You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.06 | এম মনসুর আলী কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন? - সংগ্রামের নোটবুক
এম মনসুর আলী কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন?
=======
৬ই এপ্রিল ঢাকা ছেড়ে যাওয়া স্থির হলাে। মঞ্জুর আমাকে তরা ঘাট অবধি এগিয়ে দিয়ে আসলাে। আরিচা ঘাটে পৌছে দেখি কোন ফেরি নেই। আমরা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জন লােক জমা হয়েছি। ঘণ্টা দুয়েক পরে দেখা গেল একটা লঞ্চ, রঙ্গিন কাগজের চেন, ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানাে – ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে। তবে, যথাসম্ভব একটা দূরত্ব রেখে, ঘাটে না থেমে ক্রমাগত উজানে চলে যেতে লাগল। আমরা সবাই দেখলাম সুবর্ণ সুযােগ হারিয়ে যাচ্ছে। একজনের হাতে একটা দোনলা বন্দুক ছিল, সে উপস্থিত বুদ্ধিতে বন্দুক তাক করল লঞ্চের দিকে, চিৎকার করে বলল, ঘাটে না ভিড়ালে এখনি গুলি করব। গুলিগােলার ফলাফলে বাঙালী অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে এতদিনের কাণ্ডকারখানায়; কাজ হলাে, লঞ্চটি ঘাটে এসে ভিড়ল, আমরা উঠে পড়লাম। তারপর শুরু হলাে দীর্ঘ পথ, চেনা হলেও এখন অজানা, অচেনা। নগর বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত রাস্তায় সদ্য কাটা গাছের একাধিক বিরাট বিরাট গুড়ি আড়াআড়ি করে পাতা; সাঁকোগুলাে ভেঙে দেয়া হয়েছে, ব্লকেড সৃষ্টি করার জন্য। এ দুটো কৌশলই তখন মুক্তিযােদ্ধাদের আয়ত্তে। তখন আমাদের সদ্য আহত এবং বিক্ষুব্ধ মন একথা বুঝতে চায়নি যে, একটা প্রথম শ্রেণীর মেকানাইজড সৈন্যবাহিনীকে গাছের গুঁড়ি বা ভাঙা সেতু দিয়ে ঠেকানাে যায় না। তবু জনগণ লড়ে চলছে এক অসাধ্য সাধনে।
রিকশা থেকে বারবার নামতে হচ্ছে। সারি সারি রিকশা চলেছে উত্তর মুখে। যেখানে গাছ পড়ে আছে, সেখানে রিকশাওয়ালাকে যাত্রীরা সাহায্য করছে রিকশা পার করতে। ভাঙা সেতুর কাছে রাস্তার নীচে নেমে পার হতে হচ্ছে। সারাদিনই প্রায় কেটে গেল এমনি করে। কাশীনাথপুরে এসে একটা বাস পাওয়া গেল। উল্লাপাড়া অবধি। উল্লাপাড়া থেকে আবার রিকশা সম্বল অথবা হেঁটে। ভাগ্য ভালাে হলে, মাঝে মধ্যে ১০/১৫ মাইলের বাস-ট্রিপ। শেরপুর (বগুড়া জেলা) পৌছুতে বিকেল হয়ে গেল। বাস রিকশা কিছুই নেই। নিকটে মিলিটারী ক্যাম্প। সবাই পলাতক। ঘােড়াগাড়ি পাওয়া গেল একটা। বগুড়া শহরে যখন পৌছেছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে বাতি দূরের কথা, রাস্তাতেও বাতির সংখ্যা কম। প্রথমেই পটলের বাড়ি গেলাম, ফেব্রুয়ারী মাসে তার বাড়িতেই সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল ছিল। পােস্টার, লিফলেট, ফেস্টুন ইত্যাদিতে এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের সরগরমে জায়গাটা জমজমাট ছিল। পটল বাড়িতে নেই। আরাে দু’জন এমএনএ’র বাড়িতে গেলাম। তারাও নেই। অগত্যা বগুড়া শহর পেরিয়ে জয়পুরহাটের দিকে অগ্রসর হলাম। পথে মহাস্থানগড়ে হান্নানের সঙ্গে দেখা। হান্নান তখন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মকর্তা, সম্ভবতঃ সম্পাদক কিংবা সহ-সম্পাদক। হান্নান আমাকে তার চাচার বাড়িতে তুললেন। আমার সংবাদ পেয়ে ঐ রাতেই বহু স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি দেখা করতে এলেন, ঢাকার অবস্থা জানতে। আমি যতটা পারি বললাম।
এই সময়ে দেখা করতে এলেন, আমাদের অর্বিটাল কমার্স এন্ড এজেন্সিজ কোম্পানীর একজন সাইকেল ডিলার। তিনি বললেন মাত্র সাতদিন আগে এক পেটি প্রিন্স সাইকেল ঢাকা থেকে এনেছেন আমারই ডিস্ট্রিবিউশন আপিস থেকে। সাইকেলের পেটি এইখানে তাঁর বাড়িতেই আছে। তাঁকে বললাম, রাতের মধ্যে একটি সাইকেল ফিট করে সাজিয়ে দিন, আমি ভাের রাতেই চলে যাব। কথামত সেই সজ্জন সাইকেল ডিলার ভাের পাঁচটাতেই আমাকে একটি পুরাে সাইকেল, বেল-কেরিয়ার-স্ট্যান্ড সমেত হাতে তুলে দিলেন। বললেন, আপনি দেরী করবেননা, চলে যান। সাইকেলের অত টাকা, প্রায় ৮০০/৯০০-এর মতাে হাতে ছিল না, কাজেই টাকাটা পরে দেব এরকম একটা কথা বলাতে, সাইকেল ডিলার বললেন, সে দেখা যাবে, আপনি এখন যান। মহাস্থানগড়ের নীচে একটা ঘােড়াগাড়ি দেখলাম। এক সিঁদুর পরা মহিলা ছেলেপুলে নিয়ে কোথাও যাবার জন্য দরদস্তুর করছেন। বটতলার নীচে ছােট খাটো একটা চায়ের দোকান। চার পাঁচজন মুক্তিযােদ্ধা চা খাচ্ছেন। এমন সময় একজন সাইকেলে ছুটে এসে খবর দিল। ব্রিজের ওপারে পাঞ্জাবী সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। শােনামাত্র একজন তরুণ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, হাতের চা পড়ে রইল। কোমরে বেল্ট কশতে কশতে বললেন, আমাকে যেতে হবে এগিয়ে, আমিই কমান্ডার। তার সম্বল মাত্র ৩০৩ রাইফেল। সাথীরাও দেখাদেখি উঠে পড়ল, যুবক ৩০৩ নিয়েই সুসজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনী, যাদের হাতে মর্টার, এলএমজি ইত্যাদি (এ নামগুলাের সঙ্গে পরে জানাজানি হয়েছে) ঠেকাতে চললেন, অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে, into the jaws of death, rode the six hundred, এখানে সিক্স হান্ড্রেড নয় মাত্র পাঁচ’ছ জন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে মর্মে মর্মে অনুভব করলাম।
মহেশপুর গ্রামে পৌছুতেই বুলু [১] এগিয়ে এলাে তার মােটর সাইকেল নিয়ে; চাচা চলুন পৌছিয়ে দিই। কমরগ্রাম পৌছে আব্দুল লতিফ, নজির হােসেন, ডা. ওবায়েদ, ‘হৌকোটিটি’-খ্যাত ওবায়েদ, হেড মাস্টার আব্দুস সালাম ও সহকর্মীদের সাথে দেখা হলাে। বানিয়াপাড়া গ্রামে চাচা সালেহ মুহম্মদ মুন্সী ও ইকড়গাড়ার আঃ বারিক মােল্লা (আ. লীগ সেক্রেটারী)-র সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে। আমাকে নিরাপদে গ্রামে পৌছুতে দেখে সবাই উৎফুল্ল। গলা মেলামেলি হলাে। বুলুর মােটর সাইকেল আবার ছুটে চলল। জয়পুরহাট ধরি ধরি হয়েছে, এমন সময় দেখি, পেছনে প্রচুর ধুলােবালি উড়িয়ে দুটো জীপ এগিয়ে আসছে। এ তল্লাটে তখনাে পাঞ্জাবী পাকিস্তানীরা এসে পড়েনি; জীপ দুটো কাদের হতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না। সামনের জীপটি এসে বুলুর মােটর সাইকেলের কাছে সশব্দে ব্রেক কষে থেমে গেল। বুলুর মােটর সাইকেল থামে, বলা বাহুল্য, আমি পেছনে বসে।
জীপ থেকে নামল সামাদ। আমাদের সংগ্রামী সামাদ, আমাদের বীর ছেলে, বগুড়ার গৌরব সামাদ। বললাম, কেবল ফালতু পেট্রোল খরচ করে ঘুরছ আর ওদিকে বগুড়া শহর খালি।
না, চাচা, সামাদ বলল, আমরা এলাম বালুরঘাট থেকে, অস্ত্র আর ডিনামাইট আনতে গেছিলাম। বেশ করেছ, এখন একটা কাজের কাজ কর। আমি ডিনামাইট ও অস্ত্র সংক্রান্ত খবরটাকে গুরুত্ব দিলাম না বলেই সে সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন-পাতি করলাম।সামাদ বলল, কী কাজ চাচা, বলেন, জান দেব বঙ্গবন্ধুর ডাকে।
—–
[১] হাবিবুর রহমান বুলু, বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের বগুড়া শাখা ম্যানেজার।
——
বললাম, জান দিতে হবে না, এখন শাজাদপুরে যেয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলিকে নিয়ে এসাে। আমি তাঁকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। আমি তাঁকে বিস্তারিত জানালাম, কীভাবে আসবার পথে শাজাদপুরে আমি রাত্রি কাটালাম এক মাড়ােয়ারি ব্যবসায়ীর গদি ঘরে। আগের সন্ধ্যায় সেখানকার এমপিএ (নামটি সম্ভবতঃ গােলাম সাকলাইন)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া সত্ত্বেও মনসুর ভাই পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি। এমপিএ সাহেব ঠিকানা দিতে পারেননি অথবা দেননি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিল না, অথচ আমি নিশ্চিত জানতাম মনসুর ভাই এখানেই আত্মগােপন করে আছেন।
এখানে বলা দরকার উত্তরবঙ্গের দুই নেতা এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলি সাহেবের সন্ধান করে তাঁদের সঙ্গে আলােচনা করার। গুরুত্ব আমি তীব্রভাবে বােধ করেছিলাম আমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় হেনা ভাই (কামরুজ্জামান)-এর ব্যাপারে আমি ভুল খবর পেয়েছিলাম যে তিনি একদিন আগেই রেডক্রসের হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কলকাতা চলে গেছেন। আমি তাই হেনা ভাই-এর খোজ না করে মনসুর ভাইকে খুঁজতে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। পঁচিশের রাত্রে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। আমি একটা ধারণা করেছিলাম যে, তিনি শাজাদপুরের ধারে কাছে কোথাও আছেন। এই ধারণার কোন ভিত্তি নেই, অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মনে এ ধারণাটি উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল। হেনা ভাই-এর খবর পেলাম পরের দিন হিলি বর্ডারে, বাংলাদেশ সমর্থক শ্রী মাধব রায় ও শ্রী অনিল মজুমদারের কাছে।
সামাদ যখন আমার চিঠি নিয়ে মনসুর ভাই-এর তল্লাসে বগুড়া হয়ে শাজাদপুরের দিকে রওয়ানা হলাে, তখন তার কর্মদক্ষতা সম্পর্কে আমার তত উঁচু ধারণা ছিল না। কিন্তু, আমার জন্য কিছু চমক জমা ছিল যা দু’দিন পরে আমাকে বিস্ময়াবিষ্ট করে তােলে।
আমি জয়পুরহাটে দু’দিন ধরে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করেছিলাম, আমাদের কর্মপন্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। তখন পর্যন্ত গ্রামের লােক ভাবেনি যে পাকিস্তানের হিংস্র সৈন্যরা গ্রামে-গঞ্জে-পল্লীতে পল্লীতে আগুন জ্বালাবে। পরের দিন মঙ্গলবারে পাঁচবিবিতে হাট ছিল, হাটে পুরাদস্তুর লােকজন এসেছে, দোকানপাট বসেছে। আমাকে দেখে লােকজনেরা বেশ উৎসাহিত হলাে। নানা গুজব কানে আসছে, অনিশ্চয়তার মাঝখানে সাহস বা সান্তনা যদিবা পাওয়া যায়, কিন্তু, আমার ঝুলি ছিল শূন্য, আমাদের কোন পরিকল্পনা ছিল না,
Page 25
কোন প্রােগ্রাম ছিল না। যদিওবা থেকেও থাকে, হয়তাে উপরের তলায় দু’চারজন জানতেন, তা আমাদের এমএনএ লেভেল অবধি প্রসারিত হয় নি। গুলিগােলা হয়েছে, আক্রমণ হয়েছে, জানের ভয়ে পালাচ্ছি – এটিই ছিল আমাদের সাধারণ মনােভাব। বর্ডার পার হয়ে যখন নিশ্চিন্ত একটা জমিতে দাঁড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পেরেছি, তখন এলাে একটা প্রতিশােধের ইচ্ছা, ‘পাকিস্তানী দস্যুরা, তােমাদের আমরা তাড়াব, আমরা দেশ স্বাধীন করব।’
কিন্তু পাঁচবিবির হাটে দাঁড়িয়ে আমার ঝুলি ছিল শূন্য, না কোন প্রােগ্রাম দিতে পারলাম, না কোন কর্তব্য বাতলাতে পারলাম। মূর্খের মতাে বললাম, পাকিস্তানীরা শহর ছেড়ে আপনাদের গ্রামে আসবে না, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন (কি মূঢ়তা!), তবে যদি দেখেন, বগুড়া শহর ছেড়ে দস্যু সৈন্যরা বেরিয়ে পড়েছে। তবে বিপদ আসছে জানবেন।
একটা আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা কি অজ্ঞই না ছিলাম! ২৫শে মার্চ রাত্রিতে গােলাগুলির দু’ঘণ্টা আগেও আমরা ক্যাপ্টেন মনসুর আলির সঙ্গে কথা বলেছি – তিনিও কোন ইঙ্গিত দেননি। হয়তাে নিজেও কিছু জানতেন না। কামরুজ্জামান তখন থাকতেন ধানমণ্ডী লেকের ধারে একটা বাড়িতে। ২৪ তারিখ বিকেলে তাঁর বাসার সামনে থেকে লেকের ধার অবধি একসঙ্গে হেঁটেছি কথা বলতে বলতে। বললেন সময় খুবই খারাপ, যেকোন সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। ব্যস এই পর্যন্তই। আর কোন আভাস তিনি দেননি, মনে হয় তিনি আরাে জানতেন, হয়তাে বা আরাে কেউ জানতেন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যগণকে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল করা কারু না কারু উচিত ছিল, সার্বিক শৃংখলাবদ্ধতার জন্য এবং সমগ্র পরিস্থিতিকে একটা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে না দিয়ে। সংগ্রাম শুরু হলে এবং গুরুতর পরিস্থিতি ধারণ করলে, গ্রাম। এলাকা থেকে শহর অবধি কার কি কর্তব্য তারও একটা বিস্তারিত পরিকল্পনার প্রয়ােজন ছিল।
আজকে যে পশ্চাদ্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও অতীতের আলােকে যে লেখা লিখতে পারছি, একাত্তরের মার্চে সেই জ্ঞান ও দিব্যদৃষ্টি কোথায় যে, আমি পাঁচবিবির লােকদের সতর্ক হতে বলব, সংগ্রামের পরিকল্পনা ও নির্দেশ দেব? আমি একজন জনপ্রতিনিধি, সাধারণ এমএনএ, আমার উপরে নীচে সবারই ঐ একই দশা ছিল একথা বলা যায়।
পরের দিন বিকেলবেলা আমাদের উল্লাস আর ধরে না। আমাদের সবাইকে। তাক লাগিয়ে দিয়ে বীর ছেলে সামাদ, মনসুর ভাই-সহ জয়পুরহাটে উপস্থিত। আমি সামাদকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। মনসুর ভাই-এর সঙ্গে দু’চার কথা হওয়ার পরপরই আমি সর্ব প্রথমে কাফেজ ভাই (2) ও মাহতাব (3) কে খবরটি পাঠালাম এবং তাঁদের পরামর্শক্রমে ক্ষেতলালের এমপিএ (আ. লীগ) আবুল হাসনাত চৌধুরীর (4) বাড়িতে মনসুর ভাইকে সাময়িকভাবে রেখে, অন্যান্য আওয়ামী লীগ কর্মীদের তল্লাশে ছুটলাম, এহেন অভাবনীয় সংবাদটি জানাতে এবং জরুরী। আলােচনা সভা ডাকতে। কর্মীদের এই সভায় স্থির হলাে, আশু কর্তব্য হিসাবে সে রাতেই ফজর ওয়াক্তে মনসুর ভাইকে বর্ডার পার করানাে হবে। বর্ডারে যােগাযােগ করার জন্য লােক পাঠানাে হলাে। আমাদের শ্রেষ্ঠ কর্মী মাহতাব। উদ্দিন এ কাজের ভার নিয়েছিলেন। | আলােচনা সভা থেকে ফিরে এসে দেখি মতি চৌধুরীর বাড়ি ঘিরে বিরাট মেলা বসেছে। লােকে লােকারণ্য, হৈচৈ, কৌতুহলী জনতার কলােরব। ঘটনাটি এই দাঁড়িয়েছে, মনসুর ভাই দরবারি মানুষ, লােকজন ভালােবাসেন। বেশীক্ষণ একেলা বসে থাকতে ভালাে লাগেনি, তাই এখানকার এসডিওকে ডেকে পাঠিয়েছেন, নামধাম জিজ্ঞাসা করে এসডিও সাহেবকে তার পরিচিত মনে হয়েছে, স্থানীয় অফিসারটিও তার চেনা মনে হয়েছে, তিনিও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। হাটে হাঁড়িটি ভেঙেছে – ক্যাপ্টেন মনসুর আলি এখন জয়পুরহাটে, এ সংবাদ। বিদ্যুতের মতাে ছড়িয়ে পড়েছে – তাঁকে একবার দেখবার জন্য হাটের লােকজন ভীড় জমিয়েছে। এই যে একবার দেখার ঝোঁক, এটি বহুবার আমরা দেখেছি, সেই আয়ুব খান, ফাতেমা জিন্নাহ, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব – একজন। এলেই হলাে। কৌতূহলী নিরীহ অসহায় জনতা ভীড় জমায়। পুরানাে যুগের। শেরে বাংলা বা সােহরাওয়ার্দীর কথা নাই বা তুললাম। মওলানা ভাসানীর বেলাতেও তাই, আর মওলানা সাহেব লােক ছাড়া থাকতেও পারতেন না। আমাদের মনসুর ভাই-এরও সেই দশা। সামাদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলিকে নিয়ে বগুড়া হয়ে জয়পুরহাটের দিকে গেছে এইটিই ছিল সর্বত্র প্রচার। সামাদের লােক পরিচিতি ছিল দারুণ, আর কাউকে না চিনলেও সবাই সামাদকে চিনেছে, খবরটি এ কারণেই ছড়িয়ে পড়েছে।
——
২ কাফেজ উদ্দিন আহমেদ – প্রবীণতম আওয়ামী লীগ কর্মী, আ. লীগ সভাপতি, দলীয় কোন্দলে বর্তমানে বাকশাল সভাপতি।
৩ মাহতাব উদ্দিন আহম্মদ – ভাদশা গ্রাম (জয়পুরহাট)-এর এই যুবক মােঃ মহির উদ্দিন মন্ডল-এর পুত্র। বরেন্দ্র অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী; জয়পুরহাট অঞ্চলে আওয়ামী লীগের স্থাপয়িতা; আ. লীগ সেক্রেটারী। রহস্যজনকভাবে দুবৃত্তের গুলিতে নিহত হন। গুণমুগ্ধ জনগণ তাঁর বাড়ির সামনের জেলা বাের্ড রাস্তার অংশটি ‘মাহতাব উদ্দিন সড়ক’ নামকরণ করার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব জয়পুরহাট পৌরসভার।
৪ আবুল হাসনাত চৌধুরী ওরফে মতি চৌধুরী, প্রথমে আওয়ামী লীগ এমপিএ, পরে বিএনপি, বর্তমানে জাতীয় পার্টির সদস্য।
——-
এই জনারণ্য থেকে মনসুর ভাইকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়, আর যেখানেই নিয়ে যাব, জনতা সঙ্গে যাবে। এই ভেবে, ইয়া নফুসি পড়তে লাগলাম, অর্থাৎ ক্যাপ্টেন মনসুর আলি জয়পুরহাটে এই সংবাদটি কোন সহৃদয় ব্যক্তি বগুড়া সদরে পৌঁছালেই, আর কথা নেই পাকিস্তানী দস্যুরা ছুটে আসবে সঙ্গীন উঁচু করে। কিন্তু আমাদের আর গত্যন্তর ছিল না, ইয়া নসি পড়া ছাড়া। তবু চিন্তা করতে লাগলাম কী করা যায়। রাত একটু ভারী হয়ে এলে, লােকজনের ভীড় কমলাে। মনসুর ভাইকে একটা জীপে করে জয়পুরহাটের বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হলাে, ভাবটা এই, তিনি যেন চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁকে পুনরায় গাড়িতে করে এনে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী (মুগা)-র নব নির্মিত সুসজ্জিত বাড়িতে রাখা হলাে। মনসুর ভাই-এর কোন চিত্ত বিকার নেই; নির্বিবাদে মুরগীর সুরুয়া সহযােগে চিনি-আলাে চালের সুগন্ধি ভাত তৃপ্তি সহকারে ভােজন করে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু অসংখ্য চিন্তায় আমাদের মাথায় তখন ঘূর্ণিবায়ু প্রবল বেগে প্রবাহিত। আমরা এমন সঙ্কটের সম্মুখীন আর কখনাে হইনি, নেহায়েত অনভিজ্ঞ; সম্ভবতঃ তাই এই ত্রাস এবং পক্ষান্তরে, অভিজ্ঞ মনসুর ভাই-এর (বাহ্যিক হলেও) উদ্বেগহীনতা।
মাহতাব ও কাফেজের পরামর্শক্রমে ভাের ৪টায় মনসুর ভাইকে জীপে নিয়ে আমরা হিলির দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু, কি আশ্চর্য! আর একটা জীপ দ্রুত বেগে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে! সর্বনাশ! পাকিস্তানীরা খবর পেয়ে গেছে, আর রক্ষা নেই। ঘােরাও, ঘােরাও, জীপ ঘােরাও। জীপ ঘুরিয়ে হিলির দিকে না গিয়ে আমরা পূর্ব দিকের বগুড়ার রাস্তা ধরলাম বানিয়াপাড়া ক্ষেতলালের দিকে। ধাবমান জীপটিও ঘুরল এবং আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে এলাে ৩/৪ মাইল। একজন। বলল, পাকিস্তানীরা গুলি করছে না কেন? কে একজন বলে উঠল, জীপটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে; মিলিটারী পােশাক তাে দেখা যায় না – সাদা জামা কাপড়। গুলি যখন করছে না দাঁড়ানােই যাক। দেখা যাক কি ব্যাপার। ব্যাপার আর কি। জীপ থেকে নামলেন বগুড়ার ডাক্তার জাহেদুর রহমান (এমএনএ) এবং তাঁর সঙ্গীরা। বগুড়া পর্যন্ত খবর পৌঁছেছিল ঠিকই, তবে দুশমনদের কাছে নয়, তাই রক্ষা।
আমরা আশ্বস্ত হয়ে আবার জীপ ঘুরালাম হিলির দিকে। আমাদের স্ট্র্যাটেজী ছিল অত্যন্ত সংগােপনে মনসুর ভাইকে বর্ডার পার করানাে। কিন্তু বাঙালী সমাজে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে ততদিনে। রাখ-ঢাক নেই কিছু আর। মনসুর ভাই-এর। বর্ডার অতিক্রম একটা প্রকাশ্য মেলা বা বিরাট মিছিলের আকার ধারণ করল। আমাদের ধাবমান জীপের পেছনে মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় দু’শাে মানুষ আমাদের এগিয়ে দিতে চলেছে হিলির দিকে। কেউ কেউ হুন্ডায়, অনেকেই বাইসাইকেলে, আর শতাধিক ব্যক্তি দৌড়িয়ে আসছে। দু’একটি আওয়ামী ব্যানার যােগাড় হয়েছে, কারাে হাতে লাঠি। অধিকাংশই আওয়ামী কর্মী, বাকী স্থানীয় কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণ। এতদিন পরে যে বিরাট মিছিল নিয়ে হিলি বর্ডার পার হয়েছি, তাতে কে কে ছিলেন নাম করা দুঃসাধ্য। বয়সের কারণে স্বভাবতঃই স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। হয়তাে অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মুক্তিযােদ্ধার নাম আমি লিখতে ভুলে যাব, বন্ধুরা যেন আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ক্ষমা করেন।
এখন আমার মনে হচ্ছে, এই যুদ্ধ-মিছিল (?) আর তিন-চারদিন পরে হলেই সর্বনাশ হতাে, হয়তাে আমাদের যাওয়াই হতাে না, মিছিলও হতাে না, কারণ পাকিস্তানী দস্যুরা তিন-চার দিনের মধ্যেই জয়পুরহাট অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার নাজির হুসেনের মাধ্যমে হিলিতে আগে থেকেই যােগাযােগ করা ছিল, শ্রী মাধব রায় ও শ্রী অনিল মজুমদার আমাদের। সসম্মানে গ্রহণ করে সীমান্তের ওপারে মাড়ােয়ারি ভদ্রলােকের গদিতে বসালেন। সেখানে আমাদের প্রিয় সহকর্মী খন্দকার নাজির হুসেন (গ্রাম আটাপাড়া; সহ। সভাপতি আ. লীগ) ভাের সকাল থেকেই বসেছিলেন।
তিনি আমাদের সকালের নিরামিষ নাস্তাপাতি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সীমান্তের এপারেও আমার ভ্রাতুস্পুত্রী ও জামাতা মঈনুদ্দীন (হেডমাস্টার, হিলি হাইস্কুল)-এর গৃহে অল্প কয়েক মিনিটের অবস্থানে একবার চা-পর্ব ঘটেছে। তবে, সঙ্গে লােকজন প্রায় দু’শাের মতাে হয়েছে, যে যেখানে সুবিধা চা-টা খেয়ে নিচ্ছে। এই সীমান্তে কোন ভয়ডর নেই, যেন শােভাযাত্রা করে বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি – এমনি একটা সন্ত্রাসমুক্ত সহাস্য পরিবেশ। হিলির ঐ গদিতেই আমরা যার যা টাকা ছিল ভারতীয় মুদ্রায় বদল করলাম। আমার কাছে ছিল ৩৬ টাকা; ভাঙালাম। এমপিএ মতি চৌধুরী সংসার অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সঙ্গে পুঁজি না নিয়ে চলেন না; তিনিও টাকা ভাঙালেন; আমার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
হিলিতে আমরা ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম। এখানে আলাপ আলােচনায় নিশ্চিতভাবে জানা গেল, কামরুজ্জামান দু’দিন আগে এ পথেই কলকাতা চলে গেছেন। হিলি থেকে বালুরঘাট। খঞ্জনপুরের শ্রদ্ধেয় ডাক্তার দীনেশচন্দ্র রায়ের পুত্রগণের সঙ্গে দেখা হলাে – শৈলেশ আমার সঙ্গে পড়ত, দেশ ছাড়ার দীর্ঘদিন পরে দেখা-সাক্ষাতে খুবই আনন্দ পেলাম। তার দাদা, আমরা ‘রাঙাদা’ বলে। ডাকি, এখন বাড়ির কর্তা। তিনি ও বাড়ির বধূরা আমাকে মাছ ভাত দধি মিষ্টান্ন খাওয়ালেন। বিদেশে যেন অমৃতের আস্বাদ পেলাম। বালুরঘাট থেকে গােদাগাড়ীঘাট, সেখান থেকে ট্রেনে হাওড়া স্টেশন।।
সীমান্তের এপারে কি ওপারে আমার কনস্টুটুয়েন্সির জনসাধারণ, আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের কথা মনে ভীড় করে জমেছিল, কিন্তু উপায় কি, কি কর্তব্য, কোথায় পাব সেই মহৎ উপদেশ? দীর্ঘকাল পরে যদি এই পলায়ন বৃত্তিকে নিছক আত্মরক্ষার স্বার্থপরতা আখ্যা দিতে হয়, দিন; প্রতিবাদের যুক্তি পাওয়া যাবে না; তবে বিশ্বাসঘাতকতা নিশ্চয়তঃ নয়, কারণ, এ বিশ্বাসটি সবার। মনে প্রােথিত ছিল যে, একবার ঘাঁটি পাতবার জায়গা পেলেই হয়; পাকিস্তানী দস্যুদের তাড়ালেই আমাদের জনসাধারণ আত্মীয় বান্ধব সবাই রক্ষা পাবেন। সম্ভবতঃ এই উক্তিটি এক্ষেত্রে প্রযােজ্য, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে। মুখােমুখি প্রতিরােধের প্রস্তুতি ছিল না; এই সত্যটিই তখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
হাওড়া স্টেশনে নেমেই প্রথমে মনসুর আলি সাহেবকে দলবলসহ (কাফেজ, মাহতাব, মতি চৌধুরী, মাহতাবের সঙ্গীগণ – সবার নাম দেয়া যাচ্ছে না) স্টেশন সংলগ্ন হাওড়া মাড়ােয়ারি হিন্দু হােটেলে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে তুললাম। দামে সস্তা বলে, এই হােটেলটি আমার পূর্ব থেকে জানা ছিল। দলবল অর্থে আমার প্রিয় ভাতিজা মাহতাব (আহা, আজ মাহতাব নেই!) ও তাঁর সঙ্গীরা। এর মধ্যে ছিল, আমার খঞ্জনপুর স্কুলের গুরু সুফী ছায়েমুদ্দিন (পীর সাহেব আখ্যা পেয়েছিলেন পরিণত জীবনে) এর দৌহিত্র তরুণ এডভােকেট ইউসুফ (খলিকুর। রহমান) যিনি সে সময় আমাদের পূর্ণ সমর্থক ছিলেন – পরবর্তীকালে অবশ্য রাজাকার-পাণ্ডাদের সহায়ক হয়ে যান। তরুণ মনের তীব্র স্বদেশ প্রেম বিভিন্ন। কারণে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করলে চমৎকৃত হতে হয়। সম্ভবতঃ উঠতি বয়সে জীবনদর্শন ও আদর্শগত অধিষ্ঠানের লক্ষ্যটি নিরত পরিবর্তনশীল। ইউসুফের পিতা এবং পিতৃব্য মৌলভী তােফাজ্জল ও নুরুল হক (প্রাক্তন স্কাউট শিক্ষক, বর্তমানে হাজী) আমার বাল্য বন্ধু। ইউসুফ মাহতাবের বিশেষ সহচর, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউসুফকে আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের শিবিরে পাইনি – রাজনীতি ক্ষেত্রে এবম্বিধ আচরণ অসাধারণ নয়; নিত্যই ঘটে।
মাহতাবের হাতে মনসুর ভাই-এর দায়িত্ব দিয়ে আমি ট্রামে সােজা চৌরঙ্গী। স্ট্রীটে স্কাই-স্ক্রেপার (আকাশচুম্বী) অট্টালিকা ‘জীবনদীপে’ পৌছুলাম।
====
রেফারেন্স – বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় – মফিজ চৌধুরী