You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩রা জুন, শনিবার, ১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০

শহীদ নুরুল হক ও রাজনৈতিক হত্যা

মাদারীপুরের নড়িয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নুরুল হক আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। গতকালকে সংবাদপত্রগুলোতে নিহত সংসদ সদস্যের এই করুণ মৃত্যু সংবাদটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির তিন দিনব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন শেষে গতকাল তাদের কতগুলি দাবিও প্রস্তাবও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। একই দিনে আওয়ামী লীগের জোর আহ্বান রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব নুরুল হক আততায়ীর গুলিতে নিহত সংবাদ ছাপা হয়েছে। তরুণ সংসদ সদস্য নুরুল হকের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। শান্তিকামী বাংলাদেশের জনগণও এ করুণ মৃত্যু সংবাদে মর্মাহত হয়েছেন, সেই সঙ্গে তাদের মনেও নানা প্রশ্নের উদ্রেক হবে। শান্তি ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আতঙ্কিত হবে। দেশবাসী সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তার প্রতি ও দেশের জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। সেই সঙ্গে জনসাধারণ যখন দেখবে একজন তরুণ রাজনীতিকের করুণ মৃত্যু সংবাদ তখন তারা অবশ্যই ব্যথিত হবে। জনাব নুরুল হক সাহেব মারা গেলেন। তিনি তার স্ত্রী ও দুটি মাসুম বাচ্চা ছাড়াও অসংখ্য আত্মীয় স্বজন ও শুভার্থী রেখে গেছেন। নুরুল হক সাহেবের মৃত্যুর নিঃসন্দেহে জাতীয় জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত হুমকি। জাতীয় সংসদ সদস্যের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথবা বলা চলে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় আওয়ামী লীগ তার প্রস্তাবে দেশের একশ্রেণীর সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক হত্যা, লুট, রাহাজানি এবং স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ক্রীড়ানক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার এবং এদেরকে বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া উক্ত বৈঠকে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করা এবং জনগণের দুর্দশার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে যারা দুর্নীতির দ্বারা সংকটের সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে সভায় মূল্যবান আলোচনা হয় এবং দেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাগুলোকে ব্যাপক তৎপর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। মূলত দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা আজ সবচেয়ে বড় সরকারি দায়িত্ব। যে কোনভাবেই হোক দেশের দুঃখী জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। রাজনৈতিক হত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে। ইতিপূর্বে বহুবার আমরা এ সম্পর্কে আমাদের মতামত কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমরা মনে করি দেশবাসী জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের নৈতিক কর্তব্য। এ কর্তব্য যে কোন শর্তেই তাদের পালন করতে হবে।

প্রথম বাজেট অধিবেশন

আজ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন এবং সংবিধানের ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের এটাই প্রথম বাজেট অধিবেশন। জাতীয় জীবনে এই প্রথম বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। বাজেট দেশ এবং জাতিকে একটি উন্নততর ব্যবস্থা উন্নীত করার জন্যই রচিত হয়। এবং বাজেটের ভিত্তিতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণীত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য এবং জনগণের জীবনযাত্রার সুসংহত করার জন্য বাংলাদেশের এই প্রথম বাজেট অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে যে, এই প্রথম বাজেট অধিবেশন প্রায় দু মাস ধরে অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংসদের এবারের অধিবেশনটি অন্যান্য কতিপয় কারণেও গুরুত্ববাহি। জানা গেছে, এবারের বাজেট অধিবেশনে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত আইন সহ প্রায় অর্ধ ডজন আইন প্রস্তাব আকারে প্রকাশ করা হবে। এছাড়াও, দশটি অর্ডিন্যান্স অধিবেশনে পেশ করা হবে। এবারের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সূচনা পর্ব হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনগণের জীবনে যে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে, তার নিরসনকল্পে প্রথম বাজেটের একটি ভূমিকা রয়েছে। প্রথম বাজেট জনগণের নানা অভাব-অভিযোগ মোচনের পদক্ষেপ যেমন ঠিক, তেমনি এ বাজেট বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। আমরা আশা করব প্রথম বাজেট অধিবেশনে ১৯৭৩-৭৪ সালে সাধারণ বাজেট ও রেল বাজেট পেশ করা হবে, তাতে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হবে। কারণ বাজেটই একটি জাতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য সমুদয় পরিকল্পনা রচনা করে এবং এই বাজেটের ভিত্তিতেই দেশ এবং জাতি মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করে। প্রথম বাজেটে কোন খাতে ব্যয় করা হবে, কি কি উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হবে তা আমরা জানি না। তবে আমরা আশা করি দেশ এবং দেশের মানুষের জরুরী প্রয়োজন গুলো মেটানোর জন্য এই বাজেটে একটি সুনির্দিষ্ট কল্যাণমুখী পরিকল্পনা থাকবে। সারাদেশে আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশের মানুষও সমস্যামুক্ত নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। কোন কোন দ্রব্য বাজারে পাওয়াই যায় না। আবার পাওয়া গেলেও অর্থনৈতিক অনটনের জন্য সাধারন মানুষ তা ক্রয় করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই বর্তমানে বেঁচে থাকাটা এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় জনগণের দুর্ভোগ অবসানের জন্য প্রথম বাজেট অধিবেশন কতটুকু হবে তা বাজেট প্রণেতাদের গভীরভাবে বিবেচনা করেই প্রথম বাজেট পেশ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। এই বাজেটের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং এই বাজেটের ভিত্তিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে আমরা জাতীয় সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশনের সর্বতোসাফল্য কামনা করি।

আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের প্রতিজ্ঞা

গতকাল শুক্রবার সারাদেশে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস। সারা বিশ্বেও যথার্থ মর্যাদার সাথে দিনটি পালন করা হয়েছে। ঢাকায় এ দিনের প্রধান কর্মসূচির অন্তর্ভুক্তি ছিল কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার একটি চিত্র প্রদর্শনী। সোভিয়েত দূতাবাসের সাংস্কৃতিক বিভাগীয় কার্যালয়ে এই চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
আন্তর্জাতিক শিশু দিবস বিশ্বের সকল শিশুর সমান অধিকার আর জীবনযাত্রা সমান সুযোগ দানের জন্য পালিত হয়ে থাকে। ‘বিশ্বের সকল শিশু এক এবং অভিন্ন’ এটাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের স্লোগান। বিশ্বের সকল শিশুর জন্যই চাই অন্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের সমান অধিকার-সমান অধিকার দিতে হবে বিশ্বের সকল শিশুকে তাদের মানসিক বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধের পরিপূর্ণতা আনয়নের ক্ষেত্রে। এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের আদর্শ ও উদ্দেশ্য।
কিন্তু গতকাল বিশ্বের সর্বত্র যখন এ দিনটি পালিত হচ্ছিল তখন একটি কথা বিশ্বের বিভিন্ন উন্নতশীল দেশের তথা সাম্রাজ্যবাদী থাবার ক্ষত-বিক্ষত দেশগুলোর শিশুদের স্মরণ করে বার বারই উত্থাপিত হয়েছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নাপাম, বোমা, হাজার হাজার টন মৃত্যুবাণ আর হত্যা ধ্বংসের লীলাভূমি ভিয়েতনাম, লাওস আর কম্বোডিয়ার শিশুরা আজ যেখানে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মানবিক দাবির স্বীকৃতি ও পাচ্ছেনা, পাকিস্তানি হায়েনাদের সৃষ্ট বাংলাদেশের ধ্বংসস্তূপে যেখানে মাত্র জীবনের কলতান মুখরিত হয়ে উঠবার সুযোগ বার বার সামাজিক শত্রুদের ধারা ব্যাহত হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের যেখানে আজ সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়ানক ইসরাইলের হিংস্র থাবায় আরব শিশুরা প্রাণের আবেগ আর উল্লাস নিয়ে তাদের প্রিয় মরুচরে বেড়ানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত, আফ্রিকার শিশুরা যখন গায়ের রং কালো হওয়া মানবেতর জীবনের বোঝা বহন করছে, আন্তর্জাতিক শিশু দিবস প্রতিবছর তাদের কাছে নতুন আশার বাণী আর প্রতিশ্রুতি নিয়েই আসছে। যদিও ফি বছরের সকল প্রতিশ্রুতি পালিত হবার কোন সম্ভাবনা কখনো দেখা যায় না, আশার বাণী নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তবুও আন্তর্জাতিক শিশু দিবস সেখানে কিছুটা উজ্জীবনী শক্তি প্রদান করবেই।
তাই আন্তর্জাতিক শিশু দিবসে আজকের প্রতিজ্ঞা হোক বিশ্বের সকল শিশুই শিশু। আর এই শিশুদের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করার জন্য আমরা গড়ে তুলবো এক নতুন বিশ্ব, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আর হানাহানি যেখানটায় হবে নির্বাসিত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!