You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৮শে মে, সোমবার, ১৯৭৩, ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পাকিস্তানে চীন-মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সম্প্রতি পাকিস্তানকে নতুন করে বিপুল অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানে চীন-মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ফলে উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলী সমাধান তো দূরের কথা, এ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা দুরাশায় পরিণত হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত আইনের একটি বিল জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে পেশ করা হবে। মন্ত্রী মহোদয় বিশেষতঃ পাকিস্তান-ইরান আঁতাতের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও বাংলাদেশের স্বতঃসিদ্ধ উদ্বিগ্নতার কথাও উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণা বাস্তবায়নের মধ্যেই উপমহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিহিত রয়েছে। যুক্ত ঘোষণা সম্পর্কে ভারতীয় ব্যাখ্যাপত্রের পাকিস্তানী জবাবটি ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরীক্ষা করে দেখছে বলে ডঃ কামাল হোসেন জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণার প্রতি ইতিমধ্যেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সহ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলো সমর্থন দান করেছেন। বাংলাদেশ দেশে দেশে যে দূতিয়ালী অভিযান পরিচালনা করেছে তাতে পাকিস্তান দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বলেও ডঃ কামাল অভিমত পোষণ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেগ আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের ধর্ণা প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আদালতের আইনগত কোনো এখতিয়ার নেই বলে ভারত সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে দিয়েছে।
উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে অচিরেই স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরে আসুক, এটা আমরা মনে-প্রাণে কামনা করি। ভারতও চায় উপমহাদেশে বন্ধুত্বের সেতুনবন্ধন রচিত হোক। কিন্তু পাকিস্তান এ ব্যাপারে ক্রমান্বয়ে ‍পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। চীন-মার্কিন সামরিক অস্ত্র পেয়ে বগল বাজাচ্ছে এবং ভুট্টো সাহেব ইরানের শাহ-র সঙ্গে অশুভ আঁতাত পাকিয়ে রীতিমতো উন্মত্ততা প্রকাশ করে চলেছে। এটা আর যাই হোক, সমস্যা সমাধানের পথ নয়। এ পথ উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। চীন-মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি উদ্রেকের ব্যাপারে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলেই আমাদের উদ্বিগ্নতার কারণ বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান নিজ পক্ষাবলম্বনের জন্যে আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ পর্যন্ত রুজু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আপন সিদ্ধান্তে অটল। তাই জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে এ সম্পর্কিত একটি বিল পাশ করানো জরুরী হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান যদি আস্তবলে বলীয়ান হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে, তাহলে ‍উপমহাদেশের আকাশ থেকে দুর্যোগের কালোমেঘ অপসারিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণতর হয়ে আসবে বলেই আমরা মনে করি। স্বচ্ছ জল ঘোলা করার ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেবের জুড়ি মেলা ভার। তাই তিনি যে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতোটা আগ্রহী, তা তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আমরা শান্তির পুজারী। আমরা ‍উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী। ভুট্টো সাহেব অস্ত্রের ঝংকার দেখিয়ে আর কতোদিন হম্বিতম্বি করবেন-তা জানিনা। তবে তিনি যে চীন-মার্কিন অস্ত্রের সদগতি করার জন্য পাঁয়তারা করছেন, তা আমরা এতোদিনে সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। পাকিস্তানের মনোভঙ্গির পরিবর্তন শান্তির স্বার্থে অবশ্যই একটি পূর্বশর্ত। ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘোষণার পক্ষে বিশ্বজোড়া সমর্থন মিলেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খবরের কাগজগুলোও এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অকুন্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু তাতেও ভুট্টো সাহেবের আক্কেল দাঁত গজাচ্ছেনা, এটাই পরম বিস্ময়ের বিষয়। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে আমরা বারংবার পাকিস্তানকে বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করার আহ্বান জানিয়েছি। ভুট্টো সাহেব তাতে কর্ণপাত করছেন না। তিনি কানে তুলো এঁটে রণউন্মাদনায় মেতে উঠেছেন এবং আবোল-তাবোল অযৌক্তিক সব বাহানা ‍খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমরা ভুট্টো সাহেবকে শান্তির স্বার্থে উপমহাদেশের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। চীন-মার্কিন অস্ত্রের ধমক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে বাংলাদেশকে নিবৃত্ত করা যাবে না। এবং এ পথে উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে।

ভিয়েতনাম-বাংলাদেশী জনগণের একাত্মতা

ইন্দোচীন একটি অমর নাম। সংগ্রামী মানবতার ইতিহাসে সে এক গৌরবোজ্জল অগ্নিসাক্ষী। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এবারের এশীয় শান্তি সম্মেলনে ইন্দোচীনের প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়েছিলেন শান্তির দূত হিসেবে। ঢাকা প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাদের এক সম্বর্ধনা জানানো হয়। সম্বর্ধনার উত্তরে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ হোয়ং ব্যাক তাঁর দেশ ও বাংলাদেশের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন যে, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের সংগ্রামের লক্ষ্য ছিলো এক—সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে উৎখাত করা।
বিশ্ববাসী সকলেই জানেন যে, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য ভিয়েতনামের মুক্তি-পাগল মানুষকে কত ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে। কালক্রমে সেই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে হাত মেলায় বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। শোষণে-শাসনে-অত্যাচারে ভিয়েতনামী জনগণের ভাগ্যে নেমে আসে সীমাহীন দুর্দশা। কিন্তু দুর্দমনীয় মুক্তিকামনায় উন্মত্ত বীর ভিয়েতনামী জনগণ মরণপণ সংগ্রাম করে স্বাধিকার আদায় করেছে। প্যারিস শান্তি চুক্তিতে তাদেরই বিজয় সূচিত হয়েছে। অথচ নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনও প্রতি পদে পদে সেই চুক্তি ভঙ্গ করে যাচ্ছে এবং সে দেশের জনসাধারণকে শান্তির আস্বাদে বঞ্চিত করছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশের কথা আলোচনা করলে দেখা যায়, এদেশের জনগণের সংগ্রামও ছিলো ঔপনিবেশিক শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামে বাংলাদেশ আজ বিজয়ী। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের অনুচরেরা কিন্তু তাদের খেল বন্ধ করেনি। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র সুযোগ মতো জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত ও হতাশাগ্রস্ত করে তোলার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান রয়েছে অনেক। তবু দেখা যায়—এদের ভাগ্যচক্র যেন এক সূত্রে বাঁধা। আর তাই বুঝি এই দু’দেশের সংগ্রামী জনসাধারণ পরস্পরের প্রতি এতো একাত্মতা অনুভব করতে পারছে।
যে অদম্য মুক্তির প্রেরণা নিয়ে এই দু’টি দেশের সংগ্রামী মানুষ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে লিপ্ত থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলো তা আজ সাফল্যের পথে। দু’টি দেশই আজ উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অগ্রগতির পথে এদের এই বন্ধুত্ব ও একাত্মতা অম্লান থাকুক। দিনে দিনে তা দৃঢ়তর হোক। ভিয়েতনাম-বাংলাদেশ মৈত্রী, শাশ্বত হোক! সামাজিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথে এই দু’টি দেশ বাঁধা থাকুক—এই আমাদের কামনা।

কথা প্রসঙ্গে

সাবেক গণ-পরিষদের সদস্য জনাব সওগাতুল আলম নিহত হয়েছেন প্রায় পাঁচ মাস আগে। তাঁর নিহত হওয়ার সংবাদে শোকার্ত মানুষ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এই হত্যা রহস্যের আশু তদন্তের। অপরাধীর শাস্তি দাবী করে গন্ডায় গন্ডায় প্রস্তাবও নেয়া হয়েছে। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি তো দূরের কথা তার টিকিটিরও সন্ধান করতে পারেননি নাকি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ। সম্প্রতি খবরের কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছে যে মরহুম সওগাতুল আলমের মূল হত্যাকারী ঢাকায় বেশ বুক উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রকাশিত রিপোর্টের সত্য যাচাই করবেন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ। অপরাধীকে গ্রেফতার করা এটা তাদেরই দায়িত্ব জনগণ সে দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিতে খুব একটা উৎসুক নয়। কিন্তু তা হলে হবে কি, রাস্তায় অপরাধী পিটিয়ে মারা অথবা প্রকাশ্যে দেড় টাকার সিগারেট তিন টাকায় বিক্রি করার মতো ক্রিয়াকর্ম বেশ অবাধেই চলছে। দু’টো কাজই নিয়মবিরোধী। অথচ কাজ দু’টোই চলছে। একটু গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে এই দু’কাজের পিছনেই যে মানসিকতা কাজ করে তা হলো দেশের প্রচলিত আইন এবং সে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনাস্থা।
এ অবস্থা হতাশার সৃষ্টি করে। চরম হতাশা মানুষকে ন্যায় অন্যায় বোধ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। মরহুম সওগাতুল আলমের মতো একজন প্রথিতযশা রাজনীতিক এবং প্রাক্তন ছাত্রনেতার হত্যা রহস্যের কুল-কিনারা যখন এই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ গত পাঁচ মাসের মধ্যেও করতে পারেনি, তখন সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেন, এই সংস্থাসমূহের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবেন-এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যখন খবর প্রকাশিত হয় যে হত্যাকারী বুক টান করে রাজধানী ঢাকারই রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!