You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.05.20 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীতে বাংলাদেশ | স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত | বাংলাদেশে পোলিশ ছবির উৎসব | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২০শে মে, রবিবার, ১৯৭৩, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠীতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠী সদস্যভুক্ত করার জন্যে আসন্ন জোট নিরপেক্ষ দেশসমূহের সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির সুপারিশকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অভিনন্দন জানিয়েছেন।
সংবাদে প্রকাশ, আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ মুসা শফিকের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীতে ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালনে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সম্প্রতি কাবুলে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক সমাপ্ত হয়। প্রস্তুতি কমিটির এই বৈঠকে বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্যভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবাদে আরো প্রকাশ, আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ মুসা শফিক তাঁর দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন যে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশ তার ন্যায়সঙ্গত ও সুযোগ্য আসন লাভ করবে।
সম্প্রতি কাবুলে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিষয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন সন্তোষ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই উদ্দেশ্যে এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমা শাসকবর্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে।
পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানকে নিজেদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লেজুর বৃত্তির উদ্দেশ্যে সেন্টো-সিয়াটো সহ বিভিন্ন সামরিক যুদ্ধ জোটে আবদ্ধ করেছিলো। যুদ্ধজোটে সাবেক পাকিস্তান জড়িয়ে পড়ার ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন দূরে থাক যুদ্ধের আগুনে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই ছিলো সবচেয়ে বেশী। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অদৃশ্য ইঙ্গিতেই সাবেক পাকিস্তান দু’বার প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধবাজ নীতির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং সর্বশেষে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুর্যকে ছিনিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের জন্মলগ্ন থেকেই প্রত্যয়দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছে, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়—সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং জোট নিরপেক্ষতাই হলো আমাদের লক্ষ্য।
বাংলাদেশ বিশ্বের সকল নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের স্বপক্ষে। সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিকতাবাদও সকল শাসন শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা বোধ করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীরিত মূল কথাই হলো শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও জোট নিরপেক্ষতা।
আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আসন্ন সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশ তার ন্যায়সঙ্গত ও উপযুক্ত আসন লাভ করবে এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।

স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত

স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত চলছে। এতদসংক্রান্ত বিস্তৃত খবরা-খবরও বেশ কিছুদিন থেকে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। একথা শুধুমাত্র সংবাদ হয়ে খবরের কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এই বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রমাণও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। সর্বশেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের সাধারণ সম্পাদক দলীয় কর্মসূচী হিসেবে আহুত ছাব্বিশে মে প্রতিবাদ দিবসকে সফল করে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রদত্ত বিবৃতিতেও এই চক্রান্তের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
স্বাধীনতা এবং সমাজতন্ত্রের কর্মসূচীকে নস্যাৎ করার জন্যে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত সুসংগঠিত উপায়ে সক্রিয় রয়েছে এ ব্যাপারে আমরাও অনেক আগে থেকে বলে আসছি। এই চক্রটি বর্তমানে আরো তৎপর হয়ে উঠছে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সাম্প্রদায়িকতাকে সম্বল করে।
শাসন শোষণ পরাধীনতা সর্বশেষ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিধ্বস্ত এবং তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন চরম নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে। সারা দেশে খাদ্য, বস্ত্র এবং নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের এখন দারুণ অভাব। একথা সরকার ভালো করে জানেন এবং প্রাণপণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া চার লক্ষ বাঙালীকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করা ইত্যাদি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও সরকারের হাতে রয়েছে। সুতরাং একদিকে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন সংকট অবসানের জন্য সরকার যেমন সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন, তেমনি পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফেরৎ আনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষিতে বিদেশে জনমত সৃষ্টির জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দূতেরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। অত্যন্ত আশার কথা, এ ব্যাপারে বন্ধু ও বিদেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতিমধ্যে বিপুল সাড়াও পাওয়া গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান সংকট যখন সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বিরোধী দেশী ও বিদেশী চক্রান্তকারীরা দিশেহারা হয়ে দেশের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা অবস্থা সৃষ্টির জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ঘোলাজলে মাছ শিকারের পাঁয়তারা করছেন। সুতরাং এই অবস্থায় দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে রাজনৈতিক দল এবং দেশের ভবিষ্যত মেরুদন্ড যুবসমাজকে। অভাব অনটনের জ্বালা-যন্ত্রণায় ভাবাবেগে আপ্লুত হ’লে চলবে না, বুদ্ধি এবং সচেতন বিবেক দিয়ে দেশের সামগ্রিক অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এবং এগিয়ে যেতে হবে এর সমাধানের জন্যে। তাই রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, যুবসমাজ এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনগণের প্রতি আমাদের বক্তব্য—আমরা যেন মিথ্যা অনুভূতি এবং ভাবাবেগের শিকারে পরিণত না হই সেদিকে অত্যন্ত সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশে পোলিশ ছবির উৎসব

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় প্রথমবারের মতো একটি চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র দিয়েই বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা করা হলো। সাতদিনব্যাপী আয়োজিত পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনীকালে তথ্যও বেতারমন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ বলেছেন, আজ আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে দৈনন্দিন জীবন যাপন করছি, পোল্যান্ডের জনগণও একদিন এই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলো। মন্ত্রী মহোদয় পোল্যান্ডের চলচ্চিত্র থেকে বাংলাদেশের চিত্র নির্মাতারা ভবিষ্যতে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সর্বগ্রাসী মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার পর যে অপচ্ছায়া পোলিশ জনসাধারণের সামনে রক্তচক্ষু মেলে আবির্ভূত হয়েছিলো, তার অশুভ করালগ্রাস এখন বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবনেও দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ডে বাইজেভস্কি তাঁর ভাষণে আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশে পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসব দুই দেশের মৈত্রীবন্ধনকে নিবিড়তর করবে। পোল্যান্ডের ছবির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মিঃ বাইজেভস্কি বলেছেন, পোল্যান্ডের ছবি সেদেশের ইতিহাস এবং জনসাধারণের অপরাজেয় বন্ধুরাষ্ট্র সংগ্রামের।
বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পোল্যান্ড একটি অন্যতম প্রধান দেশ। পূর্ব ইউরোপের এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অকৃত্রিম সমর্থন দান করেছিলো এবং বাংলাদেশে হানাদার মুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দেশ হিসেবে পোল্যান্ড ছিলো প্রথম সারির রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে পোল্যান্ডের নানারকম সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পাদ্তি হয়েছে। বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পোল্যান্ডও যেহেতু একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ, সেহেতু পোল্যান্ডের ছবির উৎসবটি বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রমনা মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে একটি সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এবং উন্নত দর্শক রুচি গড়ে তোলার জন্যে এধরনের আরো চলচ্চিত্র উৎসব এবং চলচ্চিত্র উৎসব এবং চলচ্চিত্র সপ্তাহ আয়োজন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। পোলিশ চলচ্চিত্রে যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা রূপায়ণের অঙ্গীকার কাছে আমরা আশা করবো বাংলাদেশের চিত্রনির্মাতারাও সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সেলুলয়েডিত করতে অনুপ্রাণিত হবেন। নইলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে বদ্ধ জলাশয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই ডোবা-নালা থেকে বেরিয়ে এসে জীবনায়নের ছবি বাঙময় করে তুলতে ব্যর্থতারই পরিচয় দেবে। পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসবের তাৎপর্য যেন আমাদের চিত্রনির্মাতারা অনুধাবন করতে ব্যর্থ না হন, এই আমাদের কামনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন