You dont have javascript enabled! Please enable it! রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি - সংগ্রামের নোটবুক

রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি

শিক্ষক শ্রমিক ছাত্র কিষানকিষাণীর অতলান্ত সেই রক্তস্রোত

-দৈনিক বাংলা, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭২।

“আবার গোলযোগ হলে আমাদের পালানোর জায়গা আছে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবো, বেঁচে যাবো। ভাই, আপনারা যাবেন কোথায়? আপনাদের যে আর কোন পথ রইলো না।” প্রিয় মুসলিম সহকর্মীদের জন্য অকৃত্রিম সমবেদনায় সহকারী অধ্যাপক রেজাউল হককে এই কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে। আইয়ুবের যোগ্যতর উত্তরসূরি রক্তপিপাসু নয়া সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারীকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।

কিন্তু না। অধ্যাপক অধিকারী পালাতে পারেননি। বাঁচাতেও পারননি তার প্রাণ। তার এই তাৎপর্যবহ মন্তব্যের সাক্ষী দেওয়ার জন্য সৌভাগ্যক্রমে অধ্যাপক রেজাউল হক আজও বেঁচে আছেন।

১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর অধ্যাপক অধিকারী পালিয়ে ছিলেন। গাইবান্ধা মহকুমার সুন্দরগঞ্জে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় অপর সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কাশেমকে বলেছিলেন টাকা-পয়সা নেওয়ার জন্য কেউ যদি মেরে ফেলে তাদের হাতে মরতেও রাজী আছি। কিন্তু বর্বর খানসেনাদের হাতে নয়। বেতন নেয়ার জন্য রংপুরে এসেছিলেন। কিন্তু বেতন নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের ২ মাইল দক্ষিণপূর্বে দমদমার পুলের নীচে তার অপর তিন সহকর্মী রসায়নের লেকচারার কুমিল্লার শ্রী কালিচাদ রায় ও তার পিতা, দর্শনের লেকচারার বরিশালের শ্রী শুনেল বরণ চক্রবর্তী ও গণিতের লেকচারার বরিশালের শ্রী চিত্তরঞ্জন রায়ের সাথে খুনি পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।

“বাড়ী গিয়েও রেহাই নেই”

রংপুর কারমাইকেল কলেজের উর্দু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ সোলায়মান দিনাজপুরে তার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ী থেকেই সেনাবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি।

“তিনি কাজে যোগ দিতে পারেন নি”

রসায়নের লেকচারার কুড়িগ্রামের মহকুমার নাগেশ্বরীর অধিবাসী জনাব অব্দুর রহমান মে মাসের শেষদিকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজে যোগ দেওয়া হয়নি। তখন হয়ত এ দু’জন অধ্যাপক হত্যা করেছে। খান সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন রংপুর শহরের বিশিষ্ট সমাজ কর্মী ও রাজনৈতিক নেতা জনাব ইয়াকুব মাহফুজ আলী।

এপ্রিল মাসের গোঁড়ার দিকে রংপুর শ্মশান ঘাটে তাঁর সাথে আরও ১০ জনকে এক সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে এক দিনে।

আর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের কোন এক সময় রংপুর বার-এর বিশিষ্ট আইনজীবী একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী রংপুর জেলা ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রী শিবেন মুখার্জিকে সম্ভবত হত্যা করা হয়েছে। শেষ দিকে তিনি দিনাজপুরে জেলে ছিলেন। তারপর আর শিবেন বাবুর কোন খোঁজ মেলেনি।

“কত যে বধ্যভূমি”

গোটা জেলায় প্রতিটি শহরে মহকুমায়, থানায় আনাচে কানাচে, কত যে বদ্ধভূমি আছে তার অন্ত নেই। বিশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ নয়, যেখানে শত শত এমনকি হাজারে হাজার লোককে মেরেছে এমন বদ্ধভূমিগুলির মধ্যে উল্লেখ করার মত রংপুর শহরও সদর মহকুমার নবিনহাট, জাফরগঞ্জের পুল, নিশবেতগঞ্জ, শ্মশান ঘাট (রংপুর শহরের কাছে) সাহেবগঞ্জ এবং রংপুর শহরের কাছে মডার্ন সিনেমা হলের পিছনে এবং দেবিপুর।

এসব এলাকায় মানুষের হাড়গোড় অসংখ্য পড়ে আছে। ভাল করে খনন করা হলে শত শত নয় হাজার হাজার মানুষের কংকাল খুঁজে পাওয়া যাবে। রংপুর শহরের উপকন্ঠে কুকুরণের বিলে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

“গাইবান্ধা”

এছাড়া গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্ক, লালমনির হাট শহর এবং সৈয়দপুরে হাজার হাজার নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুন্দর গানুর এলাকা থেকে বহু ঘরের মা, বোনদের ধরে এনে পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে হত্যা করা হয়েছে। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত উত্তম নামক স্থানের রিকশাচালক আহাব উদ্দিন মডার্ন সিনেমা হলের পিছনের একদিনের হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

“গত নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ আমি যখন রংপুর রেলস্টেশনে আমার রিক্সার খোঁজ পাই তখন জুম্মাপাড়া নিবাসী পাক বাহিনীর জনৈক দালাল আমাকে ন্যাপের কর্মী হিসেবে দুষ্কৃতকারী ও মুক্তি ফৌজ বলে পাক বাহিনীকে সনাক্ত করে দেয়। তখন পাক বাহিনীর জোয়ানরা আমাকে আটক করে রংপুর মডার্ন হলে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে ১৪ দিন আটক করে রাখে। আটক অবস্থায় পাঞ্জাবী পুলিশ আমার দু’হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে আমাকে অমানুষিক অত্যাচার করে। তের দিন পর আমাকে ও আমার সাথে আটক আরও ১৩ জন লোককে যথাক্রমে লালমনির হাটের এক ক্ষত্রিয় মেয়ে, জিনকি, মালেকা, গাইবান্ধার আলী হোসেন, ফারুক, পলাশবাড়ীর আশরাফ আলী, রংপুর উপশহরের রিকশাচালক আলী ও অন্যান্য সবাইকে রাত্রি ১০ টার সময় মডার্ন হলের পিছনে নিয়ে যায়। আমার সামনে তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশ (এদের মধ্যে আজমল খান নামক এক সুবেদার পরে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে) পরপর পাঁচজনকে যথাক্রমে জিনকি, মালেকা, আলী হোসেন, ফারুক ও আর একজনকে যার নাম জানি না, আমার সামনে জবাই করেছে। তখন আমি অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে প্রাণভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি এবং সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাই।

যখন আমি মডার্ন হলে আটক ছিলাম তখন সেখানে ৩৪০ জন লোক ছিল। তাদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে তা বর্ণনা করা যায় না।“