You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.23 | কার বিচার? | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

কার বিচার?

কে কার বিচার করে। একটা জাতিকে হত্যা করার জন্য যারা দানবের মতাে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তারাই বিচারকের আসনে বসার স্পর্ধা দেখিয়েছে। আসামি কারা? স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার তিন জন সদস্য। তাদের নামে সমন বার করেছেন ইয়াহিয়া খানের সামরিক কর্তৃপক্ষ। সােমবার সামরিক আদালতে তাদের বিচার করে দণ্ড দেওয়া হবে তাদের। পাকিস্তান, পেনাল কোড ও মার্শাল ল’ রেগুলেশনে দণ্ড। তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ জানা যায়নি। হয়তাে দেশদ্রোহিতা বা ঐ ধরনের অন্য কোনাে গুরুতর অভিযােগ।
বিচারের নামে একটা প্রহসন হয়তাে হবে- কারণ জঙ্গি শাসকদের চিহ্নিত অপরাধীরা আজ তাঁদের নাগালের বাইরে। তারা যেখানে আছেন সামনের দৌড় সে পর্যন্ত নেই। বাংলাদেশে পাকিস্তানের অস্তিত্ব আজ লুপ্ত। স্বাধীন বাংলার কাছে পাকিস্তান এখন একটি পররাষ্ট্র। তার সৈন্যরা দখলদার বাহিনী, আর জঙ্গি শাসকরা বিদেশী। সেই দখলদার বাহিনী ও বিদেশী দস্যুদের সােনার বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বদ্ধপরিকর, মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব পণ। স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাদের নয়নের মণি। অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তাঁরা তাঁদের অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছেন। সেই বাহু ভেদ করার সাধ্য ইয়াহিয়া খান বা তার সাঙ্গদের নেই। থাকলে তারা কসুর করতেন না।
তবে কেন এই সমন, কেন এই বিচার প্রহসনের মহড়া? মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ যতই দুর্ভেদ্য হয়ে উঠছে ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গদের ততই চালাকি মাথায় খেলছে। তারা বলতে চাইছেন, সব ঠিক হৈ’ অর্থাৎ বাংলাদেশ একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এবার মূল আসামিদের দণ্ড দেয়া দরকার। জঙ্গি শাসকরা ভালােই জানেন যে, বিচার করে যাদের দণ্ড দেবেন বলে তারা প্রচার করছেন তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা সম্ভব হবে না। তবু বিচার প্রহসন করে তাঁরা দেখাতে চাইবেন যে, তাঁরাই এখনাে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। অবস্থা যে মােটেই ঠাণ্ডা নয় প্রতিদিনের খবর থেকেই তা বেরিয়ে আসছে। বার বার হুমকি দিয়েও অসামরিক প্রশাসনের কর্মীদের ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দর বা জয়দেবপুরে অস্ত্রের কারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ প্রচণ্ড আঘাত খেয়েও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে মুক্ত অঞ্চলে প্রশাসন যন্ত্র মােটামুটি চালু আছে এবং জনসাধারণের সহযেগিতায় তা ক্রমশ মজবুত করে তােলা হচ্ছে। চরম নৃশংসতা চালিয়ে হানাদার বাহিনী তা স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। অতএব নকল বিচার করে স্বাধীন
বাংলার মন্ত্রিমণ্ডলীর গর্দান নেবার হুকুম হলেও দণ্ডিত ব্যক্তিরা উন্নত শিরেই জঙ্গি দস্যুদের কবরে যাবার পথ প্রশস্ত করতে থাকবেন।
ইয়াহিয়া খানের মাথায় অনেক দুর্বুদ্ধি আছে। এই বিচার-প্রহসন খাড়া করে ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের তালে আছেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটা ষড়যন্ত্র বলে প্রমাণ করতে চান ইয়াহিয়া খান। গত ডিসেম্বরে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাবার পর থেকেই এ বিষয়ে তালিম দিয়ে আসছেন এই দুরাত্মা। ভারতের উস্কানিতেই মুজিবর নাচছেন এমন কথা তার মুখ দিয়ে অনেকবারই বেরিয়ে এসেছে। তার পাছদোহার ভুট্টো সাহেবও কর্তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পোঁ ধরতে কসুর করেননি। বিচারপ্রহসন খাড়া করে জঙ্গি দুশমনরা হয়তাে বিশ্ব জনমতের কাছে এটাই তুল ধরতে চাইবে যে, বাংলাদেশে যা ঘটেছে ও ঘটছে তার মূলে রয়েছে ভারতের প্ররােচনা। কিন্তু বজ্জাতি করে সুবিধে হবে না। এভাবে শয়তানি করে মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দাঁড় করিয়ে প্রবল গণ-বিক্ষোভের চাপে আয়ুব খাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এবার আর গণবিক্ষোভ নয়, সশস্ত্র গণযুদ্ধ। অস্ত্রবলেই বাঙালি জাতি ইয়াহিয়া খানের সমস্ত সাধ মেটাবে ও তার জল্লাদদের গাের দেবে। তার খােয়াব টুটতে দেরি নেই।
গণহত্যার দায়ে প্রকৃত অপরাধী ইয়াহিয়া খান ও তার জঙ্গি দস্যুরা। ইতিহাসের কাঠগড়ায় তারা ঘৃণ্যতম আসামি। নারী হত্যা, শিশু হত্যা, গৃহদাহ, হনন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন এমন কোনাে অপরাধই নেই যা ইয়াহিয়ার পশুরা না করেছে। মানবতার উপর এরূপ নৃশংস আঘাত ইতিহাসে বিরল। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। বিচারের দিন আসছে। চরম দণ্ডের জন্য প্রস্তুত হােন ইয়াহিয়া খান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চোখে আজ জল নেই- আগুন। সেই আগুনে তাঁকে পুড়ে মরতে হবে। সমন জারির দিন ফুরিয়ে গেছে সামনে তার শমন। বেহেস্ত নয়- তার কপালে আছে দোজখ। নিজের মৃত্যু পরােয়ানা তিনি নিজেই রচনা করেছেন। শেষ বিচারের প্রতীক্ষায় থাকুন তিনি।

সূত্র: কালান্তর
২৩.৪.১৯৭১