বাংলার বাণী
২২শে মে, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শান্তি ও বাংলাদেশ
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’ সম্প্রতি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি মূল্যবান অভিমত পোষণ করেছেন। পত্রিকাটির মতে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ ছাড়াও বিশেষভাবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সমস্যা সমাধানের স্বপক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স-এর মতে, এই নবজাত রাষ্ট্রটি শান্তি ও জোট নিরপেক্ষতা মেনে চলার কথা ঘোষণা করেছে। এবং যে সকল দেশ সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে সে তাদের সাথে সহযোগিতা করা ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। উল্লেখিত এই পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বেশীর ভাগ দেশ বাংলাদেশকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থারও সে সদস্যপদ লাভ করেছে। পিকিং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্প্রসারণ বাদীরা বিরোধিতা না করলে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারতো। বিভিন্ন প্রকার শক্তির শত্রুতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীলতা ও উন্নয়নের মতো জটিল সমস্যা সমূহ সমাধন করছে। পত্রিকাটি এ অভিমতও পোষণ করেন যে, এই নবজাত রাষ্ট্রটির সম্মুখে যে জটিল পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানের জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়েনর সহযোগিতা অনেক সহায়ক হবে এবং এই সহযোগিতার দ্বারাই বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে বেকারত্ব অবসান, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনের মান উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদানকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া কারিগরি সাহায্যও বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্যাপক সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে সোভিয়েত পত্রিকা ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স যে মন্তব্য করেছে তা অত্যন্ত মূল্যবান এবং সুদূরপ্রসারী। পত্রিকাটি বাংলাদেশের চিন্তা ও চেতনার যে সঠিক মূল্যায়ন করেছে তাতে পত্রিকাটি কৃতিত্বের দাবীদার। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। বিশেষ করে এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠায় দেশগুলোর মধ্যে যে সকল প্রতিকূল আবহাওয়া আজো অব্যাহত রয়েছে, তাকে মুলোৎপাটন করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে সকল অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে তার সমাধানকল্পে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত প্রস্তাবের মাধ্যমে তাদের অভিমত বিশ্ব বিবেকের কাছে তুলে ধরেছে। কিন্তু পাকিস্তান এ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনুকূলে একটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। প্রভু চীনের মদদ পেয়ে এবং বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগ্রহ নিয়ে সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চরম উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে। মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশের কাছে ভুট্টো সরকার ধর্ণা দিয়ে ফিরছে যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিনা বিচারে ফেরত নেবার জন্যে। ভারত-বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যেকার বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর অপচেষ্টায় সে মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ তার সুস্পষ্ট জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে বিশ্ব বন্ধুত্ব কামনা করে। এবং এশিয়া মহাদেশের শান্তির নিশ্চয়তা আশা করে। এ কারণে এদেশের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বার তার বিভিন্ন ভাষণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও এশীয় শান্তির স্বপক্ষে অভিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু আমরা পূর্বাপর লক্ষ্য করেছি যে, শান্তির শত্রু অনেক। তবু আমরা বাংলাদেশের মানুষ অনেক আশাবাদী। এশীয় শান্তিসহ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে যতদূর করণীয় অবশ্যই এদেশের মানুষ ও তাদের সরকার তা করে যাবে।
প্রতিবেশী সুলভ মনোভাবের মাধ্যমে আমরা বসবাস করা আগ্রহী তবে যদি কেউ আমাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দেখা দেয়, তাহলে আমরা দুর্গম পাহাড় হয়ে বাঁধা দিতে প্রস্তুত।
রফতানী উন্নয়নের জন্য তহবিল এবং বোর্ড গঠন
সরকার রফতানী উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছেন। উদ্দেশ্য বাজারের জরিপ, বাজারের উপর গবেষণা, বাজার সম্পর্কিত পরামর্শ দান, বিদেশে দ্রব্যের প্রদর্শনী কেন্দ্র খোলা, বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনীতে যোগদান, বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণ প্রভৃতি। এমন এটা তহবিল গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়ে আসছিলো স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই। বাংলাদেশী পণ্যের বিদেশী বাজার সৃষ্টি তথা পণ্য উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা প্রভৃতি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজন। প্রাথমিক অবস্থায় সরকার পাঁচ লক্ষ টাকা সাহায্য দিয়ে তহবিলের কাজ শুরু করেছেন। এই মর্মে একটা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে বাণিজ্য দফতরের বৈদেশিক বিভাগের সেক্রেটারীকে। এছাড়াও আরো ছ’জন সদস্য এই বোর্ডে রয়েছেন।
পণ্য উন্নয়ন এবং দেশীয় পণ্যের জন্যে বিদেশী বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গঠিত এই বোর্ড এবং তহবিল তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে বলে আমরা আশা করি। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের অনেক পণ্যের কথা বিদেশের কাছে অজানাই থেকে গিয়েছিলো। ঔপনিবেশিক স্বার্থেই পাকিস্তানী শাসকবর্গ এই নীতি অনুসরণ করে চলেছিলো। এছাড়া রয়েছে আমাদের এমন অনেক পণ্য যেগুলো বিদেশী বাজারে পরিচিত, কিন্তু বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখন বিশেষভাবে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। পাটের বাজার এখন দখল করে চলেছেন সিনথেটিক পণ্য। সুতরাং রফতানী উন্নয়নের জন্য গঠিত বোর্ডকে অবশ্যই তাদের কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল হতে হবে। জাতীয় স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে রেখেই তারা তাদের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করছি।
রফতানী উন্নয়নের নামে যাতে করে এই তহবিল একশ্রেণীর লোকের বিদেশ ভ্রমণের কাজেই ব্যয়িত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকেই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। দূর এবং নিকট অতীত আমাদের খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করেনি। ভালো ভালো উদ্দেশ্যের আড়ালে একশ্রেণীর মানুষ যে হীন স্বার্থ হাসিলে গত দেড় বৎসর যাবৎ তৎপরতা চালিয়ে আসছে, তাতে করে সত্যিকারের কোন সৎ-উদ্দেশ্যেই জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করে। নবগঠিত এই বোর্ড অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক