You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৮ই মে, শুক্রবার, ১৯৭৩, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সরকারী অনুকম্পা

বেশ কিছুদিন সরকারের বিবেচনাধীনে থাকবার পর অবশেষে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কতকগুলো অভিযোগ নেই দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত অথবা অভিযুক্ত এমন একশ্রেণীর লোকের প্রতি সরকার ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। অবশ্য যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু অথবা যুদ্ধ শুরুর প্রচেষ্টা, দেশদ্রোহিতা, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধসহ আঠারোটি অপরাধের যে কোন একটি বা সব কয়টিতে সাজাপ্রাপ্ত অথবা সুদির্নিষ্টভাবে অভিযুক্ত তাদের বেলায় এই ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হবেনা। স্বরাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্রের মতে দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত অথবা বিচারাধীন প্রায় বিশ হাজার লোক সরকারের এই ক্ষমা প্রদর্শনের আওতায় পড়বে। সরকারী ঘোষণার তিন সপ্তাহের মধ্যে এই সকল লোককে আবেদন করতে হবে এবং সেই সঙ্গে সদাচরণের মুচলেকা ও বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করতে হবে।
সরকার ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন অনেক বিচার বিবেচনার পর। এটা সরকারের বিবৃতিতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমরাও আশা করি, সরকার সবদিক সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা করেই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ক’দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে যখন সুনির্দিষ্ট কতকগুলো অপরাধে অপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদের ছাড়া বাকী সকল যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই আমরা দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের সম্পর্কে তদ্রুপ কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে আশা করেছিলাম। হয়েছেও তাই। অবস্থার বিপাকে পড়ে অথবা অন্যকোন কারণে যারা ভুল করেছিলো অথবা সাময়িককালের জন্য হলেও বিভ্রান্ত হয়েছিলো এমন অসংখ্য সাধারণ মানুষ সরকারের ক্ষমালাভ করবে।
সরকারের এই মানবিক ঘোষণাকে আমরা আন্তরিকভাবেই অভিনন্দন জানাই। যে সকল আমলা এবং রুই-কাতলা সেক্রেটারিয়েট রেডিও টেলিভিশন অফিসে বসে বাঙালী নিধনের নানা নীল নকশা প্রণয়ন করেছিলো এবং জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ করে বিশ্বমানুষের জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিত সব প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা করোছিলো; সরকারী ঘোষণার মাধ্যমে না হলেও তাদের অনেক যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের যখন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিলো তখন যদু-মধুদের আর শুধু শান্তি কমিটির সদস্য হওয়ার অপরাধেই আটকিয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারেনা। সরকার এদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু ক্ষমাপ্রাপ্ত রুই-কাতলা আমলারা যেমন সরকারী নীতি পদক্ষেপ বানচালে উঠে-পড়ে লেগেছে, সরকারীভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত এই বিপুল সংখ্যক মানুষও যাতে সেই একই অন্ধকারে তলিয়ে না যেতে পারে সেদিকেও সরকারের নজর রাখতে হবে।

ভুয়া বিষয়াদির বিরুদ্ধে

বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব রওশন আলী গত পরশুদিন সাংবাদিক সম্মেলনে এক ভাষণ দিয়েছেন। সমবায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন যে, দেশে বর্তমানে প্রায় আড়াই লাখ ভুয়া তাঁত রয়েছে। এই ভুয়া তাঁতের মাধ্যমেই দেশে সূতা কেলেকারী হচ্ছে বলে তিনি জানান। জনাব রওশন আলী ভুয়া তাঁতীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তাঁর তথ্য অনুযায়ী সমবায় সমিতির সদস্যভুক্ত তাঁতীদের সংখ্যা হলো তিন লাখ ছিয়াশি হাজার সাতশ’ তেইশ জন। উল্লেখিত সংখ্যক তাঁতীদের মোট চাহিদার এক-চতুর্থাংশ সূতা তাদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। তিনি অভিযোগ করেন যে, তাঁতীদের জন্যে এ্যালোটমেন্ট অনুযায়ী মিল থেকে সূতা সরবরাহ করা হয়না। এবং ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও ১১ হাজার বেল সূতা মিল থেকে দেয়া হয়নি। সমবায় চেয়ারম্যানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট সংখ্যক তাঁতীদের জন্যে মাসে ত্রিশ হাজার বেল সূতা দরকার। দেশের বা স্থানীয় মিলগুলো মাসিক খুব বেশী হলেও দশ হাজার বেল সূতা সরবরাহ করতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ হাজার বেল সূতা প্রতি মাসে বিদেশ থেকে আমদানী করা আবশ্যক। সমবায় চেয়ারম্যান অবশ্য টি.সি.বি’র মাধ্যম ছাড়া সমবায় সমিতির মাধ্যমে সূতা আমদানীর দাবী উত্থাপন করেছেন।
ভুয়া তাঁতীদের সম্পর্কে এ তথ্য প্রকাশে দেশের সূতা কেলেঙ্কারীর একটি ছবি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে বাণিজ্যমন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান পনেরো হাজার ভুয়া লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। তথ্য উদ্ঘাটন ছাড়াও আমরা বিশ্বাস করি দেশে বহু ভুয়া কারবার চলছে। যে তথ্যটি উদ্ঘাটিত হলো তাকেই শুধু বড়ো করে ভাবা হয়। অথচ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এ ধরনের বহু ভুয়া কারসাজি রয়েছে। ভুয়া তাঁত যখন তৈরীর ব্যাপারে শুধু তাঁতীদেরকে দায়ী করলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের যারা কর্মকর্তা, যারা এই সকল তাঁতকে অনুমোদন দান করেছেন তাঁরাও এ জন্য দায়ী। ভুয়া লাইসেন্সের ব্যাপারেও যারা লাইসেন্স প্রদান করেন এবং তাদের নিয়মাবলীপত্রে যখন বিভাগীয় কর্মকর্তারা কোন কিছু তদন্ত ছাড়া সই করেন বা কোন অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে তারা এই ধরনের ভুয়া ব্যবসায়ী বা তাঁতীদের জেনে শুনে লাইসেন্স প্রদান করেন তাঁরাও এই সকল ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারীর জন্যে সমভাবে দায়ী। সমবায় চেয়ারম্যান ভুয়া তাঁতীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন অথচ তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগের যারা কর্মকর্তা, যারা এই সকল ভুয়া তাঁতীদের উৎসাহ দিয়ে আসছেন তাদের বিরুদ্ধে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু বলেননি। আমরা মনে করি, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুয়া ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। এগুলো অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। বাণিজ্যমন্ত্রীর ভুয়া লাইসেন্স বাতিলের দৃঢ় পদক্ষেপের ন্যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল ভুয়া লাইসেন্স ও বাণিজ্য রয়েছে তা অবিলম্বে সরকারকে খুঁজে বের করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

খাদ্যসহ অত্যাবশ্যক পণ্য চলাচল

খাদ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য দেশের সর্বত্র সুষ্ঠুভাবে চলাচলের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, কুমিল্লাস্থ সেনাবাহিনীর কম্যান্ডিং অফিসারকে আহ্বায়ক করে পাঁচটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা একটি সময়োজিত বলেই আমরা মনে করছি। স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের জল ও স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিলো। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে বিদেশ থেকে আগত খাদ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে পারেনি। পর্যাপ্ত ট্রাক, রেলওয়ে ওয়াগন, বার্জ, কোস্টার প্রভৃতির অভাবে যে সব খাদ্যদ্রব্য বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে এসেছে অথবা আনা হয়েছে তা যথাসময়ে দেশের সর্বত্র পৌঁছতে পারেনি। উপরন্তু সে সব সামগ্রী জাহাজ থেকে খালাস, গুদামজাতকরণ এবং বিতরণে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ ও কর্মচারীদের গাফিলতি ও অনিয়মতান্ত্রিক এবং দুর্নীতির দরুণ যথাযথভাবে জনগণের হাতে পৌঁছেনি। ফলে দেশের সবখান থেকেই নানা অভিযোগ এসেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে ইতিমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও রাশিয়ার সহযোগিতায় এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং ভারত ও ‘আনরব’ থেকে বেশ কিছু ট্রাক ও রেলওয়ে ওয়াগন পাওয়া গেছে। ফলে খাদ্যদ্রব্য ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য দেশের সর্বত্র সময়মত পৌঁছানোর কাজে পূর্বের অভাব অনেকটা দূর হয়েছে। উপরন্তু আঞ্চলিক কমিটিগুলো গঠন করার ফলে তারা এখন নিজ নিজ এলাকায় পণ্য সামগ্রী চলাচলের বিভিন্ন অসুবিধাগুলোর পর্যালোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটিও তাদেরকে সময়মতো প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে পারবেন। সুতরাং আমরা আশা করছি, খাদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রী পরিবহনের জন্যে সরকারী বিভাগ ও এজেন্সী, কর্পোরেশন ও প্রাইভেট পার্টিগুলো আঞ্চলিক কমিটির সাহায্য-সহযোগিতায় খাদ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্য পরিবহনের কাজে আত্মনিয়োগ করবেন এবং সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। একই সঙ্গে আমাদের আরও বক্তব্য শুধুমাত্র পরিবহন সমস্যার সমাধান করলেই হবে না, সে সব পণ্য সামগ্রীর সুষ্ঠু বন্টনের জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার এ ব্যাপারেও সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা বিশ্বাস রাখি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!