You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৯ই মে, বুধবার, ১৯৭৩, ২৬শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

মুদ্রার মূল্যমান ও উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা

দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে মজবুত করা এবং মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকার শীঘ্রই কতিপয় সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ সম্পর্কিত সংবাদ গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
সংবাদে আরো প্রকাশ, উৎপাদন ক্ষেত্রে মন্দাভাব, রফতানী বাণিজ্যে গতির অভাব এবং সোনার চোরাচালানের ফলে বাংলাদেশের মুদ্রার মূল্যমান দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং এই কারণে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া যে সব অসুবিধা রফতানী বৃদ্ধি ও শিল্প উৎপাদন বাড়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলিকে অপসারণের জন্য জরুরী ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিল্পে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে সেই লক্ষ্য অনুসারে উৎপাদন সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে শিল্পাঞ্চল কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা প্রবর্তন করা হবে। সেই সাথে সমাজতন্ত্রের নীতি অনুসারে উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা অর্জনের যারা সহায়তা করবেন এবং একই উদ্দেশ্যে যেসব শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করবেন তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা থাকবে। বিভিন্ন স্বার্থবাদী গ্রুপ যাতে শিল্পাঞ্চলে গোলযোগ সৃষ্টি করে উৎপাদন বিঘ্নিত করার সুযোগ না পায়, তদুদ্দেশ্যে দেশের সমস্ত শিল্পাঞ্চলগুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার বিষয়ও সরকার গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন।
প্রকাশিত সংবাদের পেছনে কতটুকু সত্যতা রয়েছে তা আমরা জানি না। তবে যা রটে তার কিছু তো বটে বলে একটি সাধারণ প্রবাদ বাংলাদেশে চালু রয়েছে। সে কথার সূত্র ধরেই আমরা বলবো, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তা আর নতুন করে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কম, মুদ্রা মূল্য হ্রাস অর্থনৈতিক দুর্গতিরই লক্ষণ। তাছাড়া কলকারখানায় উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি।
এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী মিলে আগে দৈনিক যেখানে আশি টন উৎপাদন হতো সেখানে আজ দৈনি আট টনে দাঁড়িয়েছে। আদমজীর মতো সব কল-কারখানাগুলোতেই একই অবস্থা। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন উৎপাদন বৃদ্ধি অথচ সে উৎপাদনই ব্যাহত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে আগুন। আর একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ, মওজুতদার আর চোরাকারবারীরাও তৎপর হয়ে উঠেছে।
এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে মজবুত, মুদ্রা মূল্যমান ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নেবেন বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অভিনন্দিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আর তা হলো- ইতিপূর্বেও সরকারের পক্ষ থেকে মহতী ও সুদূরপ্রসারী জনকল্যাণকর পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি এমন নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার প্রায় সবগুলো পরিকল্পনারই ‘পরি’ উড়ে গেছে শুধুমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে ‘কল্পনা’।
প্রসঙ্গতঃ আমরা একথাই বলবো, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও সমাজতন্ত্রবিরোধী আমলা আর রাজনৈতিক টাউট দিয়ে আর যাই হোক, সমাজতন্ত্র এদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে না। হতে পারে না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন পুঁজিবাদী প্রশাসন যন্ত্রের বিনাশ সাধন। কিন্তু এটা করতে হবে ধাপে ধাপে। পরিকল্পনা, কর্মসূচী আর পুঁজিবাদী প্রশাসন যন্ত্রের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যদি সরকার এগিয়ে যান তাহলে ভবিষ্যতে আর কোন মহতী পরিকল্পনার ‘পরি’ উড়ে যাবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

কানে তুলো আর পিঠে কুলো

রেশনের দোকানের ঝামেলা ক্রমশঃ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আজ চাল নেই, কাল চিনি নেই, পরশু কেরোসিন তেল নেই—এই হ’লো নিত্যকার প্রতি এলাকার খবর। অথচ সরকারী ঘোষণায় চলতি সপ্তাহ থেকে রেশন কার্ডে আগের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ কেরোসিন তেল প্রদানের জন্য রেশন ডিলারদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘোষণাটি স্থানীয় সকল দৈনিক সংবাদপত্র ও বেতার-টেলিভিশনের প্রচারিতও হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রেশনের দোকান থেকে যে সব দ্রব্যাদি সরকারী নির্দেশে যতটা পরিমাণে দেওয়ার কথা সংবাদে বারবার প্রকাশিত হয়েছে, তথ্য পাওয়া গেছে তার উল্টো। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই জনসাধারণ যখন রেশনের দোকানে প্রার্থী হয়ে দাঁড়ায়, তখন একটি কথাই শুনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ফিরে আসতে হয়, সে হলো—‘দোকানে মাল নেই।’
এছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক একাধিকবার খোলা বাজারে কেরোসিন তেল বিক্রয় নিষিদ্ধ হয়েছে। কারণ তাহলে রেশনের দোকান থেকে সরাসরি জনগণের হাতে তেল পৌঁছুবে। এই হ’লো কর্তৃপক্ষের ধারণা। তবু রেশনের দোকান শূন্য করে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের কোন যাদুতে যে তেলগুলো খোলা বাজারে বহুমূল্যের কিংখাবে মুড়ে এসে হাজির হয়, তার কারণ অজ্ঞাত।
সম্প্রতি চলতি সপ্তাহে রেশন কার্ডে দ্বিগুণ পরিমাণ কেরোসিন প্রদানের জন্য রেশন ডিলারদের প্রতি যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা নাকি কোন কোন রেশন ডিলারদের কাছে গিয়ে পৌঁছেনি। অথচ সরকারের হাতে আধুনিক প্রচারের যতগুলো যন্ত্র আছে, সবগুলোই খবরটি প্রচারে জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
ঘটনার পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারী আদেশ-নির্দেশ এই সব স্বার্থান্বেষী ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা কানে শুনতেও চায় না এবং শুনতে পেলেও মানতে চায় না। কানে তুলো আর পিঠে কুলো বেঁধে প্রস্তুত হয়েই তারা বসে আছে স্বস্থানে।
শুধু তাই নয়, এই সব মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা জনগণের স্বার্থকে চূড়ান্তভাবে অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে। একদিকে সরকারী নির্দেশ তথা সরকার, অপরদিকে দেশবাসীর স্বার্থ-পরিপন্থী কাজ করেও এরা সমাজের বুকে অক্ষত দেহে বাস করে এবং দাপটের সঙ্গে চলে।
এর প্রতিক্রিয়াও আছে। এক—কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা ও কর্মসূচী বাস্তবায়নের পথে এরা প্রবল অন্তরায় সৃষ্টি করছে। দুই—জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে দিয়ে সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে একটা ফাঁক সৃষ্টি করছে এবং ক্রমশঃ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার প্রতিশ্রুতি থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে দেশময় অসন্তোষ ও ‍বিশৃঙ্খলা ডেকে আনছে। তিন—এক পাপী অন্যতর পাপীকে এই নিরাপদ প্রলোভনের পথে প্রত্যক্ষভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এবং সমাজতন্ত্রের পথের নানা স্থানে পদস্খলনের ফাঁদ পেতে যাচ্ছে।
এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সঠিক তদন্ত চালাতে হবে। আর চুলচেরা তদন্তের ফলেই ক্ষুদে ডিলারদের সমূলে উৎখাত করা যাবে এবং জনজীবনে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানে কিছুটা স্থিতির আশ্বাস দেওয়া যাবে। কানে যারা তুলো আর পিঠে কুলো বেঁধে আছে, তাদের সমূলে উচ্ছেদ করতে না পারলে আসল সমস্যার সমাধান হবে না।

পল্লীর জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে

ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, পথ্য নেই, নার্স নেই, বেড নেই—নেই বলতে কিছু নেই—এ হচ্ছে আজকের দিনে গ্রামবাংলার হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয় বা সাধারণ চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর অবস্থা। এ অবস্থা কেবল এখনি নয়, দেশ স্বাধীন হবার আগ থেকেও ছিলো। শোষণবাদী আমলে বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রতি পাকিস্তানীরা যে সীমাহীন অবহেলা ও চরম অব্যবস্থা দেখাতো, এদেশের চিকিৎসা বিভাগ তথা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি।
দেশ স্বাধীন হবার পর সকলের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করার সার্বিক প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় খুব বেশী একটা উত্তীর্ণ হয়নি বটে, তবে অন্যান্য বিষয়ের কথা বাদ দিলেও চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের প্রতি খুব যে একটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তাও দৃঢ়তার সাথে বলা যায় না।
আজ পল্লী এলাকায় জনস্বাস্থ্যের অবস্থা এক করুণ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সামান্য পেটের পীড়া বা ঠান্ডাজ্বরের বড়ি বা ট্যাবলেটও অনেক সময় অনেক স্থানে পাওয়া যায় না। পল্লী এলাকায় সরকারী নিয়ন্ত্রণে বা পরিচালনায় যে সব চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোতে অনেক সময়ই নিয়মিত ওষুধপত্র পাওয়া যায় না—সরবরাহের অভাবে। অনেক ক্ষেত্রে যাও বা দু’একটা সরবরাহ ব্যবস্থা থাকে, সেখানে ঔষধ সাধারণ মানুষের হাতে যাওয়ার আগেই অজ্ঞাত কারণেই শেষ হয়ে যায়।
তাছাড়া উচ্চ ডিগ্রীধারী চিকিৎসকদের গ্রামের প্রতি অনীহাও পল্লীর জনস্বাস্থ্য স্বাস্থ্যহীনতা পূর্ণ হবার অন্যতম কারণ। যেকোন ডিগ্রীধারী চিকিৎসকই প্রসার প্রতিপত্তি এবং প্রভাবের আশায় শহরেই আসর জাঁকিয়ে বসেন। ফিরেও তাকান না তাঁদের ফেলে আসা পল্লীর ‍দুঃস্থ মানুষগুলোর দিকে।
তদুপরি দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যান্য সংকটের মতো আমরা ঔষধ সংকটেও মারাত্মকভাবে জর্জরিত। এই সংকট উত্তরণে বিদেশ থেকে ঔষধ আনাবার ব্যবস্থা কিছুটা করা হলেও, তা গাঁয়ের মানুষগুলোর দ্বারে পৌঁছার অবকাশ পায়না। তার আগেই বেহাত হয়ে যায়। এদিকটার প্রতিও সরকারের আশু দৃষ্টি দান অপরিহার্য।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!