে একেবারে নির্মূল করে দিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অনেক ধকল সহ্য করেছি। এখনো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুগম হয়নি। ট্রেন যোগাযোগই দেশের বৃহত্তম এবং সস্তা যোগাযোগ ব্যবস্থা। ট্রেন যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের মানুষ এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গমনাগমন করেন। এবং রেলপথেই বাংলাদেশের বেশিরভাগ পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। কিন্তু রেলে পাঠানো মালামাল যদি পথের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায় কিংবা মালের ক্ষতি সাধিত হয়, তাহলে রেল যোগাযোগের প্রতি সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আস্থা হারানোর কোন অযৌক্তিক ব্যাপার নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, রেলপথে প্রেরিত মালামাল চুরি করে কারা? রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কি মালামাল রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসেন না? রেল পুলিশরা কি নাকে তেল দিয়ে নিদ্রাসুখ ভোগ করেন? বর্তমানে যে ব্যাপক হারে ট্রেন থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উধাও হয়ে যাচ্ছে তার জন্য কি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কে আমরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারিনা? এই প্রশ্নগুলো আমাদের মনে দারুণভাবে আলোড়ন জাগিয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে সুস্পষ্ট জবাব চাই এবং সরকারের কাছে নিবেদন করতে চাই যে, শুধু রেলওয়ে কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করলেই চলবে না, দেশের রেলওয়ে ব্যবস্থাকে জনসাধারণের কল্যাণে নিয়োজিত করার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, নানা সমস্যার যাঁতাকলে আজ জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত এর ব্যাপারে যদি পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং রেলে পাঠানো মালামাল অবাধে চুরি হয়ে যায়, তাহলে জনসাধারণ কোন সুখের জীবন যাপন করবে। রেলপথে পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়ার ব্যাপারটিতে যেন কোন রকম চুরি ও ক্ষতির শিকার কাউকে না হতে হয় সেজন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তীক্ষ্ণ নজর রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। রেলপথে পাঠানো পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে অবশ্যই শাস্তি মূলক বিধান প্রণয়ন করতে হবে। নইলে দেশের রেল যোগাযোগ এর প্রতি জনসাধারণের বিক্ষোভ এতোটুকু প্রশমিত হবে না। এবং রেলপথ জনসাধারণের কাছে একটি বিভীষিকার রূপ নিয়ে দেখা দেবে। তাই আমরা সরকার এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করছি যে, রেলপথে পণ্য চুরি যেমন করেই হোক অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
কলেরা প্রতিরোধে সময় থাকতেই ব্যবস্থা নিন
ঢাকা শহরে বর্তমানে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলা যায় যে, চলতি বছরের প্রথম থেকেই রাজধানীর বুকে বসন্তের সাথে সাথে কলেরাও দেখা দেয়। খবরে প্রকাশ, জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় সহস্রাধিক শুধু বসন্ত আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
কলেরা রোগ প্রতিরোধ করার জন্য এ পর্যন্ত ৬৪টি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং এই সব কেন্দ্রে ১৮৬ জন দক্ষতা এবং ইনজেকশন দানকারী কাজ করে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। উক্ত খবরের উল্টো দিকে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, এই সব টিকা ও ইনজেকশন দান কেন্দ্রে কোথাও বা ইনজেকশন দেওয়ার লোকই নেই অথবা ওষুধ নেই।
এবার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক এই সব ছোঁয়াচে ও ভয়াবহ রোগের প্রতিরোধক ব্যবস্থা কতটুকু, প্রতিষেধক ব্যবস্থাই বা কতটা আর রোগ বিস্তারের সহায়ক অবস্থা গুলি কি কি? প্রতিরোধকল্পে নাকি টিকাও ইনজেকশনের কেন্দ্র খোলা হচ্ছে। প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে রোগীর চিকিৎসা ও হাসপাতালিকরণ করা হচ্ছে। অপরদিকে রোগ বিস্তারের সহায়ক অবস্থারূপে বাজারের খোলা বাসী ও পচা খাদ্য বিক্রি হচ্ছে অবাধে এবং বলতে গেলে যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সাধারণভাবে মোটামুটি সুস্থ থাকার জন্য কতগুলো মৌলিক চেতনাই যথেষ্ট। সেগুলো হলো খাদ্য ও পানীয়। পানি বাহিত রোগ ও বায়ু বাহিত রোগের সবগুলোই ঐ দুটি সূত্র থেকে আসে। আর ঠিক ঐ দুটি ব্যাপারে আমরা কেউই সচেতন নই। অথচ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মৌলিক ব্যাপারগুলি রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। উপযুক্ত প্রতিরোধ প্রচারণা, নিয়ন্ত্রণ ও আইনের প্রয়োগ করে জনসাধারণকে স্বাস্থ্য দান ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি এবং এ ব্যাপারে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়ার প্রস্তাব করছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক