You dont have javascript enabled! Please enable it!

যেভাবে খাজা ওয়াসীউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হয়নি

তখন ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে ৩২ নম্বর বাড়ির তিনতলায় । চিলেকোঠার মতাে একটিমাত্র কামরা আছে সেখানে। একটু পর ঘরে ঢুকলেন বঙ্গবন্ধু, তার সঙ্গে তােফায়েল আহমেদ । কলকাতা বেকার হােস্টেলে একসঙ্গে থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার কিছুটা ঠাট্টা-তামাশার মতােই সম্পর্ক ছিল। বললেন, ‘কী ব্যাপার, গ্রামে গিয়ে মাস খানেকেরও বেশি ডুব মেরে আছ। কী আছে তােমার গ্রামে, মা-বাবা আছেন?’ |
মা ঢাকায়, বাবা বেঁচে নেই শুনে কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হলেন বলে মনে হলাে। যাহােক কিছুক্ষণ কাটল কুশল বিনিময় ও চা পানে। তারপর তিনি কাজের কথায় এলেন। হঠাৎ আমার বাহুটি চেপে ধরে বললেন, “দেখাে খলিল, তােমার ওপর কি আমার কোনাে অধিকার নেই?’ হঠাৎ করে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে আমার ডান বাহু ধরে তিনি এই কথাগুলাে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কল্পনাও করিনি। কাজেই আমার চেহারায় তখন নিশ্চয়ই কিছুটা হতভম্বভাব ফুটে উঠেছিল। সেটা দেখেই হয়তাে বললেন, “আমি রউফের মুখে শুনেছি যে তুমি চাকরি করতে চাও না। কেন চাও না তাও হয়তাে কিছুটা অনুমান করতে পারি। কি তােমাকে অনুরোধ করার অধিকার কি আমার নেই?’
ততক্ষণে আমি অনেকটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছি। বললাম, ‘কী বলছেন, স্যার? আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তা ছাড়া আপনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীও, আর আমি এখনাে বাংলাদেশের একজন সৈনিক। সে হিসেবে আপনিই তাে আমাকে আদেশ দেবেন, আর আমি তা পালন করব। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি দেশের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু, আপনার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনার ইচ্ছাই তাে আমার জন্য আদেশ।’ | আরও বলতে যাচ্ছিলাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রাখো ওসব কথা। আমি কলকাতা বেকার হােস্টেলের খলিলকে কিছু বলতে পারি তো।
বলা বাহুল্য, মনটা আর্স হয়ে গেল। যে অধিকার বা দাবির কথা তিনি তুলছেন, তাকে কোনাে সীমার ভেতরে আটকানাে যায় না। ভয় হলো, এমন কিছু তিনি বলবেন না তাে যা পালন করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। বললাম, ‘আপনার ইচ্ছা নিশ্চয়ই আমার শিরোধার্য তবে আপনি আমার দুর্বলতাও জানেন। আমি সাধারণ মানুষ। এমন কিছু আদেশ করবেন না যা আমার জন্য বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। আমার অনুরােধ দুটি। প্রথমত, আমাকে এমন কোনাে কাজ বা চাকরি দেবেন না যার জন্য প্রশিক্ষণ আমার নেই। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাবস্থা ছাড়া আমাকে কোনাে জুনিয়রের নিচে চাকরি করতে বলবেন না।’ বঙ্গবন্ধু একমুহূর্তের জন্য চিন্তা করলেন। তার পর তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গি ও ভাষায় যা বললেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায় নিম্নরূপ ।
রাষ্ট্রের অন্যান্য বিষয় যেমন তেমন, অর্থাৎ যা-ই হােক, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ সম্বন্ধে তাঁর কিছু দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কমান্ডের ব্যাপারে। বর্তমান কমান্ডের ব্যাপারে তিনি খুব সন্ত্তষ্ট নন। পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তন করে যার যেখানে পদায়ন হওয়া দরকার, সেভাবেই সবাইকে বসাতে চান; কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধার উদ্ভব হয়েছে। সে জন্য আমার সাহায্য-সমর্থন তার দরকার। আর সেটাই তাঁর অনুরােধ ।
আমি জানতাম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান করতে পারবেন না। এখানে বলে রাখা দরকার, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পরই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন। এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে হয়তাে বা জেনারেল ওসমানীও খুব প্রভাব খাটিয়েছিলেন শেখ সাহেবের ওপর। আমারই মনে আছে, বিবিসি থেকেও এ সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করা হয়েছিল। ওসমানী নিজে ওয়াসি সাহেবকে নিয়ে কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎ করেন। এসব প্রতিদিন দৈনিক সংবাদপত্রগুলােতে বড় করে প্রকাশ করা হতাে।
এ অবস্থায় কিছু তরুণ কিন্তু প্রভাবশালী মুক্তিযােদ্ধা সামরিক অফিসার ও বেসামরিক নেতা অত্যন্ত জোরালােভাবে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন ও শেখ সাহেবকে সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করতে বাধ্য করেন। আমি তখন শুধু এটুকুই জানতাম । যেমন আগেই বলা হয়েছে, আসল ঘটনার অনেকাংশ পরে শুনেছি অনেকটা ‘ঘােড়ার মুখেই।।
১৯৭৮ সালের গােড়াতে আমি আওয়ামী লীগে যােগদান করি এবং বেশ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি শুরু করি। সে নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী রাষ্ট্রপতি
পদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন ঐক্যজোটের প্রার্থী ছিলেন। তাঁর জন্য প্রাচার অভিযানে চলেছি ভোলায়, তােফায়েল সাহেবের এলাকায় জনসভা হবে। আমরা ওরই মেহমান। লঞ্চে বসে গল্প । আমি, তােফায়েল ও রাজ্জাক। কথা হচ্ছিল জিয়াউর রহমানের আমলে জেল খাটার সময় তাঁরা দুজন কেমন লাঞ্ছনা ভােগ করেছেন এবং কার হাতে। সেদিন একটা দামি কথা বলেছিলেন তােফায়েল বলেছিলেন, ‘ভাই, সবচাইতে বেশি খারাপ ব্যবহার পেয়েছি ওই সব অফিসারের কাছ থেকে, যাদের আমি নিজের হাতে ভর্তি করেছিলাম ১৯৭২ সালে। এরা “আমাদের মনোভাবাপন্ন, এটাই ছিল তাদের যােগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। তাদের চাইতে শিক্ষাগত ও মেধাগত দিক থেকে বেশি যােগ্য কিন্তু আমাদের চিন্তাধারার অনুসারী নয়” এমন অনেক প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়। কাজটা বােধ হয় ভুল হয়েছে, খলিল ভাই, তাই না?’ আমি হেসেই বলেছিলাম, মারাত্মক ভুল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অযােগ্য লােকের কোনাে নীতি-আদর্শ থাকে না। থাকলেও চাকরি রক্ষার্থে তা বিসর্জন দিতে তার এক মিনিটও সময় লাগে না। অন্যদিকে সত্যিকার অর্থে যারা যােগ্য তাদের হাতে সবাই নিরাপদ, মিত্ররাও যেমন তেমনি শক্ররাও। তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মত বা বিশ্বাস সাধারণত তার কর্তব্যকর্মকে প্রভাবিত করবে না। এমনকি উপরস্থ কর্মকর্তার অবৈধ আদেশও সে মানে না—এর ফলে যদি তার চাকরির ক্ষতি হয়, তবু । সুতরাং, আমলাতন্ত্র যােগ্য লােকদের দিয়েই গঠিত হওয়া উচিত। কোনাে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তিতে নয়।’ তারপর উচ্চ হেসে বলেছিলাম, ‘যদি তা না হয়, তবে নিয়ােগকারী তার হাতে লাঞ্ছিত তাে হতেই পারেন।’ তােফায়েল কিন্তু আমার সে ঠাট্টায় যােগ দিতে পারলেন না। তখন তিনি অন্যমনস্ক। হয়তাে তার মন চলে গিয়েছিল সেই ফেলে আসা অতীতে ।।
সেদিন তােফায়েল ও রাজ্জাক আলােচনা প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, খলিল ভাই, আরেকটা মারাত্মক ভুলও আমরা করেছি। প্রধানত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কিছু সামরিক অফিসারের প্ররােচনায় । এঁদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। বলেছিলাম, জেনারেল ওয়াসি সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না। সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন একজন বাঙালি ও মুক্তিযােদ্ধা। জেনারেল ওয়াসি বাঙালি নন। মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল ওয়াসির অবদানের কথা এবং তার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত ত্যাগের কথা তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু আমরা মানিনি। অবশেষে অত্যন্ত অনিচ্ছায় তিনি রাজি হলেন। সফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমানকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত

p-35

করে তাঁদের সেনাবাহিনীর প্রধান ও ডেপুটি প্রধান নিযুক্ত করলেন।
আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এ বিষয়ে সিনিয়র মন্ত্রীরা কোনাে মতামত দেননি? উত্তরে ওঁরা বলেছিলেন, “তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীর ব্যাপারটা সম্পূর্ণই বঙ্গবন্ধুর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমি সেদিন তাঁদের বলিনি, কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলাম, এটাও নেতৃত্বের একটা বড় ভুল । অন্তত বড় সিদ্ধান্তগুলাে প্রবীণ সহযােগীদের সঙ্গে আলােচনা করেই নেওয়া উচিত।
আমি সেদিন তাদেরকে আরও প্রশ্ন করেছিলাম, যদি ওয়াসিকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হতাে, তবে কি ইতিহাস অন্য রকম হতাে না? তাদের উত্তর ছিল, “নিঃসন্দেহে। ওয়াসি ছিলেন ইংরেজ আমলের নিয়মতান্ত্রিক ধারার সৈনিক। নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল তার রক্তে। দুদিনেই তিনি পুরাে সেনাবাহিনীকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করে তাকে একটি সুশিক্ষিত সংগঠনে পরিণত করতেন। আপনারা যারা তাঁর সহযােগী হতেন, তাঁরাও কখনাে রাজনীতির দিকে ঝুঁকতেন না। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতে পারত কি না সন্দেহ। যদি হতােও, তাহলেও সে ক্ষেত্রে সংবিধান অটুটই থাকত। দেশে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হতাে না।’ এ কথা বলে তােফায়েল এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব মত জানতে চেয়েছিলেন। আমিও একই মত প্রকাশ করেছিলাম।
যা-ই হােক, বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন এবং ওয়াসিকে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কথাটি ওয়াসিকে যথারীতি জানিয়েও দেওয়া হলাে। কিন্তু ওয়াসি বেঁকে বসলেন। তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে যাবেন না, বরং অবসরজীবন যাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি বাড়িতেই বসে থাকলেন কয়েক মাস। ওয়াসিউদ্দিনের মতাে প্রবীণ অফিসারদের অবসর দেওয়া সাধারণ সময়ে এমন কোনাে ব্যাপারই নয়। কিন্তু তখন ঠিক সাধারণ সময় ছিল না। নতুন জাতি, নতুন দেশ, নতুন প্রশাসন, নতুন প্রত্যাশা ও জিজ্ঞাসা । নতুন সমালােচনা। তার ওপর সামরিক বাহিনী বাঙালির কাছে ছিল অত্যন্ত সূরের কিন্তু কৌতূহলের বস্তু। সেখানকার ক্ষুদ্র ব্যাপারও সকলে অত্যন্ত কৌতুহলের সঙ্গে লক্ষ কত ও এসব নিয়ে বলাবলি করত। এ ছাড়া দেশে তাে স্বাধীনতাবিরােধী একটি শক্তি ছিলই, যদিও তারা তখন মিইয়ে ছিল। এ জন্যই বােধ হয় শেখ সাহেব এ ব্যাপারটার একটা মিটমাট চাচ্ছিলেন।

আবার আমাদের কথায় ফিরে আসা যাক। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝতে পারলেন যে আমি জেনারেল ওয়াসি সম্বন্ধে তার কথা বুঝতে পেরেছি, তখন তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘যেমন ধরাে, খলিল, তুমিও তো সিনিয়র । তুমি
কেন হতে পারবে না সেনাপ্রধান? বলে আমার দিকে তাকালেন । চুপ করে আছি দেখে বললেন, “আমি ঠিক করেছি, তােমাকেই আমি সেনাপ্রধানের পদে নিযুক্ত করব।’ আমি চুপ করেই থাকলাম। তিনি এগিয়ে গেলেন, তবে মাকে দুই মাস সময় দিতে হবে। এর মধ্যে আমি এদিকটা গুছিয়ে ফেলতে পারব।’ কথায় বুঝলাম, সেনাবাহিনীর বর্তমান অধিনায়কদের কথাই তিনি বলছেন। সে সময়টা তােমাকে বিডিআরের কমান্ড দিচ্ছি। সেটা তাে স্বাধীন কমান্ড, অর্থাৎ কোনাে সেনা অফিসারের অধীনে নয়।’ বলেই একটু থেমে বললেন “তুমি কী বলাে?”
উত্তরে বললাম, ‘আমাকে কী করতে হবে, তা-ই বলুন।’
“তুমি আপাতত বিডিআরের প্রধান হও। তারপর জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে একটু বুঝিয়ে বলাে। শুনেছি, তােমার কথা উনি রাখেন। তাঁকে আমিও শ্রদ্ধা করি। তাকে বলে তিনি কূটনৈতিক চাকরি নিলে সেটা আমার জন্য ভালাে হয়। হ্যাঁ, শেষ কথা, তােমাকে মেজর জেনারেল র‌্যাংকও এই সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে।’
বললাম, “বেকার হােষ্টেলের মুজিব হিসেবে তাে বটেই, তা ছাড়া বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক হিসেবে আপনি যে আদেশ করেছেন, তা আমার জন্য শিরােধার্য। ভবিষ্যতে আমাকে কী দেবেন, আমাকে দিয়ে কী করাবেন, তা-ও আপনার পরিকল্পনার ওপরই ছেড়ে দিলাম । এ নিয়েও কোনাে নালিশ শুনবেন না আমার কাছ থেকে। জেনারেল ওয়াসিকেও আমি সনির্বন্ধ অনুরােধ করব। আমি তাকে যতটা জানি, তিনি খুব বড় একজন দেশপ্রেমিক। যদি তিনি পাকিস্তানে থেকে যেতেন, নিঃসন্দেহে ওখানকার সেনাপ্রধান হতেন। কারণ, তিনিই ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ অফিসার । ভুট্টো সাহেব অপাঞ্জাবি, তিনি উপযুক্ত একজনকে পেলে পাঞ্জাবি টিক্কা খানকে সেনাপ্রধান করতেন না। এ কথা ওয়াসিও জানতেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানকে নিজের দেশ বলে ভাবতে পারেননি। আপনার দেওয়া কূটনৈতিক চাকরি নেওয়া তাঁর জন্য নীতির প্রশ্ন। বস্তুতপক্ষে এটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর নীরব প্রতিবাদ। তবে আপনার এই আদেশ পালন করার আগে একটি জরুরি কথা আছে।
আপনাকে এ সম্বন্ধে পরামর্শ দেওয়া কেবল আমার কেন যে কারোর পক্ষেই ধৃষ্টতার মতাে শােনাবে। অতএব, প্রথমেই আমি আপনার অনুমতি চাইব। যে বিষয়ে আমি ও জেনারেল ওয়াসির মতাে ব্যক্তিরা বহু বছরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, সে বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের কর্তব্য, সরকারের কাছে সে সিদ্ধান্তের ফলাফল রাষ্ট্রের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর কী প্রভাব
ফেলতে পারে, তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা । আমি আর বলতে চাই, আপনার নেতৃত্বে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ত আজ মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে পারছি, যেখানে আমরা আর দ্বিতীয় শ্রেণি নাগরিক নই, সেই রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে আপনার ইচ্ছাই আমাদের আদেশ এই রাষ্ট্রের কোনাে কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করা দূরের কথা, রাষ্ট্রের সামান্যতম সেরা করার সুযােগও আমাদের জন্য পরম গৌরবের। কোনােরকম লাভের আশায় কিংবা কোনাে উচ্চাশা নিয়ে আমরা এখানে আসিনি—আমিও না, আমাদের বেশির ভাগই না, জেনারেল ওয়াসি তাে নয়ই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ যে ব্যক্তিগতভাবে আপনি আমার প্রতি অনেক স্নেহ, প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু শসস্দ বাহিনীর বর্তমান অবস্থায় আমি এতে যােগ দিলেও এর অবস্থার কোনাে উন্নতি হবে না। বরং দিন দিন তা আরাে খারাপের দিকে যাবে। মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের মধ্যে বর্তমানে অত্যন্ত বিপজ্জনক বিভাজ হয়েছে। এটা দিন দিন বাড়বে, কমবে না এবং একদিন এ থেকে অগ্ন্যুৎপাতও ঘটতে পারে। আমি বলতে চাইছি যে এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে আমার চাকরিতে যােগদান কিংবা ওয়াসির বিদেশ গমনে কোনাে লাভই হবে। যদি না মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের এই দ্বন্দ্ব নিরসনের বিষয়ে আপনার কোনাে পরিকল্পনা থাকে।’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমি তাে এই সমস্যারই সমাধান করতে চাইছি আর সে জন্যই তােমাদের সাহায্য দরকার । আমি অল্প কিছুদিনের মধ্যে তােমাদের সাহায্য নিয়েই এর সমাধান করব। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রমােশন দেওয়ার ব্যাপারে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে তা হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে আর তা হবে না। যে পর্যন্ত না এই দুই গ্রুপের সিনিয়রিটির সমন্বয় নয়, তত দিন আর মুক্তিযােদ্ধাদের “বিশেষ” প্রমােশন দেওয়া হবে না।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর কথাগুলােকে আমার অনেকটা ভাসা ভাসা ধরনের বলে মনে হয়েছিল । এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কোনাে বাস্তব ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা আছে কি না তিনি বলেননি। কাজটি জটিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তখনাে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তখনাে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রায় সমার্থক। অতএব, তিনি যে পরিকল্পনাই করুন আর সে অনুসারে যে আদেশই দিন তাই নির্দ্বিধায় পালিত হতাে। কাজেই এ কঠিন কাজটিও তিনি পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস ছিল । কিন্তু যেখানটায় সেদিন আমার সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল এবং আজও আছে তা হলাে, বঙ্গবন্ধু সমস্যাটিকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কি না। কারণ, এর বছর খানেক পরই শাসনতন্ত্র আমূল পরিবর্তন করে বাকশাল
গঠনের আল্প আগে তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল সফিউল্লাহর চাকরির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে জিয়াকেও সহকারী সেনাপ্রধানই রাখলেন।
এ সব সন্দেহ সত্তেও আমি শেখ সাহেবের আদেশ মেনে নিয়েছিলাম। কারণ মাত্র একটিই। শেখ মুজিবের মঙ্গলের জন্য ১৯৭১ সালে ও তার আগে আমি দেশের মানুষকে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি, খোলা যাতে তাঁর জীবন রক্ষা করেন, তার জন্য ‘৭১ সালে মহিলাদের রোজা রাখতে দেখেছি, যার সামান্যতম অমঙ্গলের আশঙ্কায় আমাদের বুক কেঁপে উঠত ও চোখ ভিজে উঠত, যাঁকে ওই সময় বাংলাদেশের আপামর জনগণ তাদের হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি দিয়ে ভালােবেসে ছিল (আমিও তার বাইরে ছিলাম না), তার হাত আমার বাহু ধরে রেখেছে। তিনিই আমার সহযােগিতা চাইছেন। | অতএব আমি উত্তর দিলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর আদেশে বাংলাদেশের জন্য কাজ করার সুযােগ পাব, এটাই বড় সৌভাগ্য। অতএব, আমাকে আপনি যে আদেশ দেবেন, তা-ই শিরােধার্য। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব।’ এ কথা বলে তাকে অভিবাদন জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম । বঙ্গবন্ধু ও জনাব তােফায়েল উষ্ণভাবে করমর্দন করে আমাদের বিদায় দিলেন।
পরদিন আমি আর কর্নেল রউফ গেলাম জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের বাড়িতে। তাকে সব কথা গুছিয়ে বললাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি রউফকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি বঙ্গবন্ধুকে বলে দিয়ো আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যােগদান করব।’ তিনি করেছিলেনও তা-ই।

Reference:
কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫ মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!