You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩ এপ্রিল সোমবার, ১০ই বৈশাখ, ১৩৮০

জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হোক

অবশেষে সেনাবাহিনীকে ডাকা হয়েছে। বার্তাসংস্থা ওয়াকিবহাল মহলের সূত্র উল্লেখ করে বলেছেন যে, দেশের সর্বত্র যাতে খাদ্যশস্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের সমাজবিরোধী দুস্কৃতিকারীরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সেনাবাহিনীকে এসকল দ্রব্য পরিবহনের দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সময় মত দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত ভাবেই দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীলতার প্রাথমিক শর্ত। প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাবে যখন কোন অঞ্চল বিশেষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয় তখন হয়তো দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তার প্রভাব সৃষ্টি হয় না। কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া সত্বেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেক সময়ই রোধ করা সম্ভব হয় না এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকেই এক শ্রেণীর লোক অত্যাধিক মুনাফা লাভের মহাজনী নেশায় এমন বিভোর হয়ে পড়ে যে জনজীবনের কোন দুর্ভোগই তাদের সে পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। নানা প্রকার শাসানি হুমকির মুখেও তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ফলে জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে, ফুলে-ফেঁপে উঠেছে মুনাফা শিকারিদের উদর। অর্থলোভে তারা শিশুখাদ্য এবং ঔষধপত্র নিয়েও এমন কেলেঙ্কারি করতে পিছপা হয়নি। এখন খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহনে সেনাবাহিনীর দায়িত্বগ্রহণ জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কতটুকু সহায়তা করবে সেটাই দেখার বিষয়।
সময় মতো হাতের কাছে জিনিসপত্র পেলে জনগণের দুর্ভোগ হয়তো কিছুটা লাঘব হবে যদি ব্যবসায়ীরা একটু সংযত হোন। নইলে গুদামে জিনিস রেখেও দ্রব্য সংকট সৃষ্টি করার মহাজনী পথ তো তাদের খোলাই রইল। সরকারকে দু’চারটা গালমন্দ করে, মাল মেলে না এমন অজুহাত দেখিয়ে সহজ-সরল জনসাধারণকে ঠকাবার এমন কোনো দায়িত্ব নেই যা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অনুসরণ করেন নি। আমরা অবশ্য তাদের শুভবুদ্ধি প্রত্যাশা করবো তবুও যদি মানুষের দুর্ভোগ এতটুকুও ভয়।

বাংলার মাটিতে ওদের ঠাঁই নেই

ওরা উনচল্লিশ জন। বাংলাদেশের মাটিতে ওদের ঠাঁই নেই। ওরা বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবে না। একটা রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পর দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে। পেয়েছে স্বাধীনতার আলোক। স্বাধীনতার পরও ওরা দেশে ফিরে আসেনি। বিদেশেই রয়ে গেছে। শুধু বিদেশে অবস্থানই নয়। বিদেশে থেকে ওরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি। বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে সবসময় জড়িত থেকেছে। গত পরশু বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর কাছে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ৩৯ জনকে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার অযোগ্য বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তির আগেই ওই ৩৯ জন নরাধম বাংলার মাটি ত্যাগ করেছে। ওরা পাকিস্তান সহ অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্রে অবস্থান করছে। এবং এমন সব কর্ম করেছে যার ফলে ওদেরকে কিছুতেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা যায়না ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব (অস্থায়ী ব্যবস্থা) আদেশের ৩ ধারা অনুসারে ওদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নাকচ করা হয়েছে। এই ৩৯ জনের মধ্যে রয়েছে হামিদুল হক চৌধুরী, নুরুল আমিন, এ.টি সাদি, রাজা ত্রিদিব রায়, অধ্যাপক গোলাম আজম, ওয়াহিদুজ্জামান, ঠান্ডা মিয়া, কাজী কাদের, ডক্টর সৈয়দা ফাতেমা সাদেক, আব্দুল জব্বার খদ্দর এবং আরো ৩০ জন।
বাংলাদেশের শ্যামল মাটিতেই ওদের জন্ম। তবুও ওরা বাংলার মানুষের আপনজন নয়। ওরা বাংলাদেশের কুলাঙ্গার। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলে ওরা কখনো বাংলার আপামর মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ওরা পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর পদলেহন করেছে। শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত বাংলার মানুষের দুঃখের বোঝা ওরা কখনো নিজের কাঁধে বহন করেনি। পাকিস্তানের জন্মলগ্নের পরই ওরা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থের জন্য পাকিস্তানি প্রভুদের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করেছে। বাঙালির সমষ্টিগত স্বার্থের প্রতি ওরাসদা সর্বদাই বৈরী মনোভাব পোষণ করেছে। জনগণের কাছ থেকে থেকেছে নিরাপদ দূরত্বে। বাংলার মানুষ গণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখনই ওরা নির্লজ্জের মতো মীরজাফর এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গণআন্দোলন বানচালের জন্য আদা জল খেয়ে পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
বাংলার মানুষ যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণপণ সঁপে দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে তখন ওরা ঘরের শত্রু বিভীষণ এর মত পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এর পরিপন্থী কাজ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ ওদের আপনজন হিসেবে তাই কোনক্রমেই বরণ করে নিতে পারে না। এজন্যই বাংলাদেশ সরকার ওদের নাগরিকত্ব খারিজ করে দিয়ে একটি অভিনন্দনযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুগে যুগে মীরজাফরদের ভাগ্যে এই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে থাকে। মীরজাফররা পরিণামে একুল-ওকুল দু’কুলই হারায়। ইতিহাসের এটাই অমোঘ বিধান ৩৯ জন কুলাঙ্গার ইতিহাসের এই দুর্লভ বিধানকে অতিক্রম করতে পারেনি। স্বদেশের মাটিতে যেমন ওদের ঠাঁই হয়নি, তেমনি বিদেশের মাটিতেও ঘোড়া কুকুরের মত পদাঘাতই শুধু পাবে।

কার্যকরী পন্থা নেওয়া হোক

‘এই অবস্থা আর কতদিন চলবে?’ সবারই মনে ও মুখে এই প্রশ্ন। কারণ খাওয়া আর পড়া জীবিত থাকাকালীন এ দুটো কাজ তো বাদ দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে বাংলাদেশের কাপড়ের অভাবে গৃহবধুর আত্মহত্যা করার বহু ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। কাফন চুরির কথা প্রায়ই শোনা যেত তবে বর্তমানে বাংলাদেশে এইরকম ভাবে কথা বলা যায় না। বাজারের চেহারা দেখলেই একথার সত্যতা বোঝা যায়। কিছুদিন আগেও বাজারে কাপড়ের দোকান গুলো ফাঁকা দেখাত এবং ফুটপাতের দোকানগুলোর অধিকাংশ আর দেখা যেত না। ঘটনা দৃশ্যে বাজারে কাপড়ের দুষ্প্রাপ্যতা সম্বন্ধে মনে প্রশ্ন জাগতো। স্বাধীনতার পরে দেশে এই দারুন বস্ত্র সংকটের মোকাবিলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিক আমদানির মাধ্যমে কাপড়ের অভাব পূরণ করবার চেষ্টা করেন। ফলে বর্তমানে বাজারে প্রচুর কাপড় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সমস্যা হল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এই কাপড় আমদানি করলেও সেই কাপড় বাজারে যেন নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হয় তা নিশ্চিত করে দেন নি। ফলে ওই আমদানিকৃত কাপড় খোলা বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যে অবাধে বিক্রি হচ্ছে, লোকে কিনছেও, কারণ না কিনে উপায় নেই।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ন্যায্য মূল্যের দোকান, বিভিন্ন সংস্থা ও ছাত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাভাবিক মূল্যে যে কাপড় বিক্রি করেছে তা অতি অল্প সংখ্যক জনসাধারণের হাতেই পৌঁছেছে। অথচ দোকানে কাপড়ের উচ্চমূল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বেশি দামের কিনেছে বলে জানায়। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে, কাপড় ন্যায্যমূল্যের দোকানে পাওয়া উচিত তা কি করে সাধারন দোকানে যথেষ্ট দামে বিক্রি হয়?
এছাড়াও দেশে তৈরি কাপড়ের মূল্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। হয়তো এর জন্য উৎপাদনের স্বল্পতা এবং চাহিদার প্রাবলাই দায়ী। তদোপরি বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কাপড়ের অগ্নিমূল্য সম্ভবত এগুলোকেও প্রভাবিত করেছে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাজারে বর্তমানে যে অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে, তা হবার পেছনে কোন সঙ্গত কারণ নেই। বস্ত্র মূল্যের ঊর্ধ্বগতির পেছনে দুটো প্রধান কারণ কার্যকরী রয়েছে প্রথমত অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফালোভী সীমাহীন প্রলোভন, দ্বিতীয়তঃ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা।
অন্য ও বস্ত্রের অভাব একত্রে প্রকট হয়ে উঠলে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সে আশু প্রতিক্রিয়ার প্রতিরোধ করে তথা দেশের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে সর্বতোভাবে কঠোর ও কার্যকরী পন্থা নিতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!