You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৩শে মে, বুধবার, ১৯৭৩, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

এশীয় শান্তি সম্মেলন সফল হোক

আজ থেকে ঢাকায় বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে এশীয় শান্তি সম্মেলন শুরু হচ্ছে। তিনদিন ব্যাপী এশীয় শান্তি সম্মেলনের প্রথম দিনে বিশ্বশান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ পদক অর্পণ করা হবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, গত বছর অক্টোবর মাসে চিলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে এই ‘জুলিও কুরি’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সার্বিক প্রস্তুতির জন্যে ইতিপূর্বে যে জাতীয় প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো তাতে রয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামী যুবলীগ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, শ্রমিক লীগ, কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর পন্থী), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, মহিলা পরিষদ, মহিলা সমিতি, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের প্রতিনিধি।
আফ্রো-এশীয়-ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের প্রচন্ড বিক্ষোভ ও সংগ্রামের ফলে বিশ্ব মানবতার দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাততাড়ি গুটাতে যখন বাধ্য হচ্ছে, ঠিক এমনি একটা সময়ে বাংলাদেশের বুকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এশীয় শান্তি সম্মেলন। এ সম্মেলনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।
পাকিস্তানী আমলে এ ধরনের আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ছিলো কল্পনাতীত। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের অশেষ আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রামের ফলেই আজ স্বাধীন বাংলার বুকে সেই পটভূমি রচিত হয়েছে।
এশীয় শান্তি সম্মেলনের প্রতিনিধিরা এশিয়ার শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। সম্মেলনে সাতটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করা হবে তা হলো—(১) ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির সমস্যা, (২) ইন্দোচীনের জনগণের শান্তি ও স্বাধীনতা, (৩) পশ্চিম এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য শান্তি ও ন্যায়-বিচার, আরব উপসারের সমস্যা, (৪) সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি ও ঘাঁটিসমূহ, (৫) বিশ্ব শান্তির উদ্দেশ্যে এশীয় নিরাপত্তা, (৬) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও জাতীয় সম্পদ মুক্ত করার সংগ্রাম (৭) এশীয় জাতিসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা।
একথা আজ সুর্যালোকের মতো স্পষ্ট যে, নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশ এশিয়ার বুকে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক শক্তিরূপে কাজ করছে ও করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌল বক্তব্য স্থায়ী শান্তির স্বপক্ষে।
বাংলাদেশের জন্ম, ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি ইত্যাদি একের পর এক শান্তি ও প্রগতির সহায়ক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী আজ ঘরে বাইরে বিপর্যস্ত। তাই আবার কম্বোডিয়া আর লাওস, ইরান ও পাকিস্তানকে নতুন একটা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে এবং ইসরাইলকে নতুনভাবে মদদ জুগিয়ে এশিয়ার বুকে অশান্তির আগুন জ্বালাতে চাইছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী।
এ উপমহাদেশে শান্তির জন্যে যুদ্ধবন্দী মুক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাকিস্তানে আটক বাঙালী ও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের প্রত্যর্পণের প্রস্তাব দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত যে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তার স্বপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের দায়িত্ব আজ বিশ্বশান্তি পরিষদকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশের মাটিতে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, মাওবাদী চক্র ও প্রতিক্রিয়াশীলরা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার খাতিরে ওদের ন্যক্কারজনক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী আর প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে চাইছে। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের এ ঘৃণ্য প্রচেষ্টাকেও নস্যাৎ করে দিতে হবে। আমরা আশা করবো এশীয় শান্তি সম্মেলন শান্তি ও সকল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকে সমূলে উৎপাদিত করার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে জোরদার করবে। আমলা এশীয় শান্তি সম্মেলনের সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি।

ইরানের রণ পাঁয়তারা

সমর সরঞ্জাম এবং সাত শতাধিক হেলিকপ্টার ক্রয়ে জন্য শাহ মার্কিন দপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এই সমর সরঞ্জাম পাঁচ বছর ধরে সরবরাহ করা হবে। এই চুক্তি অনুসারে আণবিক অস্ত্র বাদে অন্য সব রকমের অস্ত্র সরবরাহ করার ফরমায়েশ দেয়া হয়েছে। কারণস্বরূপ তেহরানের সরকারী মহল যা জানাচ্ছে, তা হলো—প্রতিরক্ষামূলক স্বার্থে পারস্য উপসাগর এলাকায় প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভাবের জন্য শাহের অভিলাষ, প্রতিবেশী ইরাকে বৈরী সরকারের অস্তিত্ব, ইরানে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য রাশিয়া ইরাকী ও বালুচ উপজাতিদের উস্কানি দিচ্ছে এই মর্মে গুজব এবং ইরানে আরব গেরিলা আন্দোলন বিস্তারের আশঙ্কা।
পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় কর্তৃত্বের ব্যাখ্যাস্বরূপ শাহ আরও বলেছেন যে, তিনি সেখানে স্থিতাবস্থা রক্ষা করবেন এবং সেখানে যে সরকার থাকবে সে সরকাকে রক্ষা করাই হবে তাঁর কর্তব্য। এই যুক্তিতেই তিনি ওমানের শেখকে সাহায্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে বানচাল করছেন, প্রগতিশীল ইরাকী সরকারের পতন চাইছেন এবং পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইতিহাস আলোচনায় দেখা যায়, এই পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ইরান সর্বকালেই পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। তার প্রমাণ নিহিত আছে ডঃ মোসাদ্দেকের পদচ্যূতির মধ্যে এবং ১৯৬৭ সালে পাশ্চাত্য দেশসমূহকে তেল সরবরাহের সিদ্ধান্তের ভেতর। পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানকে হাতের পুতুল বানিয়ে বরাবরই একটা শক্তিকেন্দ্র গড়তে চেয়েছে। সেই দায়িত্বই এবার ইরান নিয়েছে। ইরানের এই অর্বাচীনতার আওতা থেকে এই উপমহাদেশ মুক্ত নয়। মুক্ত নয় বলেই পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শাহ।
১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের কালে পাকিস্তানী বিমানগুলো হামলা চালিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলো ইরানে। সেই নিরাপত্তাকে অধিকতর সুদৃঢ় করবার জন্য ইরানের শাহ অস্ত্র কিনছেন। চেষ্টা করছেন শক্তি অর্জনের। আর এই শক্তিকে সুসংহত করার জন্যেই ইরানে মার্কিন সৈন্য নামছে।
ক্ষমতা লাভের একচেটিয়া স্বত্বলাভের বাসনায় এবং পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার উদগ্র চেষ্টায় ইরান আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে ইরানের এই পদক্ষেপ ভয়ানক অশুভ এবং অর্থবহ। অর্থাৎ ইরানের শাহ তাঁর স্বপ্ন সফলের মানসে যে তান্ডব সৃষ্টি করতে চলেছেন, তাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে আরব ভূমি এবং এই উপমহাদেশের আকাশেও ঘনিয়ে আসবে প্রলয়ের ঘনঘটা। সেই মারাত্মক সংঘর্ষের স্পষ্ট সূচনা ঘটে গিয়েছে ইরানে মার্কিন সৈন্য অবতরণে। কিন্তু শাহ-এর এই স্বপ্ন টিকবেনা। বিশ্বমানবতার ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে তা একদিন খান খান হয়ে ভেঙে পড়বেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!