মেজর জেনারেল অবঃ কে এম শফিউল্লাহর প্রতিবাদ
‘বিচিত্রা’ ১৯৮৩
১৩ মে ১৯৮৩ সংখ্যা বিচিত্রায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্ব’ এই শিরোনামে লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী আবদুল রকীবের লেখা একটি নিবন্ধ আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি তার নিবন্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় তার নিজস্ব ভুমিকার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে সব অবান্তর বক্তব্যের অবতারনা করেছেন। বর্ণিত এই নিবন্ধ অনেককেই আমার মতো আশ্চার্যন্বিত না করে পারে না। সম্পূর্ণ নিবন্ধটতেই তিনি তার মনগড়া কাহিনী ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরে রেখেছেন। তার পুরো নিবন্ধটির উপর আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। শুধু দু’একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছু কিছু পত্র পত্রিকায় আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু সাক্ষাৎকার কখনো কাউকে হীন করে তোলার বা নিজের কৃতিত্বকে প্রকাশ করার অভিপ্রায় ছিলো না। সাধারণভাবে যা ঘটেছে তাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি মাত্র।
লেঃ কর্নেল রকীব ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার তিনদিন পর এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহ চলে যায়। তার বক্তব্যানুযায়ী এই ব্যাটালিয়ন জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা তিনি একাই করেছেন এবং আমরা শুধু তার নির্দেশ অনুসারেই কাজ করে গিয়েছি। এর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত এই ব্যাপারে নিজস্ব কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনাই ছিলো না। তিনি ২৬শে মার্চের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ “ঐদিন বিকালে কিছু কিছু অফিসার, জেসিওদের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষ করে সুবেদার নুরুল হক সংশয় প্রকাশ করেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে পারে। আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি এবং ঐদিনই সন্ধ্যায় অতর্কিত হামলার মোকাবেলার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থাৎ অবস্থান সুদৃঢ় করা, অধিক সংখ্যক প্রহরী নিয়োগ ইত্যাদি বন্দোবস্ত করি।“
রকিব সাহেবের এই বক্তব্যে অবাক না হয়ে পারছি না কারণ তার এই মন্তব্যে আমাদেরও অদূরদর্শিতা এবং সমর প্রস্তুতির শৈথিল্যের ইঙ্গিত বহন করে বলে আমার মনে হয়। এই ব্যাটালিয়নকে যে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে তা জয়দেবপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাবাসীদেরও আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয় ছিলো। তাই ১৭ই মার্চ এলাকাবাসীরা জয়দেবপুর থেকে টঙ্গির রাস্তার উপর ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশি ব্যারিকেড তৈরী করে রেখেছিলো। যেখানে ঐ এলাকার জনসাধারণ আমাদের নিরস্ত্র করা হবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যারিকেড তৈরি করেছিলো সেখানে আমরা বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছাড়া ২৬শে মার্চ বিকাল পর্যন্ত নীরব, নিশ্চেষ্ট ছিলাম এটা তিনি কিভাবে কল্পনা করতে পারলেন।
জয়দেবপুরের জনগণের ব্যাটালিয়নের সমরপ্রস্তুতির কথা কখনো ভুলবো না। এমনকি রকীব সাহেবেরও ভোলার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি ২৬শে মার্চ বিকালেই প্রথম শুনতে পান যে, এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা হতে পারে আর তাই তিনি ঐদিনই তা প্রতিহত করার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
রকীব সাহেবর অবগতির জন্য লিখছি যে, ১৯শে মার্চ ১৯৭১ সালে শুক্রবার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায় নিয়ে ঢাকা থেকে জয়দেবপুরে এসেছিলেন। সেদিন যদি এই ব্যাটালিয়ন সমরপ্রস্তুতিতে কোনো ত্রুটি বা শৈথিল্য দেখাতো তা হলে ঐদিনই এই ব্যাটালিয়ন নিরস্ত্র হয়ে যেতো। সেদিন ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব রাজবাড়ীতে ঢুকেই ব্যাটালিয়নে সুদৃঢ় প্রস্তুতি দেখে আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকে। লেঃ কর্নেল মাসুদুল হাসান (তৎকালীন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার) বস্তুতঃ সেদিনই তার ব্যাটালিয়নের কমাণ্ড হারিয়েছিলেন।
২৭শে মার্চ উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, “টঙ্গীর গোলাগুলির আওয়াজ থেমে যাওয়ার পর আমি মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইন, ক্যাপ্টেন আজিজ ও সুবেদার নুরুল হককে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য আমার নিজের কামরায় ডেকে পাঠালাম। তারা এসে পৌঁছাতেই আমি বললাম যে, পরিস্থিতি এখন অসহ্য। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মতামত কি? কেউ উত্তর দিলেন না। আমি ধরে নিলাম মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।“
রকীব সাহেবের নিবন্ধের এইটুকুই সবচেয়ে বড় অসত্য উদ্ধৃতি। সঠিক কথা হলো আমি তাকে প্রথমবার সরাসরি বলি যে, আমাদের আর জয়দেবপুর থাকা উচিত নয়। তাকে আরও বলি যে, ব্যাটালিয়নকে ময়মনসিংহে একত্রিত করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছি। আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। আমার কথায় তাকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হতে দেখি। যদিও এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কথাই ছিলো কারণ আমরা যা করতে যাচ্ছি তা সহজ ভাষায় হচ্ছে বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের পরিণতি কি হতে পারে তাও কোনো সৈনিকের অজানা থাকার কথা নয়।
২৫শে মার্চ বিকালে যখন তিনি এই ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন তখন থেকেই আমি তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম এবং ব্যাটালিয়নের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থাৎ ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা যে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার জন্য সম্পূর্ণভাবে মানসিক ও সামরিকভাবে তৈরি আছে তা তাকে আভাসে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
২৭শে মার্চেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই যে, জয়দেবপুরে বসে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেদিনই রকীব সাহেবকেও আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলি। এ পরিকল্পনা আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিলো এবং তা বাস্তবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেই সেদিনই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তাকে খোলাখুলিভাবে কিছু বলতে পারিনি কারণ রকীব সাহেব এমন এক সময় এবং এমন এক পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাটালিয়নে এসেছিলেন যে তখন তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং তার পক্ষেও হয়তো এত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মনোভাব বোঝা সম্ভব ছিলো না। তাই ২৭শে মার্চ যখন আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই তখনই আমি তাকে খোলাখুলিভাবে বলতে সাহস পেয়েছি। তার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে এই ব্যাটালিয়নের পরিস্থিতি ও আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা না করার কতগুলো কারণও ছিল।
(ক) লেঃ কর্নেল মাসুদকে অপসারণ করে ২৫শে মার্চ বেলা ৪টায় লেঃ কর্নেল রকীবকে এই ব্যাটালিয়নের দ্বায়িত্বভার গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। লেঃ কর্নেল মাসুদকে আমরা যেভাবে বিশ্বাস করতে পারতাম সেভাবে লেঃ কর্নেল রকীবকে বিশ্বাস করতে পারি নাই। কারণ লেঃ কর্নেল মাসুদ এই ব্যাটালিয়নে প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তার মনোভাবও আমাদের সবার জানা ছিলো। কিন্তু লেঃ কর্নেল রকীব কমিশন পাওয়ার পর থেকেই পাঞ্জাব রেজিমেন্টে চাকুরিরত ছিলেন এবং ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকের নিকট তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই অল্প সময় ও পরিস্থিতিতে তার মনোভাব সম্পূর্ণ বুঝার অবকাশ বা সুযোগ আমার হয়নি এবং তিনিও তার মনোভাব আমার নিকট প্রকাশ করেননি।
(খ) ১ মার্চ কারফিউ জারি করে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ। ঢাকার নিরীহ জনগণের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তা ২৫শে মার্চ যখন তিনি আমাদের ব্যাটালিয়নে আসেন তখন আমি তাকে হত্যাযজ্ঞের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন এমন কিছুই হয়নি, ব্যাটালিয়নের লোকজন দুএকটি ফাঁকা আওয়াজ করেছে মাত্র। অথচ যেসব ব্যাটালিয়ন হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তার মধ্যে লেঃ কর্নেল রকীব সাহেবের ব্যাটালিয়ন ৩২ পাঞ্জাবও ছিলো। এই কারণে তার প্রতি আমার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম না। ঐদিন ঢাকা শহরে যে কি ঘটেছিলো তা নিশ্চয়ই আজও কেউ ভোলেনি।
রকীব সাহেব লিখেছেন ২৭শে মার্চে সন্ধ্যায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার বর্ণনা অনুসারে তার পরিকল্পনার কার্যকারিতা শুরু হয় পরদিন সকাল ১০টা থেকে অর্থাৎ ২৮শে মার্চ সকাল ১০টা থেকে।
তিনি নিজেই লিখেছেন এই ব্যাটালিয়নের একজন অবাঙালি অফিসার কাজেম কামাল ও আমি ছাড়া বাকী সবাই ছিলো তার কাছে অপরিচিত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন একটি সম্পূর্ণ অজানা ও অচেনা পরিবেশে তিনি কি করে এত বড় পরিকল্পনা একাই করে ফেললেন! আর ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ডেকে বললেন, “পরিস্থিতি এখন অসহ্য, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।” আর আমরাও তার কথা মেনে নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা দিলাম।
২৮শে মার্চের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তার উপর মন্তব্য করা আমার পক্ষে ঠিক হবে না কারণ ঐদিন সকাল দশটায় আমি জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। সেদিনের ঘটনাবলীর বিবরণ তারাই দিতে পারবে যারা ঐদিন তার সঙ্গে ছিলো। যেমন মেজর মইন, ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন এজাজ এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম প্রমুখ।
তিনি তার নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিলোঃ
(১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছালেন কিনা এবং তার আগে কি করছেন তার খবর তখন পর্যন্ত পাই নাই………। এ অংশের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখতে হয় যে, ঐ সময় দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর, গাজীপুর, রাজেন্দ্রপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিলো। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমরা চাচ্ছিলাম ছড়িয়ে থাকা অংশগুলোকে সরিয়ে নিয়ে এক জায়গায় সংঘবদ্ধ করতে। ময়মনসিংহকেই সবাই একত্রিত হওয়ার উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম এবং অন্যান্য অংশ কিভাবে পৌঁছাবে তার একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটালিয়নের কিছু অংশ নিয়ে আমি জয়দেবপুর থেকে সকাল দশটায় ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হয়ে যাই। আর বাকী অংশ ঐদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর থেকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। আমি বুঝতে পারছি না, চলে আসার পর রকীব সাহেব আমার জন্য কেনো এতো উদ্বিগ্ন ছিলেন। ময়মনসিংহে তো আমি শত্রুও মোকাবেলা করে যাইনি যে আমার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন থাকবেন। উদ্বিগ্ন তো আমি ছিলাম যে, ব্যাটালিয়নের অন্যান্যরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলো কিনা। তার উদ্বেগের প্রধান কারণ হওয়া উচিত ছিলো কিভাবে ব্যাটালিয়নের বাকী সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ময়মনসিংহে পৌঁছানো যায়।
২৯শে মার্চ ভোরে যখন ব্যাটালিয়নের সবাই আমার সঙ্গে মুক্তাগাছায় মিলিত হয় তখন আমি তাদের জিজ্ঞাসা করি, কমান্ডিং অফিসার সাহেব কোথায়? তখন অনেকেই আমাকে এই কথা বলেছে যে, তারা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় অফিসার্স মেসের ব্যালকনিতে সিও সাহেব ও ক্যাপ্টেন নকভীকে (একজন অবাঙালি অফিসার) দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কি পরিস্থিতিতে রকীব সাহেব ঐ জায়গায় রয়ে গেলেন সে ব্যাপারে তিনি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেটা কি সত্যের অপলাপ নয়? আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ২৮ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জয়দেবপুর, গাজীপুর ও রাজেন্দ্রপুর থেকে একই সময়ে সবাইকে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে ময়মনসিংহের দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। রকীব সাহেব এই সময়সূচী পরিবর্তন করে সাড়ে আটটা কেনো করেছিলেন তা তিনি লিখেননি।
তার নিজের কথা অনুযায়ী সাড়ে আটটায় রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। তখন পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং আটটা বিয়াল্লিশ মিনিটে তিনি তার কামরায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন যেনো কেউ এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। যেখানে তার ৮টা ৩০ মিনিটে জয়দেবপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সেখানে তিনি ৮টা ৪২ মিনিটে তার কামরায় ফিরে গেলেন কেন? এটাই কি তার ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যাওয়ার লক্ষণ ছিলো?
ক্যাপ্টেন নকভীর হাতে সারা রাত আটক থাকার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটাও কি গ্রহণযোগ্য? তার নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে সেই অনিশ্চিত দিনগুলিতে আমরা সর্বক্ষণই সশস্ত্র থেকেছি, কখনো নিরস্ত্র অবস্থায় থাকিনি। সেদিনের সেই অনিশ্চয়তা ও সঙ্কটময় সময়ে তার সঙ্গে অস্ত্র না থাকা কি অস্বাভাবিক ছিল না?
তার নিকট আমার আরো জিজ্ঞাস্য যে, গোলাগুলির মুখে যখন এই ব্যাটালিয়নের সবাই চলে আসতে পারলো তখন কেনো চলে আসতে পারলেন না ব্যাটালিয়ন কমান্ডার। পাকিস্তানীরা তো জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করেছিলো ২৯ মার্চ দুপুরের পর। আমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঐকান্তিকতা যদি সেদিন সত্যি তার থাকতো তাহলে ২৮ মার্চ সারারাত ও ২৯ মার্চের দুপুর পর্যন্ত সময়টুকু কি যথেষ্ট ছিলো না? ২৯ মার্চের ভোরে যখন রাজবাড়ীতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী স্ট্রাফিং ও বোমা বর্ষণ করেছিলো তখনও কি তিনি পারলেন না এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে?
২৯ মার্চ দুপুরের পর ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ঘেরাও করে ও রকীব সাহেবকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের ন্যায় তাকেও সেলে রাখা হয়। ঐ সময় সেলে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের ভাগ্যে যখন নানা প্রকার লাঞ্ছনার শেষ ছিলো না তখন তার প্রতি কর্তৃপক্ষের সদয় ব্যবহারের কারণ কি ছিলো? অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের যখন পশুর মতো ছোট একটি সেলে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিলো তখন তার থাকার জন্য কেন বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো? এসবের জবাব কি তিনি দিতে পারবেন?
রকীব সাহেব তো তার দীর্ঘ নিবন্ধে কোথাও একথা লিখেননি যে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানীরা কি ব্যবস্থা নিয়েছিলো। তিনি তো একথা লিখেন নি যে, তাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর আবার তাকে পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের কমাণ্ড দেয়া হয়েছিলো। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, লেঃ কর্নেল মাসুদ, লেঃ কর্নেল জলিল, লেঃ কর্নেল ইয়াসিন সহ আরও অনেককেই তো কমাণ্ড থেকে অপসারিত করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। তারা তো কেউই তাদের কমাণ্ড আর ফিরে পাননি। উপরন্তু তাদের উপর যে অমানুষিক ও পৈশাচিক অত্যাচার চালানো হয়েছিলো তার চিহ্ন তো আজও অনেকের শরীরে রয়ে গেছে।
লেঃ কর্নেল রকীবের উপর আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তার নিবন্ধের উপর কিছু আলোকপাত করতে গিয়ে আমাকে যেসব কথা লিখতে হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখিত। একবার ভেবেছিলাম এই নিবন্ধের উপর কোনো মন্তব্য করবো না, করা উচিত নয়। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে প্রতিবাদ না করলে অসত্য সত্য হয়ে থাকবে। তাই আমাকে লিখতে হলো।